এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কল্যানে আমরা এখন অনেক কিছুই ঘরে বসেই পেয়ে যাই। আগের মত আর ঘরে-দ্বারে-প্রান্তরে দৌড়াতে হয় না এমন একটা সময়ে অন্য সব দিবসের মতো "21st February" পালন করাও যেন একটা ফ্যাশন হযে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষ করে 'ফেসবুক`এর কল্যানে তা সবার কাছে প্রতিভাত।আমরা কালো পাঞ্জাবি ও নানা ডিজাইনের সাদা-কালো শাড়ী পরে নানা পোজের ছবি পোস্ট করি।
নানা পদের খাবার দাবার আর সেইসাথে এলকোহল জাতীয় পানীয় তো এই বিশেষ দিনের একটা অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে ! অবশ্য সাথে গান বাজনাও থাকে। এরপর আবার ফেসবুক এ status দেই "আ-মরি বাংলা ভাসা"..! এতসব নব্য প্রথার আতিশয্যে যে "ভাষা" 'র বানানটাও ভেসে যাচ্ছে সেদিকে কাউরো কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সেলফি কিংবা অন্যের তোলা ছবিতে পোজটা ঠিকমত হলো কিনা সেটাই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে! প্রিয় কবিবর দেবব্রত সিংহের কথার সূত্র ধরেই বলছি "উৎসব আছে, দায়বদ্ধতা নেই।"
বাংলা ভাষার ইতিহাস জানাটা নাকি সস্তা আবেগ বা ইমোশন। স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়েও আমাদের মনোভাব প্রায় একই রকম । আমরা এরকম কথাও বলি, ৭১ সালে যুদ্ধ-টুদ্ধ, না কি যেন হয়েছিল? সেটা এখনো ধরে থাকলে চলবে নাকি? দেখনা পশ্চিমা দেশগুলো কেমন এগিয়ে গেছে আর আমরা কত পিছনে পড়ে আছি। পুরোনো আর বস্তা পচা এইসব বুলি না আওড়িয়ে we should move on! যত সব সস্তা সেন্টিমেন্ট! এই ধরণের কথাগুলো শুনে আমার খুব অবাক লাগে এই ভেবে যে এই ফালতু সেন্টিমেন্টের কারণেই কিন্তু আমরা বুক উঁচু করে বুলেট ঠেকিয়ে পেয়েছি একটা মানচিত্র। পেয়েছি একটা স্বতন্ত্র পাসপোর্ট, যা নিয়ে এখন বিদেশে পাড়ি জমাই। এই সস্তা (?) সেন্টিমেন্টকে আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত না করলে নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে থাকতে হতো নাম গোত্রহীন উদ্বাস্তু হয়ে official “refugee status” নিয়ে। বাংলাদেশের ভেতরে বা দেশের বাইরে এখন আমাদের পরিচয় পত্র যাই হোক না কেন আমাদের আসল পরিচয় আমরা বাঙালী, বাংলা আমাদের মাতৃ ভাষা।আমরা দেখছি যে এতসব শুনতে আমাদের অনেকের একদম ভাল লাগে না।তাদের মতে আগে কি ছিলাম তা বলার বা জানানোর দরকার কি ? অনেকটা এরকম: " তোমার হালচাল ভালো লাগে। তোমার গাড়ি বাড়ি ভালো লাগে। কিন্তু তোমাকে তো ভালো লাগে না। তোমার সম্পর্কে gossip ছাড়া আর কিছু জানার ইচ্ছে নেই।" বাংলা ভাষা সম্বন্ধে জানার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহটা অনেকটা সেরকম। বাংলা ভালো ভাবে না জানাটা যেন একটা গর্বের বিষয়। আমরা একটা অহংকার নিয়ে দাম্ভিকতার সুরে বলি “জানেন? আমি বাংলায় টেনেটুনে ৩৩ পেয়েছি।”
এটা ঠিক যে ইংরেজী জানতেই হবে, কারণ এই ভাষাটা অনেকটা বিশ্ব ভাষার মত একটা স্থানে পৌঁছে গিয়েছে। ইংরেজী বা অন্য কোন ভাষা, এমনকি উর্দু ভাষার সাথেও আমাদের কোন বৈরিতা নেই। কিন্তু শেকড় ছাড়া কি গাছ বাঁচে? যেমন বলতে পারি, আমার বাবা ছিলেন একজন ভাষাবিদ ও কবি। অনেক গুলো ভাষায় পারদর্শী তিনি। তাঁর বেশিরভাগ কবিতা ইংরেজিতে লিখা।কিন্তু বাবা আমাদের বলতেন " দুটো ভাষা তোমাদের জানতেই হবে। একটি ইংরেজী আর অন্যটি হলো তোমার মাতৃ ভাষা।" আমার শশুর বাড়িতেও দেখেছি, এক একজন বাঘা বাঘা বিদ্যান। কি তাঁদের জ্ঞানের পরিধি ! বিশ্বের সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা, কিন্তু তাঁরা ইংরেজী ভাল জানেন এই বলে পান্ডিত্য জাহির করে বেড়াতেন না। আমার পিতৃকুল বা শ্বশুরকুলের সবাইর কাছে বাংলা না জানাটাই বরং লজ্জার বিষয় ছিল।
আমরা এখন পরবাসী। এখানে বাংলা ভাষা চৰ্চা করা সহজসাধ্য নয়। এরকম পরিবেশেও কিন্তু সন্তানদের আরবী ভাষা শেখানোর জন্য ঘরে বাইরে মাস্টার নিয়োগের চেষ্টার অন্ত নেই। অথচ এখানে বাংলা শেখার অনেক বিদ্যাপীঠ থাকা স্বত্তেও আমরা কজন আমাদের ছেলে-মেয়েদের সেখানে পাঠাই ? জানি, ব্যস্তময় জীবনে অনেক কাজের মাঝে সম্ভব হয়ে ওঠে না । কিন্তু অন্তত ঘরে তো এদের সাথে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি। ওরা ইংরেজীতে উত্তর দিলে বলতে পারি, "বুঝলাম না, বাংলায় বল।" তখন তারা ঠিকই বলবে। এভাবেই চর্চা হবে। আমি এখানে দুটো উদাহরণ দিতে চাই। একটা হলো আমার ননদের মেয়ের। ওর নাম Arisa (ওর নামটা নিলাম কারন ওকে নিয়ে আমরা গর্বিত) ও বিদেশেই বেড়ে ওঠা। সে শুধু বাংলা বলতে পারে তা শুধু নয় , সে বাংলা পড়তে ও লিখতেও জানে। একদিন একটা গানের কথা লিখতে ভুল করেছিলো বলে লজ্জায় কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল। আর একটা উদাহরণ বাঙালী অধ্যুষিত ড্যানফোর্থ এলাকা। আমরা অনেকেই বেশ গর্বের সাথে বলে থাকি, "আমরা ওখানে যাই না, বাঙ্গালীদের সাথে মিশি না।" কিন্তু এই ড্যানফোর্থ এলাকার বাঙ্গালীরাই আমাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওখানে সবাই বাংলায় কথা বলে। বাংলায় গান গায়। আমি এই ড্যানফোর্থ এ আমাকে ফিরে পাই! এখানেকেউ "আমাদের বাচ্চারা না বাংলা বলতে জানে না" এই কথা বলে নিজেকে কুলীন প্রমান করার চেষ্টা করেনা কারণ এখানে সবাই জানে ইংরেজীর মত বাংলা না জানাটাও লজ্জার। একটা প্রবাদ আছে, "ধোপা ঘাটের কুকুর - বেচারা না ঘাটের না ঘরের!" আমরা যারা তথাকথিত "কুলীন বাঙালি" আমাদের অবস্থাটা অনেকটা সেরকম ! আমাদের কাছে বাঙালীদের সাথে ইংরেজীতে কথা বলাটা সম্মানের! (?) আমাদের বাচ্চারা বাংলা জানেনা না এটা মহা সম্মানের! (?)
তাই ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের লেখা "বাংলাটা ঠিক আসে না!"র আদলে আমার এই রম্য কবিতাটি রচিত।
বাংলা বলতে জানে না
আমার ছেলেমেয়েরা খুব মর্ডার্ন, বাঙালির মত সস্তা কথায় হাসে না।
ইংলিশে ওরা ফ্লোয়েন্টলি কথা বলে
‘ডিবেট’ করে, কবিতা পড়ে মাতিয়ে তোলে।
ওরা একেবারে পশ্চিমা বাঙালীর মত অলীক স্বপ্নে ভাসে না
জানেন ভাবী, আমার ছেলেমেয়েরা, বাংলা বলতে জানে না।
ইংলিশ’ ওদের ঠোঁটের ডগায়, ওটাই ‘ফাস্ট’ ল্যাঙ্গুয়েজ
ফ্রেঞ্চ সেকেন্ড, সত্যি বলছি, ফ্রেঞ্চে ওদের দারুণ তেজ।
কী লাভ বলুন বাংলা বলে ?
আজকাল কি আর বাংলা চলে ?
বেঙ্গলি ওদের মাতৃ ভাষা , তাই তেমন ভালোবাসে না
জানেন ভাবী, আমার ছেলে মেয়েরা, বাংলা বলতে জানে না।
ভাবী, বাংলা আবার ভাষা নাকি, কেবল এম্বারাসমেন্ট বেঙ্গলীতে
ইংলিশ বলাটাই ভ্যানিটি, কেন পারি না মেনে নিতে?
ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ,ভেরি ফ্যান্টাসটিক
ফ্রেঞ্চ? সুইট এন্ড পোয়েটিক।
বেঙ্গলি ইজ প্রিমিটিভ, এই যুগে এটা ঠিক খাটে না,
জানেন ভাবী, আমার ছেলেমেয়েরা বাংলা বলতে জানে না।
বাংলা বলা লোয়ার ক্লাসেস, মান ইজ্জতের ফালুদা
তাইতো আমার ছেলেমেয়েরা ইংলিশ বলে সদা-সর্বদা ।
"মোদের গর্ব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা"
এগুলো এক্সট্রা রাবিশ আর চিপ ইমোশনে ঠাসা।
তবে ভাবী, "ল্যাঙ্গুয়েজ ডে" পালন করতে ওরা কিন্তু ভোলে না
যদিও ওরা বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে মাথা তত ঘামায় না।
বিশ্ব পেলো "ল্যাঙ্গুয়েজ ডে" - ৫২'তে আন্দোলন
শহীদ হলো সালাম বরকত - কত প্রাণ দিল বলিদান।
এতসব জেনে লাভ কি ভাবী? বস্তা পচা সেন্টিমেন্ট
বেঙ্গলিদের সাথে বেঙ্গলি বলা লজ্জ্বাসকর, ইংলিশ বলাটাই এলিগেন্ট।
ইংরেজী ভাষা শব্দে খাসা .........ওটা বলাই ইন
বেঙ্গলি এক্সেন্ট গ্রামারে ভুল, দারুন ডিসগাস্টিং।
যদিও ইংলিশ বলে নিজের মত বিশ্বের অন্য ভাষাভাষী
নিজের ভাষাকে খাটো করে না ইংলিশের পাশাপাশি।
আমরা কেন হীনতায় ভুগি বলি না বাংলায় কথা
না বলতে পারলে ইংলিশ দারুণ বেছে নেই নীরবতা।
ইংলিশ ভাষা কি নিদারুন, বাংলা না জানাটাই কুল
বাংলা বলে সোসাইটিতে হবে নাকি ওরা ফুল।
শেক্সপীয়র, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী, কীটস বা বায়রন
ভাষা ওদের কী বলিষ্ঠ, শক্ত-সবল যেন আয়রন।
কাজী নজরুল ,বঙ্কিম, আর দত্ত মধুসুধন ওদের কাছে তুচ্ছ নেহাত,
টেগোর আর রে' কে চেনে কারণ তারা পশ্চিমাদৃত।
পশ্চিমা ধাঁচে চলে ওরা তাই অভিমান বোঝে না
জানেন ভাবী, আমার ছেলেমেয়েরা বাংলা বলতে জানে না।
সানজিদা রুমি কর্তৃক গ্রথিত
http://www.alokrekha.com
তোমার লেখাতা খুব ভাল হয়েছে।সধারনত সবার লেখা আমার প্রানে ধরে না।এখন যা হচ্ছে তার প্রতিচ্ছবি
ReplyDeleteআমি অনেককে জানি দেশে বসে তারা গর্ব বোধ করে তাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা জানে না
ReplyDeleteদারুন লিখেছ। ভবানী প্রসাদ আমার খুব প্রিও,তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি। তোমার কবিতাটা যুগ উপযোগী
ReplyDeleteআমাদের এই অপসংকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। এই সময়ে সানজিদা তোমার লেখা প্রশংসার দাবিদার
ReplyDeleteঅনেক অনেক ভালো লেগেছে কবিতাটা. সত্যি এমনটি হয় ও হচ্ছে
ReplyDelete