বন্ধু পরম জুয়েল ভাই ২০১৭জুলাই ২ তারিখে ইহলোক ত্যাগ করেন |
মৃত্যু!ছোট্ট একটি শব্দ।এই সেই শব্দ,যা আমাদের নিয়ে যায় অজানা কোন রাজ্যে, যার সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানিনা।যখন মৃত্যুর ডাক আসে,প্রিয়তমা স্ত্রী,আদরের সন্তান,সবচাইতে আপন বাবা মা -বা বন্ধু-বান্ধব কেউ তাদের বন্ধন দিয়ে ধরে রাখতে পারেনা।
আজ ২০১৭ জুলাই ২ তারিখে আমাদের পরম বন্ধু জুয়েল ভাই (Fazle Rabbi ) ইহলোক ত্যাগ করে মহা-মিলনের যাত্রায় পাড়ি দিয়েছেন। তিনি আমাদের ছেড়ে যান নি বরং রেখে গেছেন একরাশ ভালবাসার অম্লান স্মৃতি।
জুয়েল ভাইকে শুধু বন্ধু বললে ভুল হবে।তিনি ছিলেন আত্মিক। আমার বাবা বলতেন-" সেই তোমার আপনজন পরম বন্ধু যাকে দশ বছর পরে দেখলেও মনে হয় এইতো কালই একসাথে ছিলে আর যে দৃষ্টির আড়ালেও তোমার চিন্তায় চেতনায় তার মঙ্গল কামনায় থাকে- সেই আসল বন্ধু।
জয়েল ভাই ও তাঁর স্ত্রী রানা ঠিক তেমনই বন্ধু! দিন-ক্ষণ মনে করতে পারব না কবে ওদের সাথে শেষ দেখা হয়েছে আমার ? জুয়েল ভাইয়ের মৃত্যুতেও আমি হাসপাতালে যাইনি।রানার কাছে গিয়ে পরস্পর কাছাকাছি, গায়ে গায়ে বসি নি পরিবারের সাথে অন্যদের মত। অথচ পারস্পারিক কাছাকাছি থাকা কারো থেকে আমার কষ্ট কি কম? আমি স্ব-শরীরে থাকতে পারিনি। কারন কিছুটা অসুস্থতা- কিছুটা সামাজিক দায়বদ্ধতায়। কিন্তু আমার অন্তরে, আচরনে, চিন্তায় চেতনায় জুয়েল ভাই অনেক বেশী বিদ্যমান ছিলেন-ছিলেন আমার প্রার্থনায়। আমরা বন্ধু। ভালো বন্ধু। অনেক ভাল বন্ধু। অনেক অনেক অনেক প্রিয়। সবাই সবার থেকে আলাদা। মাঝে মাঝে অনেক বন্ধু আমাকে ভুল বোঝে । জুয়েল ভাই আর রানার ক্ষেত্রে তা হয়নি! বরং ওরা আমার স্বপক্ষে সোচ্চার হয়েছে। তাদের যে আমি ভালবাসি এটা তারা বোঝে ।
জুয়েল ভাই-রানা আমার ছোটবেলার বন্ধু নয় বা একই রক্ত আমরা ধমনীতে বহন করি না। আমরা যখন প্রথম কানাডায় আসি আমার ননদ (যার বন্ধুত্ব অমূল্য সম্পদ) তার বাসায় উঠি।পরে যখন নিজের বাসায় উঠি তখন একদিন আমার ননদ বলল তাদের এক বন্ধু আমাদের নিমন্ত্রন করতে চায়।বিদেশ-বিভুইতে এই নিমন্ত্রনে না যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।তার প্রধান কারন আমার পতি দেবতা! সে ঢাকার দাওয়াত- পার্টি, বাংলাদেশী মানুস খুব মিস করতে শুরু করে দিয়েছিল এক মাস না পেরুতেই । এখানে তার বন্ধুরা দূরে থাকে-সবাই ব্যস্ত -ফোন করে সময় ঠিক করে যেতে হয়। তার ওপর তখনও আমাদের গাড়ি কেনা হয়নি। সব মিলিয়ে আমার কর্তার অবস্থা বেহাল-আর এই বেহাল অবস্থার জন্য আমাকেই দায়ী করে কারনে- অকারনে । কেন এই দেশে তাকে আসতে বাধ্য করলাম এই কথা শুনতে শুনতে প্রান ওষ্ঠাগত । এই নিমন্ত্রণটা যেন কর্তাকে প্রশমিত ও পরিতুষ্ট করার পরম বারতা।
সেই মহেন্দ্র ক্ষণ আসলো। কর্তা ও সন্তানদের নিয়ে ননদিনীর সাথে সেই নিমন্ত্রনে গেলাম । গাড়ী এসে থামল এক বিলাস বহুল বাড়িতে।মনটা একটু হলেও দুললো--আহা আমি থাকি ভাঙ্গাচোরা ভাড়াটে এপার্টমেন্টে-না জানি কেমন আপ্যায়ন পাবো? আমার কর্তাটা রাগী মানুস। বড়লোকি ব্যবহার আমি সইলেও সে তো সইবে না। ভয়ে ভয়ে গাড়ি থেকে নামলাম । বাচ্চাদের নামাচ্ছি এমন সময় ঘাড় ফিরিয়ে দেখি সুদর্শন হাস্য-উজ্জ্বল এক ব্যক্তি আমার কর্তার সাথে “হ্যান্ড-সেক” করছে। আমাকে দেখার সাথে সাথেই এগিয়ে এসে সেই সদা সুলভ হাসিতে তাঁর নাম বলে ভেতরে নিয়ে গেল। ওমা ! বাড়ীর ভেতরে আর একজন সাদরে জড়িয়ে ধরে বলল “ আমি অনেক খুশি হয়েছি তোমারা এসেছ “। এই আমাদের রানা! যার প্রথম পরশেই মনে হয়েছিল কত দিনের চেনা-জানা !কত আপন। আজকাল বাচ্ছারা সাধারনত বাবা মার সাথে তাদের বন্ধুদের বাসায় যেতে না।কিন্তু জুয়েল ভাই--রানা ও ওই বাসায় ওদের বয়সী বাচ্চাদের সাথে এমন সাচ্ছন্দে মিশে গেল যা ছিল আমার ধারণাতীত।এরপর থেকে আমাকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। সর্বদা ছায়ার মত ওরা আমার পাশে থেকেছে। আমার কর্তার ব্যবসা ঢাকায় । একমাসের মধ্যেই তাকে ফিরতে হয়েছে দেশে। আমি একা আমার বাচ্ছাদের নিয়ে ।এখানে বলা বাহুল্য ইতি মধ্যে আমার ননদ স্ব- পরিবারে সেন্ট লুসিয়া চলে যায় চাকরির সুবাদে। সেই সময় এই বিদেশ বিভূঁইয়ে জুয়েল ভাই-রানা আমাদের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে। এখানে বলে রাখি আমার পতিদেব একটু সামাজিকতায় আনারি অথচ সেই মানুষটাই রানাকে ”ধর্মের বোন” ডাকল।সেই থেকে এক পারবারিক সম্পর্ক শুরু হল।
আমার ছেলের অনেক জ্বর- গাড়ী নেই ।এদেশে কি করতে হয় জানি না । জুয়েল ভাই -রানা এসে হাজির । সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে গেল ।ডাক্তার বলল “ফুজিয়ান ফ্ল”-আমি কি এ নাম আগে নাম আগে কন্দিন শুনেছি ছাই ! যে বুঝবো ! সেদিন ওরা হাসপাতালে না নিয়ে গেলে আমার ছেলে হয়তো বাঁচত না । এমন অনেক ঘটনা আছে যা বলতে গেলে মাসের পর মাস লাগবে।
জুয়েল ভাই এমন একজন মানুষ ছিলেন যাকে আমি কোনদিন নেতিবাচক কথা বা ভাব প্রকাশ করতে দেখি নি।চরম সঙ্কটেও তাঁর মুখের হাসি একটুও ম্লান হতে দেখি নি ।তিনি ছিলেন সদাদয় হৃদয়ের অধিকারী ।তাঁর চারপাশে প্রায় বন্ধু বান্ধবকে সাহায্যের হাত প্রশারিত করেছেন। আমারা সবাই জানি এদেশে নুতুন এসে কাজ পাওয়া কত কঠিন। কিন্তু জুয়েল ভাই-এর ফ্যাক্টরির দ্বার ছিল সবার জন্য উন্মক্ত আবারিত। আজ যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত তারা সবাই জুয়েল ভাইয়ের শিল্প-কারখানা দিয়েই শুরু যাত্রা পথ। এমনই উদারতা দয়াশীলতা ও সাহায্যকারী ছিলেন জুয়েল ভাই। কারো মুখ একটু ভার দেখলে নানা রকমের জোক শোনাতেন ততক্ষন পর্যন্ত না তার মুখে হাসি ফোটে। এমনই ছিলেন আমাদের জুয়েল ভাই ।
হঠাৎ আমার ক্যান্সার ধরা পরল।আমার কর্তা ঢাকায়- বাচ্চারা ছোট। আমি অথৈ সাগরে। আমার পাশে জুয়েল ভাই আর রানা।পুরো পরিবারটাকে আগলে ধরল। সর্বদা আমার বিপদে-আপদে আমার পাশে পরিবারের থেকেছে।
জুয়েল ভাই-রানা তোমাদের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে ! যে ঋণ কোনদিন শোধ হবে না – সে ধৃষ্টতাও আমার নেই ।
সানজিদা রুমি কর্তৃক গ্রথিত http://www.alokrekha.com
"জুয়েল ভাই-রানা পরিবারের কাছে আমার ঋণ কোনদিন শোধ হবে না –সে ধৃষ্টতাও আমার নেই "লেখাটা খুবই প্রসংশনীয় ও সানজিদা রুমিকে আমরা জানাই সাধুবাদ। একজন বন্ধু বিয়োগে বেদনাতো লেখাতে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা,ঋণ ও কৃতজ্ঞতাবোধ যে ভাবে তুলে ধরেছেন তা অনেক মর্মস্পর্শী ও অপ্রচলিত অনন্যসুলভ হৃদয়গ্রাহী লেখা। সানজিদা রুমির বন্ধু "জুয়েল ভাইয়ে"র আত্মার শান্তি কামনা করি ও পরিবারের সাথে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি।
ReplyDelete