"আমেরিকার প্রথম
দিন"
নীপা লায়লা
সবাই বলে, আমেরিকা নাকি স্বপ্নের
দেশ কিন্তু সেই স্বপ্নের দেশে আসার সময় আমি চূড়ান্ত মনখারাপ নিয়ে ঘর থেকে
বেরিয়েছিলাম।ভিসা পাওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই এই মনখারাপ এর শুরু, কারণ সারাক্ষণ মনের
মধ্যে খচখচ খচখচ খচখচ করতেই ছিল এই ভেবে যে 'আমার মতন এমন সাংঘাতিক হোমসিক মানুষ
কিভাবে এতো দীর্ঘদিন সবাইকে ছেড়ে ঘরের বাইরে এবং দেশের বাইরে থাকবো'! মাস্টার সাহেব বলেছিলেন,'মানুষ পারেনা এমন কাজ নেই,দেখো, সয়ে যাবে সব'!আমিও সেই সয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় মনখারাপ নিয়েই ঘর ছেড়েছিলাম।
কিভাবে এতো দীর্ঘদিন সবাইকে ছেড়ে ঘরের বাইরে এবং দেশের বাইরে থাকবো'! মাস্টার সাহেব বলেছিলেন,'মানুষ পারেনা এমন কাজ নেই,দেখো, সয়ে যাবে সব'!আমিও সেই সয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় মনখারাপ নিয়েই ঘর ছেড়েছিলাম।
আমাদের পথের সাথী আমাদের ছোট বেয়াইনকে নিয়ে পথে সময় বেশ ভালোই কেটেছে।আড্ডায়
আর গল্পে গল্পে কি করে কি করে যে আমাদের প্রায় একত্রিশ ঘণ্টার জার্নি কেটে গেলো তা
আমরা একবিন্দু টের পাইনি।নানান জন নানান কথা বলে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো কিন্তু আমরা
আমেরিকায় ঢুকেছি একদম ঝামেলা বিহীন ভাবে।টেরই পাইনি যে,আবুধাবিতেই আমাদের একদম স্মুদলি আমেরিকান ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স
হয়ে গিয়েছিলো।প্লেন থেকে নেমেই সরাসরি লাগেজ নিয়ে যখন এয়ারপোর্ট ছাড়ছি তখনও ভাবতে
পারিনি একফোঁটা ঝামেলা না করেই কখন আমরা আবার আমেরিকান ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস
ক্লিয়ারিং পেয়ে গেলাম!বারবার এয়ারলাইন্স এর অফিসারের সাথে কথা বলে কনফার্ম হলাম
আমরা সবকিছু আবুধাবিতেই ক্রস করে এসেছি।এটি নাকি নতুন সিস্টেম চালু হয়েছে!শুনে
আমরা যেমন হতভম্ব তেমনি হতভম্ব আমাদের মেয়ে-জামাইরা।ওরা এইসব ক্লিয়ারেন্স এর জন্য
সময় ধরে আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে পিক করবে ভেবে রেখেছিলো তারপর আমার ফোন পেয়েই ওরা
হুরমুর করে ঘর থেকে রওনা হয়েছে।এরমাঝেই বোস্টন থাকা বন্ধু আমীরকে নক করে আর কল
দিয়ে বিরক্ত করেছি এই নতুন সিস্টেম এর কথা বলে।আমীর নিজেও খানিক অবাক হয়েছে শুনে
কারণ এই কিছুদিন আগেই মাত্র ও নিজে দেশ থেকে ফেরার সময়ও এই নতুন সিস্টেম পায়নি।এই
সিস্টেম নাকি শুধুমাত্র 'ইতেহাদ' এয়ারলাইন্স এর
পেসেঞ্জারদের জন্যেই আপাতত চালু হয়েছে।ট্রানজিট কান্ট্রিতেই নাকি ধীরেধীরে সব
এয়ারলাইন্স এর পেসেঞ্জারদের জন্যেও এই সিস্টেম চালু হবে!
বেয়াইন আগে থেকেই বারবার করে বলে রেখেছিলো যেন মেয়েকে দেখে আমি কান্নাকাটি না
করি কিন্তু ওনার কথা রাখতে পারিনি।দীর্ঘদিন পর মেয়েকে(অন্তঃসত্ত্বা)দেখেই ওকে
জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলেছি।সাথে সাথে উপলব্ধি করলাম, আমার সবটুকু মনখারাপ
যেন আমি কোথায় হারিয়ে ফেলেছি।গল্প করতে করতে দুই মেয়ে-জামাই সহ যখন ঘরে ফিরছিলাম
তখন কেন যেন একবারও মনে হয়নি এটি আমার কোনো অচেনা দেশ!কি আশ্চর্য কথা!যেন সবকিছু
আমার কতো চেনা!হয়ত টিভিতে ভীষণ প্রিয় 'ডালাস' সিরিজ দেখে দেখেই এই
ডালাস শহর আমার মনে গেঁথে ছিলো তাই এমন লেগেছে।
এতো সুন্দর সাজানো গোছানো ঘরবাড়ী |
মেয়ের ঘরে এসে ওর এতো সুন্দর সাজানো গোছানো ঘরবাড়ী দেখে আমি আর ওর পাপা মুগ্ধ।কখন যে আমাদের ছোট্ট পুতুলের মতন 'ছুটু' এতো বড় সংসারী হয়ে গেছে তা আমরা বুঝতেই পারিনি।পূর্নমাস গর্ভবতী মেয়েটা আমার কেমন সুন্দর করে যে ছবির মতন করে নিজের ডুপ্লেক্স ঘরবাড়ী গুছিয়ে রেখেছে তা দেখেই আমার চোখ ফেঁটে জল নেমেছে!যে মেয়ে নিজের ঘরে কখনো এক গ্লাস পানি ঢেলে খায়নি সে মেয়েই এখন চাকরী করেও সবকিছু ছবির মতন করে গুছিয়ে রেখেছে।সময় মানুষকে কতো বেশী বদলে দেয়,গুছিয়ে নেয়!
আমরা গোসল করে ফ্রেশ হতে হতে আমাদের আরেক মেয়ে-জামাই গিয়ে আমার বড় বোনকে নিয়ে
এলো।বোনকে দেখেই ওকে জড়িয়ে ধরে দুইবোন মিলে আরেকচোট কাঁদলাম।আমার কান্না দেখে
বেয়াইন আমার হাসেন আর বলেন'কাঁদুনি বুড়ি'!
কিছু পেতে হলে কিছু ছাড় দিতে হয়, এই কথা একদম সত্যি! দেশ ফেলে, সবাইকে ফেলে এতো দূর দেশে এসে এখন বোন আর মেয়ে-জামাইদের পেয়ে এই কথাই বারবার
মনে হচ্ছে।বহুদিন... কতো দিন তা মনেই পড়ছে না এখন, আজ আমার পাঁকা রাঁধুনি বোনের হাতের রান্না খেয়ে মনে হয়েছে যেন কতো কাল পরে
মায়ের হাতের রান্না খেলাম।বোন আমার গাড়ির পেছন বোঝাই করে রান্না নিয়ে এসেছিলো।
মেয়ে বললো এই কাজ নাকি ও সবসময়ই করে।মেয়ের আরামের জন্যেই নিজের কাজ করেও প্রায়
প্রায়ই রান্না করে ডেকচি পাতিল বোঝাই করে খাবার দিয়ে যায় ও!এই জন্যেই বুঝি বলে,'মায়ের বোন খালা মায়ের
চাইতেও ভালা'!আমার বাচ্চাদের কাছে
আমি হলাম 'মা' আর আমার বোন হোলো 'ভালোমা'!
খাওয়া দাওয়ার পর বোনকে নিয়ে এক মেয়ে চলে গেলো আর আমাদের ছুটু আর শোভন আমাদের
নিয়ে ওদের কমপ্লেক্স ঘুরে দেখাতে নিয়ে চললো।হেঁটে হেঁটে জিম,সুইমিংপুল, গার্ডেন সব দেখে আমরা
ঘরে ফিরেছি।বাইরে বেশ শীত শীত আরাম আরাম ওয়েদার অথচ আমার প্রাণের শহর ঢাকা বৈশাখী
গরমে পুড়ে যাচ্ছে।এখানে আগামীকাল পহেলা বৈশাখ। কাল বোনের ঘরে আমাদের পহেলা বৈশাখী
দাওয়াত।
অল্পকিছু দেশ ছাড়া পৃথিবীর কোথাও যে বাথরুমে 'পুশ শাওয়ার' নেই তিক্ত অভিজ্ঞতা
থেকেই তা জানি তবুও দেশ ছাড়ার আগে ভাই ইফতির বদনা সংক্রান্ত স্ট্যাটাস পড়ে
মোটামুটি ভাবে আতংকিতই ছিলাম।কিন্তু মেয়ের ঘরে এসে বাথরুমে লাল টকটকে নতুন বদনা
দেখে সেই আতংক কেটে গেছে কিন্তু বদনার গায়ে লাগানো ৫ ডলারের ট্যাগ দেখে গলা থেকে
ঘোঁৎঘোঁৎ করে নিজের অজান্তেই কিছু শব্দ বেরিয়ে এসেছে, 'হায়রে বাঙালির বদনা, তুমি কতো মহামূল্যবান '!
ঐযে যা বলছিলাম,কিছু পেতে হলে কিছু
ছাড় দিতে হয়!দেশ ছেড়ে, প্রিয় সব আপনজন ছেড়ে, নিজের দীর্ঘদিনের
সাজানো গোছানো সংসার ছেড়ে আজ এখানে আমি মেয়ে-জামাইদের আর বোনকে পেয়ে সাথে এই লাল
টকটকে মহামূল্যবান 'বদনা' পেয়ে বেশ ভালোই আছি!!
মেয়ে বলেছিলো,মা যতদিন আমার কাছে
আছো ততদিন তোমার ফেইসবুকিং করা বন্ধ, শুধু ঘুরে বেড়াবা আর সারাক্ষণ আনন্দফূর্তি করবা আর খুশী থাকবা আর একদম নিয়মমতো
ওষুধ খাবা আর সুস্থ থাকবা।কিন্তু এই কথা বলে ঘুমাতে যাবার আগে আমার ফোন আর
ল্যাপটপে মেয়ে ওয়াইফাই কানেক্ট করে দিয়ে গেলো আর সেইসাথে দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে
নেমে যেতে যেতে বললো, তুমি ফোন নিয়ে একদম
চিন্তা করবা না মা,আমি কাল অফিস থেকে
ফেরার সময় তোমার জন্যে নেট সহ সিমকার্ড নিয়ে আসবো! আমার সোনার মেয়ে!
ঘড়িতে বাজে ভোর ৬:৫৯!ব্ল্যাঙ্কেটে ডুব দিয়ে সবাই ঘুমে অচেতন! এইমাত্র আমি দুই
ঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠলাম।দোতলার বারান্দা থেকে আমেরিকার ভোর হওয়া দেখছি।বেশ শীত
এখানে।মন উদাস করা অসংখ্য পাখির ডাকে চারিদিক অস্থির!
আমি ভালো আছি!
ভালো থেকো তোমরা!
ভালো থেকো প্রিয় বাংলাদেশ!
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা!
প্ল্যানো,টেক্সাস।
১৪ই এপ্রিল '১৭
http://www.alokrekha.com
আমি যখন প্রথম প্রবাসে আসি আমার মনের অবস্থায় এই রকম ছিল। আমি লেখক নেই তাই লিখতে পারি নি। কিন্তু "আমেরিকার প্রথম দিন"
ReplyDeleteনীপা লায়লার হুবুহু আমার মনের কথা লিখেছেন। খুব ভালো লাগলো পড়ে। ভালো থাকবেন।আরো লিখবেন এই প্রবাসের কথা। আলোকরেখাকে অনেক ধন্যবাদ এমন লেখা প্রকাশ করার জন্য।
"আমেরিকার প্রথম দিন" নীপা লায়লার লেখাটা পরে কি যে ভালো লাগলো । যেন আমি আমার কথাগুলোই পড়ছি। এখানেই লেখকের সার্থকতা। আলোক রেখা সত্যি একটা সংগ্রহ শালা। সব রকমের লেখা পাই। এই ধরণের আরো লেখা আশা করি। লেখক কে অনেক ভালোবাসা। পবর্তী লেখার প্রতীক্ষায় থাকলাম।
ReplyDeleteনীপা লায়লা "আমেরিকার প্রথম দিন" ভালো লাগলো লেখা। এ যেন আমাদের কথা। লেখক তার লেখায় এই প্রবাস জীবনের চালচিত্র তোলে ধরতে চরিতার্থত হয়েছেন। আলোক রেখায় সব রকমের লেখা পাই বলেই পাঠকের কাছে জনপ্রিয়। এই ধরণের আরো লেখা আশা করি। লেখক কে অনেক ভালোবাসা। পরবর্তী লেখার প্রতীক্ষায় থাকলাম।
ReplyDeleteআমিও যখন প্রথম প্রবাসে আসি আমার মনের অবস্থায় এই রকম ছিল। "আমেরিকার প্রথম দিন"নীপা লায়লার হুবুহু আমার মনের কথা লিখেছেন। খুব ভালো লাগলো পড়ে। ভালো থাকবেন।আরো লিখবেন এই প্রবাসের কথা। আলোকরেখাকে অনেক ধন্যবাদ এমন লেখা প্রকাশ করার জন্য।
ReplyDeleteনীপা লায়লা "আমেরিকার প্রথম দিন" ভালো লাগলো লেখা। এ যেন আমাদের কথা। লেখক তার লেখায় এই প্রবাস জীবনের চালচিত্র- আলোক রেখায় সব রকমের লেখা পাই বলেই পাঠকের কাছে জনপ্রিয়। এই ধরণের আরো লেখা আশা করি। লেখক কে অনেক ভালোবাসা। পরবর্তী লেখার প্রতীক্ষায় থাকলাম।
ReplyDelete