চমকিত চমক
রোকসানা লেইস
স্থির চোখে তাকিয়েছিল মৌমি। চমকটা ভিতরে ঢেউ তুলছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ পাচ্ছে না। হাত পা নাড়িয়ে শরীর দুলিয়ে চিৎকার করে উঠাই স্বাভাবিক ছিল। ইচ্ছে টাও সেরকমই করছে, প্রাণ খুলে চিৎকার করে ডাকার। কিন্তু একদম উল্টা চুপ হয়ে স্থির চোখে দেখছে।
সৌম এখানে! প্যারিসে!
এই চিন্তাটা মাথার প্রতি কোষে রিনিঝিনি সুর বাজাচ্ছে। ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভিতর এমন একটা ঝিলিক দিয়ে উঠে ছিল। হৃদপিন্ডটা যেন বেরিয়ে পরবে।
ওর মুখটা প্রায় হা হয়ে শব্দ বেরিয়ে আসছিল। মূহুর্ত মাত্র তারপর নিজেকে সামলে নেয়। শরীরে ভিতর শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হচ্ছে টের পায় উত্তেজনায় ঘামছে শরীর। আবেগ চাপা দেয়ার যন্ত্রনা হচ্ছে শরীরে।
থলথলে হাতের মধ্যে নিজের হাতটা টের পায়। সেই সাথে একটা টান আসে হাত বেয়ে শরীরে ঝাঁকুনি লাগে। মুখের কাছে মুখ ঝুঁকিয়ে এনে বলে, বউ হাঁটো না কেন? কথার সাথে থুথুর ছিটা মুখে লাগে।
বিরক্তিতে মনটা ভরে উঠে মৌমির। ওর এই জায়গা ছেড়ে নড়তে ইচ্ছ করছে না। সামনের দোকানে দাঁড়ানো ঐ দেহটা থেকে চোখ সরাতে চায়না সে। ওকে হারাতে চায় না। কিন্তু কথাও বলতে পারছে না। জগৎদ্বলের মতন লোকটা ওকে পাহাড়া দিয়ে রাখছে।
ওকে পাহাড়া দিয়ে ওকে আগলে রাখা স্বামীর অধিকার। ওর দিকে যেন কারো নজর না পরে। ও কারো সাথে কথা বলবে, সে প্রশ্নই আসে না।
সৌম পিছন ফিরে আছে ও মৌমিকে দেখেনি। যদি দেখতো তা হলে ইশারায় কথা বলা যেত।
মৌমি কি করবে বুঝে পায় না। রেহান ওর হাত ধরে টানছে আবার। ওর হাতের ঘাম চটচট করছে কব্জি জুড়ে। আবার বলে, ও বউ চলো ইখানো খাড়াই থাকতায়নি হারা দিন।
আমি আর হাঁটতে পারছি ন। আর খুব পিপাসা লাগছে। একটু পানি নিয়া আসেন। আমি এখানে থাকব।
আইচ্ছ আইচ্ছ খাড়াও। কোন দিকো নইড় না। ফানি লইয়া আই আমি।
চার পা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে রেহান। ও বউ লইলাও আমার লগে বেশী দূর না তো। তিনখান দোকানোর ফরে, ফানির দোকান ।
আপনি যান না নিয়া আসেন। আমি পানি না খেয়ে হাঁটতে পারব না।
আইচ্ছা তে আইচ্ছা। আয়রাম ( আসছি) তুমি ওখানোই থাইকো।
রেহান যায় ঘুরে ঘুরে মৌমিকে দেখে।
মৌমি স্থির চোখে এখনও সৌমকে দেখছে। কি করছে ওখানে। হাঁটা দিলে ওকে আর খুঁজে পাবে না। ডাকবে কিন্তু মুখে যেন শব্দ আসছে না। স্বপ্নে যেমন কথা বলা যায় না, তেমন লাগছে।
আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি! ওরা যে প্রতিজ্ঞা করে ছিল কোন এক বিকালে, একা কেউ আইফেল টাওয়ার দেখতে যাবে না । ল্যুভ মিউজিয়ামে মোনালিসার হাসি দেখে রহস্য উদ্ধার করবে হাতে হাত রেখে। এত গুলো বছর পরে, প্যারিসে আজ সেই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার দিন নাকি। ভিতরের চমকে অস্থির লাগছে মৌমির। জীবন মোনালিসার হাসির চেয়েও রহস্যময়।
নিজের হাতে চিমটি কাটে মৌমি। পাঁচ পা দূরে দাঁড়ানো মানুষটাকে সে কি ভাবে বলবে, এদিকে দেখো আমি এখানে। ওর কণ্ঠরুদ্ধ, শব্দ সব বন্ধ হয়ে আছে।
একদল মানুষ আসছে তারা এসে সৌমকে ঢেকে দেয়ার আগে ও এক ঝটকায় নিজেকে লম্বা শরীরটার কাছে নিয়ে আসে। ধাক্কা লেগে যায় সৌমর সাথে। মাথা ঘুরিয়ে মৌমিকে দেখে, ওর চোখও স্থির হয়ে যায় মৌমির মুখে।
এক পলক! তারপর পৃথিবীর যাবতিও বিষ্ময় নিয়ে বলে, মৌমি তুমি এখানে?
তুমি এখানে মৌমি পাল্টা প্রশ্ন ছূঁড়ে দেয়।
আমি লন্ডনে থাকি ঘুরতে এসেছি।
আমিও।
একা?
না
ও আচ্ছা তোমার স্বামীর সাথে. পরিচয় করিয়ে দিবে না?
পাগল নাকি?
কেন, এখন তেমন কিছু মনে করে না মানুষ।
কথা বলা যাবে না। মৌমি দেখে রেহান আসছে এক পা এক পা করে পিছায়
ও আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি।
ব্উ এই লও ফানি খাও। বোতলের ঢাকনা খুলে এগিয়ে ধরে মৌমির দিকে। সাথে বলতে থাকে, যে লম্বা লাইন লাগছে, মনে হইছিল সারা দিন লাগব এক বোতল ফানি কিনতে। যে টেনশন লাগছিল।
দুমিনিটও পার হয়নি অথচ রেহান অভিযোগ করছে, লম্বা লাইনের। মৌমিকে চোখের আড়াল করতে ওর যত ভয়। মৌমিকে হারিয়ে ফেলার ভয় রেহানের।
মৌমি মুখ উঁচু করে পানি পান করে। চোখের কোন দিয়ে সৌমকে দেখে।
সৌম রেহানের পিঠে হাত রেখে বলে, ভাই আপনি বাংলাদেশী।
হয় ভাই হয় বাংলাদেশী। আপনি?
আমি ও বাংলাদেশের।
ইখানো থাকুননি?
না লন্ডন থাকি
ভালা আমিও লন্ডন থাকি ফ্যারিস আইছি বউরে লইয়া বেড়ানিত।
বাহ বেশ তো
কদিন থাকবেন?
আইজওই ফিরমু
বাহ বেশ দুপুরের খাওয়া হয়ে গেছে আপনাদের?
না ওখনও খাইছি না।
চলেন, আপনাদের খাওয়াই এক সাথে খাই।
না না ইতা কিতা মাতইন।
আপনার কথা শুনে খুব ভালোলাগল। মনে হলো পুরো বাংলাদেশটা এখানে পেয়ে গেছি। প্রাণটা ভরে উঠল। কতদিন বাংলা কথা শুনি না।
ইতা কিতা কইন লন্ডনও ওখন বাংলা মাত শুনা যায় না ইটা কোন কথা হইলনি। আমরার তো ইংলিশ মাতন লাগে না। চাইরও বাইদি বাঙালি।
কোন এরিয়ায় থাকেন আপনি?
ব্রীক লেইন
ও আচ্ছা শুনেছি ওটা লিটিল বাংলদেশ
ওয় ঠিকওই হু নছইন।
আমি কেমব্রীজ ইউনির্ভাসিটিতে আছি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাস এলাকায় থাকি।
ও আইচ্ছা আইচ্ছা, খুব ভালা। আর বাঙালি নাইনি।
হয়তো আছে কিন্তু দেখা হয়নি এখনো।
আরেকটা সমস্যা আছে দেখা হইলেও চিনতা না । ফুলাফান, কথায় পোশাকে আশাকে ফুরাদমে ইংরেজ।চুল ব্লণ্ড কইরা, কানো নাকো রিং লাগাইয়া, ফুরা জিপসি তারা। আমরা যেলা বাংলায় মাইত্তা আরাম পাই তারা বাংলা কেয়ার করে না। না কথায় না পোশাকে। উচ্ছনে গেছে সব। আমি বাইশ বছর লন্ডনো আছি। মাতৃভাষা ভুলি নাইরে ভাই। বাইরে আইলে প্যাণ্ট পাতলুন লাগাই ঘরো গিয়াই লুঙ্গি, আমার আরামোর ড্রেস।
সমস্যা ছেলে মেয়েদের না ভাইসাব। সমস্যা তাদের জন্মের
সৌমর মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই রেহান বলে উঠে,
ইতা কিতা কইন। সব কিতা জারজ না কিতা। রেহান গরম হয়ে উঠে। ওর চোখ বড় হয়ে যায়। কপালে অনেকগুলো ভাঁজ ফুটিয়ে বলে আমি তারার বাফ মারে চিনি। অনেকে ভালা পর্দানসিন, ধামিক মানুষ। কিন্তু ..বাচ্চারার রঙ ঢঙ সামলাইতা ফারইন না।
আমি সে ভাবে মিন করি নাই ভাইসাব, আমি বলতে চাইছি। ওরা যে জায়গায়, যে দেশে জন্ম নিয়েছে। বা ছোট থেকে বড় হয়ে উঠেছে। কথা বলার সাথে যে ভাষা যে কালচার চোখের সামনে দেখে, বন্ধুদের সাথে মিশে পেয়েছে তার প্রভাবে তারা নিজেদের মতন একটা জীবন যাপন করে।
এখন যারা পড়ালেখা করছে ইউনিভার্সিটি কলেজে তারা ওনেক টেলেন্ট, ব্রিলিয়ান্ট বাচ্চা। তারা আগামী দিন লন্ডনের শাসক হবে। অফিস আদালতে বড় বড় পদে তারা কাজ পেয়ে যাচ্ছে।
দেশ থেকে আসা বাবা মা সে জায়গায় পৌঁছাতে পারেননি। কিন্তু তাদের সন্তানদের পৌঁছে দিয়েছেন কষ্ট করে।
রেহান বড় দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে, কথা ঠিক। আপনি ঠিকওই কইছন। ওয় আমরার টিউলিপ, রুশনারা আলী ইলান অনেকেই ওখন বড় বড় পদো আছোইন।
আমি বাবার লগে সতরো, বছর বয়সো লন্ডন আইছি। পঁচিশ বছর ধরে আছি। কিছু দিন ইস্কুলো গেছি ইংলিশ শিখনের লাগি। ভালা ফারছিনা। বেশী কুন্তা শিখা হয় নাই। খানা বানানির কাম শিখা শুরু কললাম।
সারা জীবন মারে, চাচীরে দেখছি উন্দালোর ( চুলা) ফারো রান্দইন ( রানআ করেন)। আর লন্ডন আইয়া আমি ঢুকলাম উন্দলর ফারো। ফয়লা ফয়লা চোক্ষুর পানিতে বালিশ ভিজাইছি। পিয়াজ কাটনের সাথে কানছি কাউন্টারো খাড়াইয়া। আদ্রো হয়ে উঠে রেহানের গলা। আস্তে আস্তে অভ্যাস হইগেছি। শরমিন্দা ( লজ্জা পাওয়া) হইয়া থাকতাম। কেউরে কইতাম না দেশে গেলে কিতা কাম করি। বড় বড় ভাওতাবাজী গফ কইতাম।
ওখন আমি নিজোই রেস্টুরেন্টোর মালিক। দেশ থাকি নতুন ফুয়াইন্ত আইলে কাম দেই মায়া করি তারারে, কই কামের লগে পড়ালেখাও করো। নাইলে এই দেশে ঠাঁই নাই।
বাহ্! খুব ভালো আপনি এখন নিজেই মালিক। এটাও তো অনেক বড় এচিভমেন্ট।
হয় হয় লন্ডনোর মাটির উফরে নিজের মালিকানার হোটেল। বড় বড় মানুষ আইন; খানা খাওয়াই তারারে। ইটা কম কিতা।
অনেক বড় অনেক বড় কাজ। অই রিয়েলি এপ্রিসিয়েট। ইউ আর ডুইং গ্রেট। দেশের কমিউনিটির মানুষকে বিদেশে সাহায্য করা। অনেক বড় হেল্প।
রেহানের পিছনে দাঁড়িয়ে মৌমি শুনছিল ওদের কথাবার্তা আর মায়াবি চোখে তাকিয়ে ছিল সৌমর মুখে। ইচ্ছে ছিল, জীবন ভর ঐ মুখ দেখার।
অথচ জীবনটা কেমন উল্টাপাল্টা হয়ে গেল। হার্ট এ্যাটাকে মাত্র ছাপান্ন বছর বয়সে বাবা মারা গেলে, সাজানো ছিমছাম জীবন পালহীন, হালহীন ঢেউয়ে দোলা ডিঙ্গি নৌকা হয়ে গেল। আর সে দোল খাওয়া নৌকা থেকে সবার আগে মৌমি কে নামাতে ব্যস্ত হয়ে গেল পরিবারের সবাই। মৌমির একটা বিয়ে হওয়া হঠাৎ খুব জরুরী হয়ে উঠল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেন্ড ইয়ার ফ্যাইনাল হওয়ার আগেই রেহানের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। বড়মামা প্রস্তাবটা নিয়ে আসলে মা রাজী হয়ে গেল। মৌমির মতামতের কোন দাম নাই। যদিও সবাই জানত, ওরা সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকে খুলনা থাকার সময় সৌম আর মৌমির মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে। বাড়ির কেউ তা নিয়ে কখনো আপত্তি করেনি। বরং মাঝে মাঝে মৌমি সৌম নাম নিয়ে খ্যাপানোর চেষ্টা করত। মাও তাতে যোগ দিত।
পাশাপাশি বাড়ি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আর প্রফেসরের বাড়ির মধ্যে অবাধ যাতায়াত ছিল। সৌম আর ওর তিন বোন মৌমি আর ওর বড় ভাই, ছোট বোন সবাই খুব বন্ধু ছিল।
সৌমর বড় বোনের বিয়ের সময় কত আনন্দ করেছিল সবাই মিলে। মিতা আপা, ওকে কাছে ডেকে বলেছিল, তুই কবে এমন বউয়ের সাজে আমাদের বাড়ি আসবিরে মৌমি। মৌমির বড় ভালো লেগেছিল কথাটা।
কোন বাঁধা ছাড়া ওদের বিয়েটা হবে। দুটো পরিবার আরো কাছাকাছি আসবে আত্মীয়তার সম্পর্কে এমন সব ভাবনা স্থির হয়েছিল মনে। যা নিয়ে কোন উৎকণ্ঠা ছিল না কখনো। মৌমি ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করত সৌমর সাথে, কেউ বাঁধা দিয়ে বলত না এখন না পরে বলো।
পুরো স্কুল কলেজের সময়টা খুলনায় কাটিয়ে মাত্র দুবছর ঢাকায় এসেছিল মৌমির পরিবার, বাবার চাকরি বদলের কারণে। খুলনার সময়গুলো বড় সুন্দর ছিল। এত তাড়াতাড়ি সব অন্য রকম হয়ে যাবে কেউ ভাবেনি। তিনদিনের আয়োজনে মৌমির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। শুধু মৌমি পাগলের মতন সৌমকে খুঁজছিল। মিতা আপাকে খুঁজছিল । ঢাকায় ওনার ফোন নাম্বারটাই ওর কাছে ছিল।
মিতা আপার বাসায় থেকে বোয়েটে পড়ছে তখন সৌম । কিন্তু ঠিক সে সময়ে তারা কেউ দেশে ছিল না। মিতা আপা আর উনার হাজব্যান্ডসহ সৌমর পরিবার বেড়াতে গেছে সিঙ্গাপুর।
মৌমিতার বিয়ের আগে কলেজের কোয়ার্টার ছেড়ে মামার উত্তরার বাড়িতে উঠল সবাই। মৌমির বিয়ের পর তাকে নিয়ে শশুড় বাড়ির লোকজন সিলেটে চলে গেল।
ভিসার জন্য এ্যাপ্লাই করে মাস খানেক পরে রেহান চলে গেল লন্ডন।
একটি তারণ্য, একটি স্বপ্ন, একটি বালিকা জীবন ঘোমটার আড়ালে ঢাকা পরে, বউ হয়ে জীবন কাটাতে লাগল। মৌমির মনে হতে থাকল তার নিজের ভাবনার আর কিছু রইল না। স্বপ্ন সাজানোরও কিছু নাই।
রেহানকে দেখে ওর একটুও পছন্দ হয়নি প্রথম দিন থেকে। কত বড় একটা মানুষ এর সাথে সারা জীবন কাটাতে হবে এই ভেবে বিভিষিকার মতন লাগত। সৌমর মুখ যেন কিছুতেই মনে না পরে তার জন্য মৌমি কেবল ঘুমের চেষ্টা করত। প্রয়োজন না থাকলেও ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকত। জেগে থাকার সময় টুকু কাটাত নির্লিপ্ততায়।
রেহান এবং রেহানের বাড়ির মানুষগুলো ভালো, খুব মায়াবি সবাই। মৌমিকে আদরে কোলে বসিয়ে রাখতে চায়। শাশুড়ি, ননদ অন্য আত্মিয় স্বজন সারাক্ষণ ভালোবাসায় আদরে দেখ ভাল করতে চায় মৌমির যেন কোন কষ্ট না হয়। অথচ ওদের এত ভালোবাসায় মৌমির মনে হয় কোথায় যেন এক বিশাল গ্যাপ এই মানুষগুলোর সাথে ওর। ওদের মায়বি ব্যবহার ওর সাথে যায় না। মৌমি হাসতে পারে না ওদের সাথে আনন্দে মাততে পারে না। ও শুধু নিজের মতন একা হয়ে যায়। কিন্তু তাদের সব ভালো ব্যবহার মৌমির কাছে কেমন বিষাদ মনে হয়। ও নিজের মনে সুস্থির হতে পারে না।
প্রতিদিন রেহান ফোন করে ওর খবর নেয় ঘণ্টা ধরে ওর সাথে কথা বলে। মৌমি র্নিলিপ্ত, হু হা করে। রেহান একা একাই কথা বলে যায়। বউ নিজের যত্ন নিও। ভালো করে খাওয়া দাওয়া কইরো, ও বউ, কথা কও । মাতো তে ( কথা বলো) মাতো না কেনে। ওহো, বুচ্ছি আমার মাত বুঝ না তুমি। ডোন্ট ওয়ারি, শিখিলাইবাই । সিলেটি ভাষা বড় মধুর গো প্রাণ সজনী।
হয় তো তাই হয় তো লোকটার মনে অনেক ভালোবাসা। কিন্তু মৌমি নিতে পারে না।
মৌমির নিজের যত্ন নিতে ইচ্ছা করে না। খেতে মন চায় না। কথা বলতেও ভালো লাগে না। অথচ সৌমর পাশে বসে পাখির মতন কলতানে মাতিয়ে রাখত মৌমি। কত আনন্দ কত স্বপ্ন গাঁথা, ঝর্ণার মতন প্রবল আনন্দধারা।
একদিন ননদ বলল, ভাবি তুমি খাওনা কেনে। তোমার ওজন তো কমের দিন দিন। দেখি ইখানো আও। স্কেলের উফরে খাড়াও।
না, না ওজন নিতে হবে না আমি ঠিক আছি। মৌমি প্রবল প্রতিবাদ করে।
না তুমি ঠিক নাই। উঠো মেশিনের উফরে উঠো। শাহিনা ওর ননদ পাখির মতন হালকা মৌমিকে দুহাতে তুলে ওজন মেশিনের উপর দাঁড় করিয়ে দেয়। তারপর মহা ভয়ে, কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে থাকে। ইয়া মালিক ,
ইয়া আল্লাহ ইতা কিতা গো! আমি শেষ আমি শেষ। ভাইসাবে আমারে মারিলাইবা। তোমার কাপড়ের ওজন তোমার থাকি বেশী ভাবি। লও খাওয়ার টেবিলও। ওখন আমি যেতা দিমু সব তোমার খাওয়া লাগব। আমারে দোষী কউরো না গো ভাবি। ভাইসাবে আইয়া যে গরম হইবা তখন তুমি সামলাইতাই ফারতায় না। খাও ভালা করি খাও মোটা তাজা থাকো।
খাওয়ার খাইয়ে ওর ওজন বাড়ানোর জন্য ওরা অস্থির হয়ে উঠে। ঘুরে ফিরে এসে জিজ্ঞাস করে কি জন্য মন খারাপ। মৌমির উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই জবাব দেয়। বুঝছি ভাইসাবের লাগি মন খারাফ। লও ফোন, সোয়ামিরে ফোন দিয়া মনের কথা কও। মাত মাত ভালালাগব নে। ভাইবাস আমার জানের জান, ভাইসাব আমার প্রাণের প্রাণ ভাইসাবেরে না দেখিলে বাচে না পরান.......ওরা আপন মনের আনন্দে হাসে গান গায় ,যখন তখন। অথচ মৌমি কোন প্রাণ পায় না।
মৌমির হাতে সেল ফোন তুলে দিয়ে শাহিনা দরজা লাগিয়ে চলে যায়।
মৌমি বারবার একটা ফোন নাম্বার তুলে সেল ফোনের স্ক্রীনে তারপর আবার মুছে দেয়। খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আর কি হবে বলে এই ভাবনায় থেমে যায়। একরাশ অভিমান ওর চোখ মুখ লাল হয়। কার ওপর অভিমান। মার উপর। ভাই বোনের উপর বড় মামার উপর নাকি বাবার উপর। যে হুট করে মরে গিয়ে বদলে দিল মৌমির জীবন।
হঠাৎ মৌমি এই প্রথম নিজে থেকে রেহানের হাত ধরে। ওকে টেনে নিয়ে, বলে চলেন। গরমে আমার মাথা ধরে যাচ্ছে।
যাইতাইনি আচ্ছা চলো। রেহান তুমুল কথাবার্তা বলতে থাকা সৌমর উপস্থিতি ভুলে যায়। যত্ন করে মৌমির পিঠ জড়িয়ে ধরে ছাতা মেলে ছায়ায় মৌমিকে আড়াল করার চেষ্টা করে, সূর্যের তাপ থেকে।
একপাশে আইফেল টাওয়ারের উঁচু চূড়া অন্যদিকে ল্যুভ মিউজিয়ামের দালান মাঝে সেইন নদীর উপর পন্ট আলেক্সান্ড্রিয়া ব্রীজ পেরিয়ে, দুটি নরনারীর দেহ পাশাপাশি হেঁটে দূর থেকে দূরে চলে যাওয়া দেখতে থাকে সৌম,রহস্যময় পৃথিবীর অবাক দৃষ্টিমেলে। বিন্দুর মতন তারা হারিয়ে যায় দৃষ্টির আড়ালে। বাতি ঘরের আলোর সংকেত পেয়ে থেমেছিল যেন খানিকের তরে বন্দরে জাহাজ। আবার রওনা হয়ে গেল অথৈ পথে।
http://www.alokrekha.com
রোকসানা লেইসর 'চমকিত চমক " ভাল লাগলো গল্পটা পড়ে ।অল্প কথায় প্রেমের কথা বর্ণনা প্রশংসনীয় । শুভেচ্ছা লেখকক রোকসানা লেইস
ReplyDelete