হে নৃপতি অধিরাজ,
ক্ষমা
করবে, প্রণতি জানাবার স্থিরতা আজ নেই। আমি
তোমাদের ছোটবউ। বহু বছর আমাদের
বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত তোমাকে
কোন চিঠি পত্র লিখি
নি। এতটাকাল কাছেই পড়ে রয়েছি--আমার
মুখের কথা কখনও শুনেছ, কখনও শোনোই নি। কেবল আমিই
শুনে গেছি । তাই
চিঠি লেখবার প্রয়োজন পড়েনি। চিঠি লেখার মতো
ফাঁকটুকু যে পাওয়া যায়নি
বা ইচ্ছে হয়নি তা নয়।
বারংবার লিখতে যেয়েও এক অচেনা নয়,
অজানা ভীতি হাত রুদ্ধ
করে দিয়েছে। আমি
এখন সীমানা পেরিয়ে বহুদূরে তোমাদের নাগালের বাইরে। তাই আজ সাহস
করে এই চিঠিখানি লিখছি ।
এ কেবল তোমাদের ছোটবউয়ের চিঠি নয়, এ সংসারে মেয়ে মানুষের চালচিত্র ।পার্থিব জীবন তোমার দেহ মনের সঙ্গে এমন ভাবে এঁটে গেছে যে ছুটি মনজুর হলো না। তুমি রয়ে গেলে তোমার প্রিয় এই বিশ্ব সংসারেই । বিধাতার তাই অভিপ্রায়। কিন্তু তিনি আমার ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর করেছেন। তাতে আমার কোন শোক নেই।নেই কোন বিষাদ। কিন্তু আমার অনেক ক্ষোভ ও বড্ড বেশি ঘৃণাও বোধ হচ্ছে তোমাদের এই ভণ্ডামি দেখে। আজ তোমরা আমায় দেবীর আসনে আসীন করছো ।আমার দেবীত্ব,আমার সতীত্ব কত গুণগান, কত মহিমাকীর্তন।সতীসাধ্বীর পতিব্রতা নিয়ে জনে জনে চলছে বর্ণনার পালা । আমার এইসব বড্ড অসহ্য লাগছে। চিতার আগুনে যে প্রশান্তি আমার ! তোমাদের মিথ্যে স্তুতি ততটাই দহনের জ্বালা দাহ । দগ্ধ্যিকরণ !
এ কেবল তোমাদের ছোটবউয়ের চিঠি নয়, এ সংসারে মেয়ে মানুষের চালচিত্র ।পার্থিব জীবন তোমার দেহ মনের সঙ্গে এমন ভাবে এঁটে গেছে যে ছুটি মনজুর হলো না। তুমি রয়ে গেলে তোমার প্রিয় এই বিশ্ব সংসারেই । বিধাতার তাই অভিপ্রায়। কিন্তু তিনি আমার ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর করেছেন। তাতে আমার কোন শোক নেই।নেই কোন বিষাদ। কিন্তু আমার অনেক ক্ষোভ ও বড্ড বেশি ঘৃণাও বোধ হচ্ছে তোমাদের এই ভণ্ডামি দেখে। আজ তোমরা আমায় দেবীর আসনে আসীন করছো ।আমার দেবীত্ব,আমার সতীত্ব কত গুণগান, কত মহিমাকীর্তন।সতীসাধ্বীর পতিব্রতা নিয়ে জনে জনে চলছে বর্ণনার পালা । আমার এইসব বড্ড অসহ্য লাগছে। চিতার আগুনে যে প্রশান্তি আমার ! তোমাদের মিথ্যে স্তুতি ততটাই দহনের জ্বালা দাহ । দগ্ধ্যিকরণ !
দেবী? নাহ ! আমাকে দেবী বোলো না আমিতো কোন দেবী নই, নই কোনো শরৎ প্রভাতের পবিত্র শিউলি ফুল। আমি এক সামান্য নারী। যে কেবলি নারী । আমি রবি ঠাকুরের সাধারণ মেয়ে, জীবনানন্দের সুরঞ্জনা কিংবা শরৎ বাবুর অচলা। তাই আমার ক্ষমতা ওদের মতই । আমাকে দেবী বোলো না। দেবীই যদি হবো তবে আমার কেন এত অক্ষমতা? যা চেয়েছি তা কেন করতে পারিনি।
পৃথিবীর মাঝে যা কিছু তুচ্ছ তাই সব চেয়ে কঠিন কেন? এই আমার চার পাশের শক্ত ইঁট সুরকির যে দেয়াল তা ভাঙতে পারিনি কেন ? তবে দেবী কিভাবে হলাম ? জীবনের চার পাশে প্রাচীর তোলা নিরানন্দের সামান্য বুদবুদ টুকু এত শক্তিময় কেন? বিধাতার বিশ্ব জগতের মাঝে ছয় ঋতুতেও শুধু পাত্র হাতে বসন্ত আসে। তবে আমার জীবনটা এমন কেন ? কেন আমি এক মুহূর্তের জন্য পারিনি অন্দরমহলের এই সামান্য চৌকাট্টা পেরোতে ? বিধাতার এমন সুন্দর ভুবনে আমার এতুটুকু জীবন নিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে তিল তিল করে মরতে হলো ? কত তুচ্ছ আমার প্রতিদিনের জীবন যাত্রা। কত তুচ্ছ চাওয়া পাওয়া । কত বাঁধা নিয়ম ,বাঁধা অভ্যেস,বাঁধা বুলি ,তবে কি জীত হবে এই হীন নাগপাশের আর হার হবে আমার ?আজ পঁচিশ বছর পরে জানতে পেরেছি এই জগতে আমার কিছু চাওয়া পাওয়া ছিল। সংসারে দুঃখ বলতে লোকে যা বোঝে তা আমার ছিল না। তোমাদের সংসারে খাওয়াপরার অভাব কোনোদিন হয়নি আমার । তোমার চরিত্র যেমনই হোক, তুমি তোমার অন্য ভাইদের মতন স্ত্রী ত্যাগ বা বিসর্জন করে অন্য মেয়েমানুষ ঘরে তোলো নি। আমায় তুমি যদি ত্যাগ করেতে তবে, আমার অন্য জায়েদের মত ভাগ্যকে মন্দ বলে বিধাতাকে দোষ দিতে পারতাম । তাই বিশ্ব দেবতাকে দোষ না দিয়ে দোষ দিয়ে গেছি আজীবন নিজেকেই ।
না ! তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আমার কোন নালিস
নেই এইভেবে যে ,আমাকে আর ফিরতে হবে না তোমাদের রামকৃষ্ণ
মিশনের গলিতে। সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষের পরিচয়টা যে কী তা
আমি সেখানে দেখতে পেয়েছি। । আমি মেয়ে বলে ঈশ্বর আমায় ত্যাগ করেনি।
তাঁর ক্ষমতা তোমাদের থেকে অনেক। আমার ওপর
তোমাদের এই সংসারের যত জোর থাকুক
না কেন ,সেই জোরের অন্ত আছে। কেবল নিজের ইচ্ছে মত, নিজের দস্তুর দিয়ে পায়ের নিচে চেপে রেখে দেবে তোমাদের পা এত বড় না। বিধাতার
সৃষ্ট এই হতভাগ্য মানব জন্মের চেয়ে তা অনেক বড় মৃত্যু।সেই মৃত্যুর অনেক মহান তোমাদের
চেয়ে বড়
। সেখানে আমি কেবল বাঙ্গালী
ঘরের বৌ নয়
,প্রবঞ্চিত স্বামীর পাগল স্ত্রী নই
!!!!এখানে আমি অনন্ত।
এই মৃত্যুর বাঁশি যেদিন বাজলো সেদিন যেন মুক্তির বারতা
আমার প্রাণে এসে লাগলো
। নাহ,!! ওই যে মৃত্যুর বাঁশি বাজলো।.হায়রে !!! কত দুঃখে কত অপমানে বন্দি ? তোমাদের নিয়ম কানুন দিয়ে ঘেরা দেয়াল কোথায় ?
ঐতো মৃত্যুর হাতে বিজয়ের জয় পতাকা উড়ছে।
আজ আমি আর কেবল এই পরিবারের ছোট বৌ না ,আমি একজন মানুষ। যে বিশ্ব বিধাতার এত আপন ।আমি আর কারো বন্ধনে বাঁধা নই । আমার সামনে নীল সমুদ্র মাথার উপর মেঘ পুঞ্জ ।যা এতদিন সংসারের অভ্যেস অন্ধকারে আমাকে ঢেকে রেখে ছিল । আজ মৃত্যুর পরওয়ানা আমার আগে গোড়া ছিন্ন করে গেলো। .
আজ আমি আর কেবল এই পরিবারের ছোট বৌ না ,আমি একজন মানুষ। যে বিশ্ব বিধাতার এত আপন ।আমি আর কারো বন্ধনে বাঁধা নই । আমার সামনে নীল সমুদ্র মাথার উপর মেঘ পুঞ্জ ।যা এতদিন সংসারের অভ্যেস অন্ধকারে আমাকে ঢেকে রেখে ছিল । আজ মৃত্যুর পরওয়ানা আমার আগে গোড়া ছিন্ন করে গেলো। .
আমার
সতীত্ব নিয়ে তোমরা যে
গুন কীর্তন
করছো। তোমারা কি জানো? তোমার অবহেলিত, নিগৃহীত ও অনাদৃত আমার
এই রূপ একজনের চোখে
ভালো লেগেছিলো । সেই মানুষটার
সুন্দর হৃদয় আমাকে দিয়েছে
আকাশ সমান ভালোবাসা ।আমাকে
মেয়েমানুষ নয় মানুষ ভেবেছে
।
হায়রে!! মানুষে কত তফাৎ দেখো। সে তোমাদের মতো অটো উচ্চ "খান্দানি " বংশদ্ভূত নয়। তোমাদের সেক্সপিয়ার, শেলী আর কিট্স্ আওড়াতে জানে না ।খুব সাদা মাটা বোকা তোমাদের আশ্রিত। তোমাদের মতো ওর ক্ষমতা নেই ।নেই মন্ত্রী আইজি ডিআইজি দখলে। সে আমারই মতো সাধারণ অতি সাধারণ। তাই তোমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমায় শৃঙ্খল মুক্ত করতে পারেনি। শুধু সে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল । একবুক ভাল্ভাসা দিয়ে আমায় বুঝেছিলো। সবাই দেখতো আমার সুন্দর বড় টানাটানা চোখ। আর সে দেখতো সেই চোখের বেদনা । তুমি ভাবছ আমার অনুশোচনা বা অপরাধ বোধ হচ্ছে? না মটেও না। আজ আমার গৌরব রাখার জায়গা নেই। আমার কিসের ভয়? এত আমার অহংকার । সূর্যমুখী ফুলের মত তোমার পানেই চেয়েছিলাম সারাটা জীবন।তুমি যে ফিরেও চাওনি। আমার প্রানের মাঝে সুধা ছিল তার খবর নাও নি। পারিজাতের মধুর গন্ধও পাওনি। আমার দেহে মনে বাণ ডেকেছিল তুমি সাড়া দাওনি ।
আমাকে সম্পূর্ণ করেছে একটি মানুষকে । সে আমায় ছুঁতে পারেনি তাতে কি আর আসে যায় বল? মীরাবাঈও তো আমারই মতো ছিল । কৃষ্ণও তো তাঁকে ছোঁয়ে নি ।তাই বলে তাঁর ভালবাসা কম ভারী ছিল না । সে হার মানেনি। সেতো লেগেই রইলো ভালোবাসার সাথে । আর এই লেগে থাকাই বেঁচে থাকা। আমিও বেঁচে থাকবো আমার ভালোবাসার মাঝেই. এটুকু আমার ক্ষমতা।
শেষ করার আগে এক মহা মনীষীর কথা তোমায় বলি” ওর উপরে তোমাদের যত জোরই থাক্-না কেন, সে জোরের অন্ত আছে। ও আপনার হতভাগ্য মানবজন্মের চেয়ে বড়ো। তোমরাই যে আপন ইচ্ছামতো আপন দস্তুর দিয়ে ওর জীবনটাকে চিরকাল পায়ের তলায় চেপে রেখে দেবে, তোমাদের পা এত লম্বা নয়। মৃত্যু তোমাদের চেয়ে বড়ো” । আর এই মৃত্যুই আমাকে করেছে মহান।
ইতি
তোমাদের
পায়ের তলে দাবীয়ে রাখা
থেকে মুক্ত
সুরঞ্জনা
(এ যুগের মৃণাল)
মেয়েদের জীবনের এতো চরম ঘটনা সত্য খুবই হৃদয়গ্রাহী। অনুভূতি প্রবন মর্মস্পর্শী লেখা চিঠি
ReplyDeleteদারুন লেখা
ReplyDeleteতোমার চিঠি পড়লাম কি হূদয়স্পসী আর মর্মগ্রহী
ReplyDeleteএত মর্মস্পর্শী লেখা আগে কেন পড়িনি খুব আফসোস হচ্ছে। এটা শুধু সুরঞ্জনার বা মৃণালের কথা নয় । আমি আভিভুত সানজিদা রুমি ।সত্যিই ধন্য আপনি !!!নারীত্ব আমার অহংকার !এর মত লেখা লিখতে পারলেন কি করে সুরঞ্জনার এই বঞ্চনার কথা লেখার পর।
ReplyDeleteলেখাটা পড়ে অনেকক্ষণ কাদলাম।মনটা ভারী হয়ে গেল।সংসারের মিথ্যা প্রবধের চেয়ে চিতার আগুনে প্রশান্তি কি নিদারুন কথা। আপনাকে আমার মিনতি আপনি আরো লেখেন আমাদের কথা। চিঠিতে গল্পে উপন্যাস কবিতায়।
ReplyDeleteআমি একজন রবিন্দ্রনাথ বিসয়ক প্রফেসার। আমি হলপ করে বলতে পারি মৃণালের পত্রের থেকে অনেক মর্ম স্পর্শী ।মৃণালের ব্যথা বর্ণনা করেছন রবী ঠাকুর গোটা একটা উপন্যাসে।আর সাঞ্জিদান সুরঞ্জনার বঞ্চনা ওঃ ভালবাসা দুটই তউলে ধরেছে মাত্র এখতা পত্রে।খুব ভাল লেগেছে দারুন!
ReplyDeleteদারুন!এটা শুধু পত্র না একটা সম্পূর্ণ জীবন কাহিনি।সানজিদার লেখা নিয়ে আমি অনেক আশবাদি। অনেক দোয়া করি আর ভাল লেখ।
ReplyDeleteএত মর্মস্পর্শী নারীদের উপর লেখা পত্র ।কি বলব আম ভাষাহীন! অনেক শুভ কাম্পনা ওঃ ভাল বাসা
ReplyDeleteআমি অভিনয় নিয়ে ব্যস্ততার কারনে বই পড়া হয়ে উঠেনা যদিও এটা যুক্তিযুক্ত নয় |বই বহন করা একটু কষ্টকর |ধন্যবাদ সানজীদা তোমার অনুরোধে আমি আলোকরেখা Visit করতে যেয়ে এখন আমি আসক্ত হয়ে গেছি |কাজের ফাঁকে একটু সময় পেলেই ফোনে আলোকরেখা পড়ি | বিশেষ করে তোমার লেখা এত সুন্দর সহজ করে তুমি লেখ পাঠকের মনের কথা |খুব ভাল লাগে তোমার চিঠিটা দারুন আবেগময় [
ReplyDeleteআমি হে নৃপতি লেখাটা যতবার পড়ি বুকটা ভারী হয়ে যায় . সংসারে মেয়ে মানুষের চালচিত্র সানজিদা রুমী কেমন করে অনুভব করলেন ?এই শুধু লেখকরাই পারে আপনার সব লেখাই আমি পড়ি খুব ভালোলাগে
ReplyDeleteMomena Barkat এর মত আমি যে কতবার পরেছি। তবুও যেন কোথায় শেষ হয় না । এত বাস্তব এত মর্মস্পর্শী লেখা । এই উন্নত প্রবাসেও কি মেয়েদের জীবন এমনি নয় সানজিদা আপা? এবার প্রবাসের মেয়েদের নিয়ে লিখুন আপা আমি সাহায্য করবো ।
ReplyDeleteসানজিদা রুমি আমি আপনার হাতটা ধরতে চাই ,যে হাত দিয়ে এমন কঠিন রুঢ় বাস্তব লেখা লিখেছে। কেমন করে পেলেন এই শক্তি এই পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সামাজে? ধন্য আপনি!জয় আলকরেখা ।জয় নারীদের
ReplyDeleteএত মর্মস্পর্শী লেখা আগে কেন পড়িনি খুব আফসোস হচ্ছে। এটা শুধু সুরঞ্জনার বা মৃণালের কথা নয় । আমি আভিভুত সানজিদা রুমি ।সত্যিই ধন্য আপনি !!!নারীত্ব আমার অহংকার !এর মত লেখা লিখতে পারলেন কি করে সুরঞ্জনার এই বঞ্চনার কথা লেখার পর।
ReplyDeleteলেখাটা পড়ে অনেকক্ষণ কাদলাম।মনটা ভারী হয়ে গেল।সংসারের মিথ্যা প্রবধের চেয়ে চিতার আগুনে প্রশান্তি কি নিদারুন কথা। আপনাকে আমার মিনতি আপনি আরো লেখেন আমাদের কথা। চিঠিতে গল্পে উপন্যাস কবিতায়।
ReplyDeleteআমি হে নৃপতি লেখাটা যতবার পড়ি বুকটা ভারী হয়ে যায় . সংসারে মেয়ে মানুষের চালচিত্র সানজিদা রুমী কেমন করে অনুভব করলেন ?এই শুধু লেখকরাই পারে আপনার সব লেখাই আমি পড়ি খুব ভালোলাগে
ReplyDelete