জমিদারদের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিধিবিধানগুলির মধ্যে সবচেয়ে মারাত্যক দিক ছিল রাজস্ব বিক্রয় আইন, যাকে তারা মোলায়েম ভাষায় বলতেন সূর্য্যাস্ত আইন। এই আইনের শর্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বারোটি কিস্তিতে জেলা কালেক্টরেটে পরিশোধ করতে হতো। কোন জমিদারের প্রদেয় কিস্তি বকেয়া হলে পরবর্তী মাসে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর ঐ জমিদারের জমি থেকে বকেয়া কিস্তির সমমূল্যের জমি বিক্রয় করে সেই টাকা উসুল করতেন।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকর হওয়ার একেবারে শুরু থেকে রাজস্ব বিক্রয় আইনের(সাধারণ্যে সূর্যাস্ত আইন নামে পরিচিত)অধীনে শত শত জমিদারি সম্পত্তি বিক্রয় হয়ে যায়। সে কালের লোকেরা এই আইনকে "সূর্য্যাস্ত আইন বলত এই অর্থে যে,এর ফলে একটি শাসক পরিবারে অন্ধকার নেমে আসত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকর হওয়ার দশ বছরের মধ্যে বাংলার জমিদারি সম্পত্তির প্রায় অর্ধেকের মালিকানা বদল হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকর হওয়ার একেবারে শুরু থেকে রাজস্ব বিক্রয় আইনের(সাধারণ্যে সূর্যাস্ত আইন নামে পরিচিত)অধীনে শত শত জমিদারি সম্পত্তি বিক্রয় হয়ে যায়। সে কালের লোকেরা এই আইনকে "সূর্য্যাস্ত আইন বলত এই অর্থে যে,এর ফলে একটি শাসক পরিবারে অন্ধকার নেমে আসত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকর হওয়ার দশ বছরের মধ্যে বাংলার জমিদারি সম্পত্তির প্রায় অর্ধেকের মালিকানা বদল হয়।
নয়া জমিদার খোদ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কার্যপদ্ধতির মধ্যে পুরানো জমিদারদের স্থলে এক নতুন জমিদার শ্রেণীর উদ্ভবের সুযোগ নিহিত ছিল।এই প্রথার প্রণেতারা সচেতন ছিলেন যে,চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকর হওয়ার পর ভূমির একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি হবে এবং তার ফলে দুর্বল ও অদক্ষ জমিদাররা ভূমির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবেন, ভূমির মালিকানার ক্ষেত্রে নতুন রক্তের সঞ্চালন ঘটবে।আগেই ধারণা করা হয়েছিল যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে ভূমিনিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডে টাকা ওয়ালা ও উদ্যমী এক শ্রেণীর লোকের প্রবেশ ঘটবে, যারা কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তনে পালন করবে সহায়ক ভূমিকা।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভূমি ব্যবস্থাপনায় নয়া জমিদার ও পুরানো জমিদারদের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য ছিল না। নয়া জমিদারদের অধিকাংশেরই আগমন ঘটে জমিদারদের চাকুরে, সরকারি চাকুরে এবং বণিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর মধ্য থেকে। সনাতন জমিদারদের মধ্যে দেখা যেত প্রণোদনার অভাব এবং আলস্য, আর ভূমি নিয়ন্ত্রণে নবাগতরা কৃষি খাতের উন্নয়নকল্পে কোন পুঁজি বিনিয়োগ না করে নিজেদের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতেন বর্গাচাষিদের ওপর উচ্চ হারে খাজনা আরোপের মধ্য দিয়ে।
জমিদার ও রায়ত
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে জমিদার ও রায়তদের মধ্যকার সম্পর্কের ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে। জমিদাররা চলতি খাজনা বৃদ্ধি করতে থাকে এবং মূলত এ কারণেই দুই শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চাপ এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মামলা-মোকদ্দমা, পারিবারিক কলহ, পূর্বপুরুষের ভূসম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগাভাগি ইত্যাদি কারণে জমিদারির আয় হ্রাস পেতে থাকে। এর ফলে জমিদারদের মধ্যে রায়তের খাজনার হার বৃদ্ধি করার প্রবণতা দেখা দেয়। কিন্তু রায়তরা এ ধরনের প্রয়াসের বিরুদ্ধে দৃঢভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা দাবি করে যে, পরগনা নিরিখ বা খাজনার প্রচলিত হার পরিবর্তন করার অধিকার জমিদারদের নেই।কিন্তু জমিদাররা রায়তদের এ ধরনের দাবি খণ্ডন করে যুক্তি দেখান যে, যেহেতু তারা তাদের ভূমির নিরঙ্কুশ মালিক তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং জমির দামের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে জমির খাজনার হার পুনর্নির্ধারণ করার অধিকার তাদের রয়েছে। এই বিরোধের পরিণামস্বরূপ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে অস্থিরতা ও বিক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং মাঝেমধ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই বিক্ষোভ থেকে ঐ শতকের আশির দশকে জমিদার বিরোধী কয়েকটি বড় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। এগুলি ছিল তুষখালি কৃষক আন্দোলন (১৮৭২-৭৫), পাবনা কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭৩) ছাগলনাইয়া (ফেনী) ও মুন্সীগঞ্জ কৃষক বিদ্রোহ (১৮৮০-৮১)।
জমিদারি ক্ষমতার অবক্ষয়
কর্নওয়ালিস কোডে অস্পষ্টভাবে কৃষকদের প্রথানুগ অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।কিন্তু কখন ওই সেগুলি সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় নি।দেশ জুড়ে ব্যাপক কৃষক অসন্তোষের ফলে ঔপনিবেশিক সরকার সমগ্র পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে এবং পল্লী অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে।ভূমি নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর উদ্ভব ছিল আরও একটি সমস্যা।অধিকাংশ জমিদার, বিশেষ করে পূর্ববাংলার জেলাগুলিতে মধ্যস্বত্ব নামে স্থায়ী এক ধরনের মধ্যবর্তী দখলিস্বত্ব কায়েম করেন,যার ফলে রায়তদের সঙ্গে জমিদারদের দূরত্ব অনেক বেড়ে যায়। জমিদার ও রায়তদের মাঝা মাঝি পযায়ক্রমে কয়েকটি স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী ছিল যাদের প্রত্যেকেই একই রায়তের একই জমি থেকে খাজনা আদায় করত।খাজনার চাপে অতিষ্ঠ রায়তরা এমন পরিস্থিতিতে হয় ভিটেমাটি ছেড়ে পালাত,নয় সংঘ বদ্ধ প্রতিরোধের পথ বেছে নিত। সংঘটিত সকল কৃষক আন্দোলন (ঔপনিবেশিক যুগ) থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ভূমির ওপর নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে কৃষকদের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা ছিল। তারা জমির ওপর তাদের অধিকারের কথা অত্যন্ত দৃঢভাবে ব্যক্ত করত, যা জমিদাররা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাত এবং এ নিয়ে আদালতগুলি পরস্পরবিরোধী রায় দিত।
বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫
কৃষির পরিস্থিতি পযালোচনা করে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দানের উদ্দেশ্যে ১৮৮০ সালে একটি রেন্ট কমিশন গঠন করা হয়। রেন্ট কমিশনের রিপোর্টের (১৮৮৩) ওপর ভিত্তি করে বঙ্গীয় বিধান সভা বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন (১৮৮৫) নামে একটি আইন পাস করে। এই আইনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা এবং তার ফলে উদ্ভূত কৃষি পরিস্থিতির বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়। সকল স্তরের রায়ত, মধ্যস্বত্বভোগী এবং জমিদারসহ ভূমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের অধিকার ও দায়-দায়িত্ব সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস নেওয়া হয়। এই আইনের অধীনে ভূমির সঙ্গে জড়িত ঊর্ধ্বতন মহলের ইচ্ছামাফিক খাজনার হার বাড়ানোর অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব করা হয়। এই আইনে জমির মালিককে নামজারি সেলামি নামে এক ধরনের রেজিস্ট্রেশন মাশুল প্রদান সাপেক্ষে বড় রায়তদের নিজ দখলিস্বত্ব হস্তান্তরের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সকল মধ্যস্বত্বভোগীর অধিকারও স্বীকৃতি লাভ করে। কোন কারণ না দেখিয়ে খাজনা বৃদ্ধি করার অধিকার জমিদাররা হারান। এই আইনের অধীনে তারা কেবল তখনই খাজনার হার বাড়াতে পারতেন যখন তারা প্রমাণ করতে পারতেন যে ভূমির উন্নয়নে তারা পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ইত্যাদি। এইসকল বিধি-নিষেধের উদ্দেশ্য ছিল জমিদারি ক্ষমতার গুরুতর সংকোচন ঘটানো। ধনী কৃষক ও দখলি স্বত্বভোগীদের ভোগদখলের বিশেষ মেয়াদের আইনগত স্বীকৃতি লাভের ফলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিধি-বিধানের আওতায় জমিদারদের প্রদত্ত পদমর্যাদা নাকচ হয়ে যায়।
জমিদারি প্রথার বিলোপ বিশশতকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ,বিক্ষোভের রাজনীতি,প্রথম মুসলিম নির্বাচক মণ্ডলী,বিভাজন রাজনীতি,কমু্যনিস্ট ভাবধারার অনুপ্রবেশ প্রভৃতি ঘটনা দ্বারা ব্রিটিশ রাজের অনুগত ও রাজনৈতিকভাবে মধ্যপন্থী জমিদার শ্রেণীর সামাজিক কর্তৃত্ব গুরুতরভাবে হ্রাস পায়।কৃষক রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। অধিকাংশ জমিদার হিন্দু ছিলেন বলে পল্লী অঞ্চলের জনসংখ্যার সিংহভাগ মুসলমান কৃষকসমাজ ছিল প্রবলভাবে জমিদারদের বিরোধী। জমিদার ও রায়ত সম্পর্কের গভীর পরিবর্তন ঘটে, ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনঅংশগ্রহণকারী নেতৃস্থানীয় সকল রাজনৈতিক দল অঙ্গীকার করে যে,তারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গেলে জমিদারি প্রথা বিলোপ করা হবে। সে অনুসারে মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টি এর কোয়ালিশন সরকার জমিদারি প্রথা সম্পর্কে রিপোর্ট দানের জন্য একটি কমিশন গঠন করে।ফলাউড কমিশন নামে পরিচিত সেই কমিশন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিলের সুপারিশ করে। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতি, সাম্প্রদায়িক বিরোধ এবং দেশ বিভাগের রাজনীতির ডামাডোলে সরকার ফলাউড কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকে।১৯৫০ সালেইস্ট বেঙ্গল স্টট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট-এর অধীনে জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটে।
http://www.alokrekha.com
সানজিদা রুমির জমিদারির ইতিকথা!লেখাটা এত অনবদ্য।যত-ই প্রশংসা করি কম।সানজিদা রুমির প্রতিটি লেখা সব সময় বিস্তারিত তথ্যবহুল। যা আমদের দীপ্ত প্রজ্ঞা দান করে। অনেক অনেক ধন্যবাদ !
ReplyDeleteকত কিছু জানতে পারি আলকরেখাইয়,তাই আমার প্রতিদিনের সঙ্গী ,অনেক অনেক ভাল লাগে অজানা কথা জানতে পারে। সানজিদা রুমির জমিদারির ইতিকথা!পড়ে মনে হল কত ক=ই অজানা।এখন আমাদের প্রজন্জ-এর ইতিকথা জানা খুব প্রয়োজন। সানজিদা রুমির লেখা গুলো ব্যতিক্রম ধর্মী অ তথ্য সম্বলিত। অনেক ধন্যবাদ!
ReplyDelete“সানজিদা রুমির জমিদারির ইতিকথা!লেখাটা এতো বিস্তারিত গবেষণা ও লেখা পড়া করে লিখতে হয়েছে। যতই -ই প্রশংসা করি কম।সানজিদা রুমির প্রতিটি লেখা সব সময় বিস্তারিত তথ্যবহুল। যা আমদের দীপ্ত প্রজ্ঞা দান করে। অনেক অনেক ধন্যবাদ !”
ReplyDeleteভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা রইলো
সানজিদা রুমির জমিদারির ইতিকথা।চমত্কার লেখা “কত কিছু জানতে পারি আলকরেখায়, ,অনেক অনেক ভাল লাগে অজানা কথা জানতে । আসলেই আমরা কত কিছু জানি না। সানজিদা রুমির লেখা গুলো ব্যতিক্রম ধর্মী অ তথ্য সম্বলিত। সানজিদা রুমিকে অনেক অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা। আরো এমন লেখার অপ্পখায়ে রইলাম
ReplyDeleteজমিদারি নিয়ে এত সুন্দর লেখা খুব কম হয়। সানজিদা রুমির জমিদারির ইতিকথা!পড়ে মনে হল কত ক=ই অজানা।এখন আমাদের প্রজন্জ-এর ইতিকথা জানা খুব প্রয়োজন। লেখাটি তথ্য সম্বলিত।খুব ভালো লাগলো। অনেক ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা
ReplyDelete“সানজিদা রুমির জমিদারির ইতিকথা। অনেক গবেষণা ও পড়া শোনা করে এটা লেখা।এই লেখাটা এত অনবদ্য।যত-ই প্রশংসা করি কম।সানজিদা রুমির প্রতিটি লেখা সব সময় বিস্তারিত তথ্যবহুল। যা আমদের দীপ্ত প্রজ্ঞা দান করে। ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা আপনাকে। আরো এমন লেখার অপেক্ষায় রইলাম
ReplyDeleteসানজিদা রুমির জমিদারির ইতিকথা! লেখাটির বিষয় "জমিদারির ইতিকথা " চমত্কার। যতই -ই প্রশংসা করি কম।সানজিদা রুমির লেখা গুলো অনেক তথ্য পূর্ণ হয়। অনেক গবেষণা করে লেখা। ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা রইলো
ReplyDelete