১৯৭১ এবং সলিমুল্লাহ সড়ক - সাদী আহমেদ !
বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ অকস্মাৎ ঘটা
কোনো ঘটনা নয়। এই স্বাধীনতা দীর্ঘ
সংগ্রামের! সে কারণেই আমরা আমাদের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করতে
পেরেছি। উল্লেখ্য যে আধুনিক বিশ্বে
বাংলাদেশ ছাড়া শুধুমাত্র আমেরিকার বেলায় স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিলো। আমাদের জাতি
স্বত্তার ও স্বাধীনতার ধারাবাহিকতার প্রথম পদক্ষেপ ভাষা আন্দোলন।
জাতীয় স্বত্তার উন্মেষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস থাকা চাই। ভাষা আন্দোলন
আমাদের সেই চেতনার ও অনুপ্রেরণার উৎস ! যা এখনও এক এবং অখণ্ড।
বিস্মিত হই - যারা স্বাধীনতার জন্য মহান যুদ্ধে
অংশ গ্রহণ করেছি সেই আমরা বিভিন্নভাবে অনগ্রসরতার দিকে ধাবিত। যা সত্যিই বেদনাবহ ! এ যেন অন্ধকে ছেড়ে দেওয়া -
ছেড়ে দিলেও বেশী দূর যেতে পারে না, আটকে পড়ে।
মনে ভাবি কোথায় আমাদের স্বাধীনতা? কোথায়ই
বা ৭১এর চেতনা? যে স্বাধীনতার জন্য আমাদের অগ্রজ, স্বজন,
বন্ধুরা রক্ত দিয়েছিলেন সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের শেষ নেই। এই রকম একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করছি।
২৫সে মার্চ, ১৯৭১,
দিবাগত সন্ধ্যা। ঢাকার
মোহাম্মদপুর ছাত্র লীগের উদ্যোগে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘরোয়া সভায় ছাত্র নেতা নূরে আলম
সিদ্দিকী এসেছিলেন। এটিও নির্ধারিত ছিল যে
তৎকালীন ডাকসু'র সব ছাত্র নেতাই ওই সভায় উপস্থিত থাকবেন। সভাস্থলঃ সলিমুল্লাহ সাহেবের (১) বাসভবন।
ঘরোয়া সভা চলছে। আমি কখনো কখনো বাইরে বের হয়ে আসছি আর মনের
অজান্তেই "জয় বাংলা" বলছি! তৎকালীন সময়ে ঢাকার মোহাম্মদপুর সংখ্যাগরিষ্ঠ
অবাঙালী অধ্যুষিত এলাকা। সেই সময়ের অবাঙালী
(বিহারী) নেতা সিরাজ-উল-ইসলাম (২) এবং রাফে উদ্দিন (৩) কিছু সময়ের জন্য সভাকক্ষের
বাইরে অবস্থান করছিলেন। পরে এক পর্যায়ে এরা দু'জন
সভায় অংশ গ্রহণ করেন। "জয়
বাংলা" স্লোগানে তারা বিরক্ত হয়ে উর্দুতে বলেন, "জয়
বাংলা মাৎ বোলো" ("জয় বাংলা" বলোনা)। "গন্ডগোল হোগা - বহুত
গন্ডগোল হোগা, জয় বাংলা মাৎ বোলো। "
সন্ধ্যাকালীন সেই সভা সময় গড়িয়ে যখন আনুমানিক
১০টার দিকে পৌঁছায় তখন অবাঙালী কিছু সংখ্যক তরুনের সাথে বিশেষ বিষয়ে সভায় উপস্থিত
অন্যদের বিতর্ক শুরু হয়ে যায় , যা কি না শেষ পর্যন্ত একটি হট্টগোলে
পরিণত হয়। এই উত্তেজনাকর অবস্থায় নূরে আলম
সিদ্দিকী কাল বিলম্ব না করে সভাস্থল ত্যাগ করেন।
তখন রাত প্রায় ১০;৩০ টা। তাঁকে পৌঁছে দিতে (বঙ্গবন্ধুর বাসায়) গেলেন
আমার অগ্রজ শেখ শাহাব উদ্দিন আহমেদ (৪) সাথে সানু ভাই (সানু মোহাম্মদ শফিউল্লাহ)
(৫). আমি যখন ফিরলাম তখন সম্ভবত রাত ১১টা।
সভাস্থল থেকে আমাদের বাড়ীর দূরত্ব ১ ব্লক।
ঘুম আসছে না - শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে
ভেসে আসা বিচ্ছিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির শব্দ।
ইতিমধ্যে হয়ে ওঠা এই ভীতিকর পরিবেশের মাঝে হঠাৎ ভীষণ শব্দে একটি কামানের
গর্জন শোনা গেল। সময় তখন অনুমানিক রাত
১২টা। সেইসাথে সারা আকাশ জুড়ে জ্বলে উঠছিল আতঙ্কিত করা
ট্রেসার গানের আলো। এর কিছুক্ষন পর থেকে
থেকে বিহারীদের "নারায়ে তকবির - আল্লাহু আকবর" ধ্বনি সেই সাথে মানুষের
আতঙ্কিত কথা-বার্তা ও আর্ত চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম!
ইতিমধ্যে আমার বড় ভাই শাহাবউদ্দিন ফিরে এসে
জানালেন যে উনি ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের সামনে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে জনতার তৈরী
পূর্বের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যেতে দেখেছেন।
সে রাতে আশে-পাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পরিচিত অনেক বাঙালী আমাদের বাসায় এসে
আশ্রয় গ্রহণ করেন।
ক্লান্তি জনিত কারণে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি
জানিনা - খুব সকালে ঘুম ভাঙলে তখনও কিছু গোলা-গুলির শব্দ শুনতে পাই।
আমাদের বাড়ীর শীর্ষে স্বাধীনতার (বাংলাদেশ) ও
সাথে শোকের চিহ্ন স্বরূপ কালো পতাকা (৬) উঠানো ছিল। সেই সাত সকালেই কিছু বিহারী আমাদের বাসায় এসে
বাবাকে উর্দুতে বলেন যে আপনার বাসায় এখনও স্বাধীনতার পতাকা উড়ছে। তারা সেখানে
পাকিস্তানের পতাকা উড়ানোর জন্য বলে। যখন বাবা বলেন পাকিস্তানী পতাকা নেই (পুড়িয়ে
ফেলার কারণে আমাদের কাছে না থাকায় ) তারা একটা পতাকা এনে আমার বাবাকে দেয়। এবং
তাদের মধ্যে থেকে একজন (আলাউদ্দিন) আমাকে বলে, " যদি
তোমরা মাথায় সাদা পট্টি বাঁধ ও নারায়ে তকবীর - আল্লাহু আকবর স্লোগান দাও তাহলে তোমাদের কিছু
করা হবে না।" আমি বললাম "না,
আমরা সাদা পট্টি বাঁধবোনা।"
তখনও চারিদিকে বিক্ষিপ্ত গোলা-গুলি চলার কারণে
কেউ ছাদে ওঠার সাহস পাচ্ছিলো না। এমতাবস্থায় আমি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে স্বাধীন
বাংলার পতাকা নামিয়ে ফেলি। এর কিছু সময় পরে
রেডিও পাকিস্তান এর সকাল ৭টার খবর এ প্রচার করা হলো - গত রাতে পাকিস্তান
সেনাবাহিনী অ্যাকশন শুরু করেছে এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে
ঢাকা ত্যাগ করেছেন।
২৬ মার্চ ৭১ শুক্রবার হওয়ায় দুপুর ১১টা থেকে
নামাজ এর উদ্দেশ্যে কারফিউ শিথিল থাকবে বলে ঘোষণা দেয়া হয় - নামাজের পর বেলা ৩টা
থেকে কারফিউ পুনরায় বলবত হবে। কারফিউ শিথিল হওয়ায় বাসার সামনেই স্থানীয়
মোহাম্মদপুর জামে মসজিদে শুক্রবারের নামাজের জন্য স্থানীয়রা সমবেত হন। কি কারনে
যেন আমি সেদিন নামাজ পড়তে না যেয়ে বাসার দুতলার বারান্দায় বসেছিলাম। তখন দুপুর
১২টা বা ১টা হবে। নামাজ শেষের সালাম
ফিরানোর সাথে সাথে গতরাতের মিটিং এর প্রতিশোধ স্বরূপ মসজিদ সংলগ্ন ঈদগা মাঠ থেকে
সলিমুল্লাহ সাহেবের বাড়ীকে উদ্দেশ্য করে স্থানীয় কিছু অবাঙালী যুবক হাত বোমা
নিক্ষেপ করতে থাকে। তখন আমি বাসার দোতালার বারান্দায় বসা অবস্থায় নীচে রাস্তা দিয়ে
হেটে যাওয়া প্রতিবেশী এক অবাঙালী ভদ্রলোক (জান মোহাম্মদ) কে বললাম যে সলিমুল্লাহ
সাহেবকে আক্রমণ করা হয়েছে- আপনি গিয়ে তাকে বাঁচান। সে তখন আমার দিকে অত্যন্ত ক্ষোভ
ও রক্তাভ চোখে বলল, "যাওনা শালা শুয়ার কা বাচ্চা, আভি
যাকে বাঁচাও!!! ( যাওনা শালা শুয়োরের বাচ্চা, এখন
যেয়ে বাঁচাও) কেননা গতরাতে বার বার নিষেধ করেছিলাম জয় বাংলা বোলোনা, মিটিং
কোরো না।"
ঠিক তখনই খবর পাওয়া গেল সলিমুল্লাহ সাহেবের
বাসা আক্রমন শেষে আমাদের বাসা আক্রমন করা হবে। ইতিমধ্যে দুপুর আড়াইটা বেজে গেছে।
খবর পাওয়ার পর আমরা আমাদের বাসা ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় গ্রহন করি। সাথে সাথে এও
জানা গেল সলিমুল্লাহ সাহেবকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। কিছক্ষন পরে সাদী তার পিতার
রক্ত রঞ্জিত অবস্থায় আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় নিতে আসলে আমরাও তখন বাড়ী ছাড়া
হওয়াতে-আমার বড় ভাই তাকে অন্যত্র রাখার ব্যবস্থা করেন।
২৬ শে মার্চ ১৯৭১ সলিমুল্লাহ সাহেব শহীদ হলেন।
পরবতীতে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে মোহাম্মদপুর ছাত্রলীগের উদ্যোগে
মোহাম্মদপুর জামে মসজিদ সংলগ্ন কায়দে আজম রোডটিকে তাঁর নামে নামকরন করে রাখা হলো
‘শহীদ সলিম্ল্লুাহ’ সড়ক। অনেকে ভাবেন নামটি বুঝি নবাব স্যার সলিমুল্লাহর, প্রকতপক্ষে
তা নয় ।
সাদী আহমেদ
আহ্বায়ক: টরন্টো বাংলা বইমেলা
কানাডা
পাদটিকাঃ
১. সলিমুল্লাহ সাহেব খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী
সাদী মোহাম্মদ এবং নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ এর পিতা। তারা আমার বাল্যবন্ধু ও
ক্রীড়া সঙ্গী। উল্লেখ্য শহীদ সলিমুল্লাহ ১৯৭০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে
কুমিল্লার কসবা ও কচুয়ায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা পূর্বের অস্থির সময়ে
তিনি মোহাম্মদপুর এলাকায় বাঙালী ও অবাঙালীর সমন্বয় কমিটির প্রধান ছিলেন।
২. সিরাজ-উল-ইসলাম তৎকালীন জামাতে ইসলামীর
স্থানীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।
৩. রাফেউদ্দিন - ৭০ এর হঠাৎ করে গঠিত আনজুমানে
মাহাজেরীন পার্টির নেতা ছিলেন। ৭০ এ হাতি মার্কা নিয়ে এই পার্টি নির্বাচনে অংশ
গ্রহন করে।
৪. শেখ শাহাবউদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ এ মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের
প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি ছিলেন। উল্লেখ্য যে মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগ ১৯৬৯ এ
প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. সানু মোহাম্মদ সফিউল্লাহ ছিলেন সলিমুল্লাহ
সাহেবের ছেলে, সাদী
মোহম্মদ ও শিবলী মোহাম্মদ এর বড় ভাই।
৬. ১লা মার্চ ১৯৭১ এ সংসদ অধিবেশন স্থগিত
ঘোষনার প্রেক্ষিতে সারা দেশে যে আন্দোলন শুরু হয় তাতে যারা শহীদ হন তাদের স্মৃতি ও
শোক জ্ঞাপনের জন্য কালো পতাকা উড়ানো হয়েছিল।
সাদী আহমেদকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন একটা তথ্য দেবার জন্য। আমার শ্বশুর বাড়ি সলিমুল্লাহ রোডে এত বছর জানতাম নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নামে এই সড়কটি । সত্যি এই লেখাটা না পরলে এই ভুল তথ্যই নিয়ে মারা যেতাম। আপনাকে আবারও ধন্যবাদ!! বিশেষভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আলকরেখাকে েমন একটা মুল্যবান তথ্য সমৃদ্ধ লেখা প্রকাশ করার জন্য
ReplyDeleteসাদী আহমেদ আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো এমন একটি সত্য আমাদের কাছে উদ্ঘাতন করার জন্য। আমি সত্যি জানতাম না এর ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ করেছি কিন্তু দেশকে জানি না। আলকরেখা আমাদের সবার প্রিও হয়ে উঠেছে এই বিদেশের মাটিতেও। কারন আলকরেখায় এই সব ইতিহাস লেখা হয়। সাদী আহমেদ আপনি ভাল থাকবেন আরো লেখা পাব আশা করি
ReplyDeleteআলোক রেখার প্রতুশ্রুতি দীপ্ত প্রজ্ঞার অন্বেষণে এবং এটা শুধু সাহিত্য বিষয়ক নয় একটি সংগ্রহশালা ।আজকে ১৯৭১ এবং সলিমুল্লাহ সড়ক-সাদী আহমেদের লেখা তাই প্রমান করলো, ধন্যবাদ সাদী আহমেদ এমন বিস্তারিত তথ্য ও ইতিহাস লেখার জন্য , ভাল থাকবেন।
ReplyDelete