বেগম-জানের জীবনে কাহিনী-এক বিচিত্র "কাহানী" সানজিদা রুমি |
বেগম-জানের জীবনের কাহিনী--এক বিচিত্র "কাহানী"।সে হিন্দু বাঙালি ঘরের বাল্য বিধবা।মাত্র দশ বছর বয়সে সে বিধবা হয়। "সর্বদা সতির দেবতা পতি” প্রচলিত কথন অনুসারে আজও বিধবাদের অসতি -অশুভ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।স্বামী আছে-তো ঘর আছে!পরিবার
আছে!আর স্বামী নেই তো ঘর
নেই!পরিবারও নেই!স্বামীর মৃত্যুর পর দশ বছরের
ব্রাহ্মণ ঘরের একটি ফুটফুটে মেয়ের মাথা নেড়া করে তাকে ঘরের অন্ধ কোণে মাটিতে প্রক্ষেপন করা হয়।সংসারে তার আর কোন দাবী বা প্রয়োজন নেই -দাসীর কাজ ছাড়া।মেয়েটি কাজ করে রাতদিন!বিনিময় তার জন্য বরাদ্দ সিদ্ধ আলু নুন কখনো বা তেল মশলাহীন নিরামিস তরকারী ও আপত চালের ভাত।
তার মুখ সকালে বা শুভ কাজে কেউ যেন না দেখতে পায়-সে ব্যাপারে কড়া করে শাসানো হয় মেয়েটিকে। ছোট্ট মেয়েটির নীলাভ সরল চোখ'দুটো কেবল কারন খুঁজে ফেরে-কেন-এই অনুশাসন? দরিদ্র-নিঃস্ব ও দুঃস্থ-জমিদার পরিবার থেকে মাত্র ৮-বছর বয়সে বিয়ে হয়ে আসে ধনী অবস্থাপন্ন এই পরিবারে। স্বামীটি বয়সে ৩৫-৩৬ বছর বড় ও পাগল তাই বিনা পণ-ই পার হয় পিত্রালয় থেকে মেয়েটি! যার নাম মৃণালিনী মার আদরের ডাক মৃনাল!
তার মুখ সকালে বা শুভ কাজে কেউ যেন না দেখতে পায়-সে ব্যাপারে কড়া করে শাসানো হয় মেয়েটিকে। ছোট্ট মেয়েটির নীলাভ সরল চোখ'দুটো কেবল কারন খুঁজে ফেরে-কেন-এই অনুশাসন? দরিদ্র-নিঃস্ব ও দুঃস্থ-জমিদার পরিবার থেকে মাত্র ৮-বছর বয়সে বিয়ে হয়ে আসে ধনী অবস্থাপন্ন এই পরিবারে। স্বামীটি বয়সে ৩৫-৩৬ বছর বড় ও পাগল তাই বিনা পণ-ই পার হয় পিত্রালয় থেকে মেয়েটি! যার নাম মৃণালিনী মার আদরের ডাক মৃনাল!
যার নাম মৃণালিনী -মার আদরের ডাক মৃনাল ! |
মহা ধুম-ধাম-সরব চারিধার। নহবতে সানাই বাজাচ্ছে। জোড়া তোরণ তৈরী করা হয়েছে প্রধান ফটকে।নতুন রঙ করে ও ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরোনো ভগ্নপ্রায় জমিদার মুকুন্দনাথ মুখার্জীর-"জমিদাবাড়ী”।মুকুন্দনাথ মুখার্জী মৃনালের পিতা শিবনাথ মুখার্জীর প্রপিতামহ একসময় ছিল আয়েসী-প্রতিপত্তিবান জমিদার ছিল। মুকুন্দনাথ ও তার উত্তরসুরি জমিদার ছিল দুর্বিনীত কঠোর আর নিষ্ঠূর।প্রজাদের ওপর চালাত নির্মম-পীড়ন। তাদের দাপটে আর অত্যাচারে প্রজারা ছিল উৎপীড়িত পদলিত ও নির্যাতিত।কিন্তু এই দুর্দান্ত প্রতাপশালী জমিদারদের মদ জুয়ো,বাঈজী-অপব্যয়ী ও উড়নচন্ডি-জীবন-যাত্রা জমিদারী কালের গর্ভে হারিয়ে যায়।এখন শুধু ওই দুর্দান্ত আয়েসি প্রতাপশালী জমিদারীর স্মৃতি ও কালের সাক্ষী হয়ে আছে ভগ্নপ্রায় জমিদার মুকুন্দনাথের বন্ধককৃত"বাড়িটা" ও মৃনালের বাবা শিব--নাথ নিঃশ্বসহায়-সম্বলহীন ও নামমাত্র জমিদার।
পন-দান বা তত্ত্ব দিতে তো হচ্ছেই না। উপরন্ত শিবনাথের বন্ধকী "জমিদার বাড়িটি” ছাড়ানোর পুরো টাকাও তারাই দিয়েছে।আর বিয়ের সব খাই-খরচাও তাদের।বিনিময়ে তাদের একটাই মাত্র চাওয়া – “মৃণাল”।
শিবনাথ মনের শখ মিটিয়ে দু'হাতে মেয়ের বিয়েতে খরচ করছে ।মিঠাই-মন্ডা -দই সন্দেশ,খাঁটি ঘিয়ে-
ভাজা লুচি-তরকারী ও পাঁঠার মাংস কোন-কিছতেই সে কমতি রাখেনি। গ্রাম সুদ্দু সবাইকে নিমন্ত্রন করেছে ।আত্মীয় কুটুম্ব ও বোনদের পালকি পাঠিয়ে আনিয়েছে।শিবনাথের আজন্ম
সাধ ছিল স্ত্রীকে একটা লাল পাচ্ছা পেড়ে বেনারসি শাড়ী দেয়। সে সাধটাও পুরিয়ে-নেয়
এবার। নিজের ও দুই ছেলে মাধব আর কানাই-এর জন্য ফিনফিনে মলমলের গিলে করা পাঞ্জাবী ও জরিদার ধূতি কিনে সে
সানন্দে বাড়ি ফেরার পথে ভাবতে থাকে-কি
ভালো-ই না মানাবে তাকে। হাজার হলেও গায়ে জমিদারের রক্ত। নাইবা রইল জমিদারি। মেয়ে
জন্মেছে বলে যে ক্ষোভ ছিল তার মনে আজ তা কিছুটা হলেও মিটলো। বাড়ি ফিরেই শিবনাথ
হাঁকাহাঁকি শুরু করে দেয়-- পন-দান বা তত্ত্ব দিতে তো হচ্ছেই না। উপরন্ত শিবনাথের বন্ধকী "জমিদার বাড়িটি” ছাড়ানোর পুরো টাকাও তারাই দিয়েছে।আর বিয়ের সব খাই-খরচাও তাদের।বিনিময়ে তাদের একটাই মাত্র চাওয়া – “মৃণাল”।
শিবনাথ মনের শখ মিটিয়ে দু'হাতে মেয়ের বিয়েতে খরচ করছে ।মিঠাই-মন্ডা -দই সন্দেশ,খাঁটি ঘিয়ে-
---এই!কে কোতায়
আছিস! কিছুক্ষনের মধ্যেই বরযাত্রী এলো
বলে--আমি না দেখলে কিচ্চুটি কি হবার যো আচে-সানাইটা জোরে বাজাও তো বাপু! কিগো তুমি আবার কোতায় গেলে ? আমার হয়েচে যত জ্বালা--ক'দিক যে সামলাই------------------বলতে বলতে অন্দর মহলের দিকে এগোয় শিবনাথ। সেখানে মেয়েদের গান-বাজনা আর
উৎসবের জোয়ার!মৃনালের ছোট্ট মনটাতেও সেই খুশির জোয়ার লাগে।পাড়ার কাকী-পিসি ও সইরা আমোদ ফুর্তিতে মাতিয়ে তুলেছে পুরো বাড়িটা। কত পদের পদের মিষ্টি ! কতদিন খায় নি সে এসব। কিন্তু মা যে বলেছে বিয়ে শেষ না অব্দি খাওয়া মানা। মৃনালের মনটা খারাপ হয়ে যায়। পরক্ষনেই শিশু মনের কষ্টটা স্তিমিত হয়--শশুর বাড়ি থেকে আসা সুন্দর বাহারি গয়না-কাপড় আর কত রকমের তত্ত্ব দেখে। মৃনাল মনে মনে ভাবে-- ইস ! এমন একটা বাড়িতে যদি ওর পুতুলের বিয়ে হত তবে সেও এমন কত শাড়ী-গয়না পেত। মার পুরনো শাড়ি কেটে আর দর্জি রহমত চাচার দোকান থেকে কত কষ্ট করে ওর পুতুলেকে সাজাতে হয়। কিছুক্ষনের জন্য ছোট্ট মনটা ভারী হয়ে ওঠে। একটু বাদে-ওকে নিয়ে সবাই মাতামাতি শুরু করে দিলে সব ভুলে যায়। মৃণালের গায়ে হলদি মাখানো হল। স্নান করে নতুন শাড়ি পরলো মৃণাল। অথচ কত দিন কেঁদেছে একটা নতুন শাড়ির জন্য। শিবনাথে ছোট বোন প্রেমলতা মৃণালের দীর্ঘ কালো কোঁড়ানো চুল মুছে--আঁচড়াতে আচঁড়াতে সবাইকে উদ্দেশ্যে বলে --
--মাগো!কি রাজ্ কপাল করে এয়েচে মেয়েটা!কত বড় বাড়িতে বে' হচ্চে--না দিতে হচ্চে পণ বরাদ্দ-না দিতে হচ্চে কোন সোনা দানা। উল্টো সব খাই -খরচ তেনাদের। মাতা থেকে পা ওব্দি গয়নায় মুড়ে নিয়ে যাচ্চে ! বড্ড কপাল গো দাদার।
অমনি ফোঁস করে ওঠে মৃনালের বড় মাসি সবিতা--
--মাগো!কি রাজ্ কপাল করে এয়েচে মেয়েটা!কত বড় বাড়িতে বে' হচ্চে--না দিতে হচ্চে পণ বরাদ্দ-না দিতে হচ্চে কোন সোনা দানা। উল্টো সব খাই -খরচ তেনাদের। মাতা থেকে পা ওব্দি গয়নায় মুড়ে নিয়ে যাচ্চে ! বড্ড কপাল গো দাদার।
অমনি ফোঁস করে ওঠে মৃনালের বড় মাসি সবিতা--
--হ্যা গা! এখন যে বড় গুন গাইচ -মেয়ে
বিয়িয়ে ছিল বলে কম কতা আর খোঁটা দাও নি ? নাকের আর চোকের জল এক করে
দিয়েচিলে-আহা!বোনটা আমার কি কষ্টটাই না পেয়েচে-----বলে আঁচলে চোখ মোছে।প্রেমলতাও কি চুপ থাকার মানুষ।
---তা বলবে নাই কেন?নেহাত কপাল জোরে পণ
দিতে হচ্চে না-উপরি সব খরচ তেনারাই ওঠাচ্ছেন- নইলে পারতো দাদা এই মেয়ের বে' দিতে? মেয়ে আইবুড়ো থাকতো-নয় দাদার গলায় দড়ি দিতে হত। দাদার অবস্থা কি জানিনে আমরা!বৌদিও তো বাপের বাড়ি থেকে রাজত্ব আনে নি- চুপ করে থাকো দেকি দিদি!আমার মুক খুলিয়ো না! এই
আমি বলে দিচ্চি-----
হঠাৎ কে একজন বলে বসলো।
--হ্যা গা! শুনলুম ছেলের নাকি অনেক
বয়স-মাতায়ও নাকি দোষ !
সবিতা তাকে তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিয়ে বলে
---কি যে কয় বৌ ? পুরুষ লোকের বয়স হল গিয়ে গাছ -পাতর--সোনার আংটি আবার বেঁকা?
মৃনাল এগুলো কিছু বোঝেনা এদিক ওদিক
চায়। ক্ষিদে পেয়েছে। আর মাকেও দেখছে না কত কখন হলো। পুতুলটাও যে কোথায় রেখেছে মনে
করতে পড়ছে না। কেউ যদি ওকে চুরি করে নিয়ে যায়? নানান চিন্তা মৃনালের মাথায়। যতবার
মাথা উঁচু করে মাকে খুঁজতে যায় ততবারই মাথায় ঠোকা মেরে কেউ না কেউ বলে ----
---বিয়ের কনে! মাতা আর চোক নিচে রাকতে
হয়-নইলে শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা বলবে- বেহায়া মেয়ে মানুষ! বাপের বাড়িতে কিচচুই শেকে নি
কো-পাশ থেকে একজন বললে---
---দ্বোর খুলে রাখতে হবে -পরের দিনই ফেরত
পাটিয়ে দেবে।
এই কথা শুনে সবাই হাসতে হাসতে একে
অন্যের গায়ে লুটিয়ে পড়ে। কেবল পাশের ঘরে সিক্ত চোখে জানালার শিক ধরে এক ঠাঁয়
দাঁয়িয়ে কাদম্বিনী! মৃনালের মা।
শিবনাথ ঘরে
ঢুকে স্ত্রী কাদম্বিনীর কাঁধে হাত রাখতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে কাদম্বিনী। হতভম্ভ
শিবনাথ ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা-আমতা আমতা করে বলে--আহা! তুমি কাঁদচ কেন? এমন দিনে চোকে'র জল
ফেললে যে মেয়ের অকল্যাণ হবে। কাদম্বিনী আচমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে --অকল্যাণ ? এর কিচু কি বাকি আচে ? একটা
বুড়ো হাবড়া -পাগলের সাথে সুদু টাকার জন্যে ওই টুকু মেয়েটাকে বিয়ে দিচ্চ ? বাপ্ হয়ে কি করে পারচ গো ?
তার চেয়ে হাত পা বেঁদে কুঁয়োয় ফেলে দিলেই পাততে। আচঁলে মুখ ঢাকে কাদম্বিনী।
...মাগো !দেখনা সবাই আমায় কি সব বলেছে? তোমায় যকন তকন দেখতে পারবো না নাকি ? শশুর বাড়ি একবার গেলে ওরা কোনদিন আসতে দেবে ? ওরা যা বলবে তাই শুনতে হবে---পুঁটিকেও সাতে নিতে দেবেনা (মৃনালের পুতুলের নাম পুঁটি ) ? বল না গো মা ? ওরা মিচে কতা কইচে।
...তোমার কি
মতি-ই-ভ্রম হলো? তোমার মেয়েটা ভালো খাবে পরবে। তুমি এটা কি চাও না ? কি দিতে পেরেচি
মেয়েটাকে এ ওব্দি অভাব ছাড়া। ও যেদিন থেকে মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেচে সঙ্গে করেই নিয়ে
এয়েচে দুর্ভাগ্য! পাত্তুম বে' দিতে? আইবুড়ো
মেয়ে নিয়ে জীবনভর অধম্ম কত্তুম? স্বগ্গে গিয়ে বাপ্-ঠাকুরদাকে কি মুখ দেকাতুম বল?একন
যাই হোক আইবুড়ো নামতো ঘুচবে--তোমার এসব নেকামো রাকো দেকি বৌ ! মেয়ের সুবাদে আজ এই
আনন্দের দিন দেকচি। এই দেক দেকি- কত দিনের সাধ ছিল তোমায় একটা লাল পাচ্ছা পেড়ে
বেনারসি শাড়ী দিই-আজ এনেচি-এওকি কম ?এস-তো !বাইরে এস! দেক কি জাঁকজমক কান্ড!সানাই
বাচ্চে! বাড়ি সুদ্দু লোক আমোদ ফুত্তি কচ্ছে।
...না আমার এসব দেকে কাজ
নেই। আমার মেয়েকে গঙ্গা জলে ভাসিয়ে-রাকও দেকি! তোমার বড় বড় কতা। শিবনাথ রেগে এক
ধমকে কাদম্বিনীকে থামিয়ে দেয় ...মোটেই মা রাঁদে না তার ওপর তপ্ত আর পান্তা ! যাও !
মেয়েটার কাচে গিয়ে বস নিজ হাতে সাজাও
-দুটো ভালো মন্দ কতা কয় -কি জানি আবার কবে কাচে পাও? কবে দেকা হয় ? ভগবান জানে আদৌ
দেকা হয় কি না --
...রাম! রাম! শুব কতা কও !---- বলতে বলতে সে বাইরে চলে যায়।মৃনাল মাকে
দেখতেই এক দৌঁড়েই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মাকে পেয়ে এক নিঃশ্বাসে সব কথা গড় গড় করে বলে যায় মৃনাল। কাদম্বিনীর চোখের জলের বাঁধ মানতে চায় না। তাড়াতাড়ি নিজেকে আঁচলে চোখ মাঝে বলে --
...হ্যা গা তোমাদের কি কোন বুক-পিট্ নেই -শুদু শুদু মিচে কতা কইছ। কত বড় ঘরে যাচ্চে -কত কিচু আচে সেতায়ে-সোনার খাতে গা রুপোর খাতে পা--কত পদের খাওয়া শাড়ি গয়না দাস দাসী।
...সত্যি মা ?তোমার গল্পের রাজকুমারীর মত ?--কাদম্বিনী কোন উত্তর দেয় না। বুকটা ফেটে যাচ্ছে মিথ্যে বলতে। তাড়াতাড়ি কথা পাল্টে ফেলে সে--
--ও দিদি ! ও ঠাকুর ঝি! তোমাদের আক্কেল পচন্দ কেমন গো? মেয়েটাকে কিচু ফলমূল দিয়েছ? বর-যাত্রী এলো বলে--লগ্ণ শুরু হলে দাঁতে কিচু কাটতে পারব নাকো। ও নয়া বৌ!যাও তো বাছা ! কিচু ফল কেটে আনো দেকি ! আর আমার ঘরে নিয়ে এস --
বলে কাদম্বিনী মেয়েকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গিয়ে পুরোনো জমিদারি পালঙ্কে বসিয়ে অপলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মৃনাল হাত বাড়িয়ে মায়ের চোখ মোছে --মাগো কাঁদচ কেন ? কেঁদো না -আমি বিয়ে করবো না-নতুন শাড়ি- মিঠাই মন্ডা-সোনার খাট এসব আমার কিচ্চু লাগবে নাকো তবুও তুমি কেঁদো না মা ! কাদম্বিনী কপট হাসিতে মেয়েকেকরে -- বোকা মেয়ে ! কে বললে আমি কাঁদছি? এতো সুখের কান্না রে বোকা ! সব মেয়ের বে'র বিয়েতে মায়েরা কাঁদে ! একদিন কাদঁবি তুইও
--যেদিন তোর মেয়ের বে'হবে--বলেই বুকের ভেতরে একটা অজানা কষ্ট মুচড়ে উঠলো। কখনো কি তা হবে? মেয়ের কপালে চুমু খায় কাদম্বিনী। ফলমূল দুধ খাইয়ে বড্ড তৃপ্তি পেল। ভালো -মন্দ কিছু খাওয়ানো তো দূরে থাক দু'বেলা দু মুঠো ভাত জোটানোও দায়। শিবনাথের ওপর ক্ষোভ প্রশমিত হয়।বুকের পরে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে অনেকক্ষন।
---কি গো বৌঠান! মেকে নিয়ে বসে থাকলে চলবে ? ওকে বিয়ের জন্যি তৈরী কত্তে হবে না
কো ?----
প্রেমলতার ডাকে কাদম্বিনী সম্বিৎ ফিরে পায়। মৃনাল কখন যে মায়ের বুকের মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছে ও
টেরই পায় নি। মেয়ের ঘুমন্ত মুখটা দেখে আবারো জলে চোখ ভিজে যায়।
--কি গো এতদিন মার্ সাতে রইলে কিচুই শেকো নি কো?
এমন দিনে মার্ চোকের জল ফেলতে আচে ?-- কাদম্বিনী
আঁচলে চোখ মুছে তাড়াতাড়ি মেয়েকে ডাকে --মা রে -মা ওট না মা ! লগন বয়ে যাচ্চে ! ওট মা ! --- মৃনাল চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে। মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বাইরে গিয়ে দ্রুত কলতলা থেকে মেয়েকে মুখ হাত ধুইয়ে ঘরে নিয়ে আসে।
--ঠাকুর ঝি! কাপড় আর সাজের তত্বগুলো একটু একানে নে'
আসবে ? ---প্রেমলতা কোন কথা না বাড়িয়ে তত্ব আনতে বেরিয়ে যায়। কাদম্বিনীর বুকের ভেতর হু হু হুতাশন। কাল থেকে মৃনাল পর ঘরে চলে যাবে। প্রেমলতা সব তত্ব নিয়ে ঘরে ঢোকে।
--বৌঠান! তাড়াতাড়ি করো -বরযাত্রী এলোই। তোমায় জামাই বরণ কত্তে হবে না ?
--হ্যা গো! তাইতো ভুলেই গেচিলাম -
--শোনো! ওকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুচিয়ে তৈরী কর। যেন শোশুর বাড়ির লোকেদের চোক কপালে ওটে --আমি ওদিকটা দেকি।-----বলেই প্রেমলতা প্রস্থান করে।
--মা তুমি যাবে না আমার সাতে?--মৃনালের চোখে কৌতূহল। কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না কাদম্বিনী।
--আমি ? মানে আমি -হ্যা যাবোতো --আমতা আমতা করতে থাকে।
--সত্যি গো মা ? কি মজা হবে তাইনা মা ? বাবা দাদারাও যাবে-জানো মা- পিসি বলচিল কত বড় বাড়ি কত খাওয়া দাওয়া। আমাদের আর কোনদিন উপোস কত্তে হবে না। তাইনা মা ?
---হ্যা তাই ! কিন্তু মা একন পিসিরা এয়েচে -মাসিরা আরো কত কুটুম এয়েচে। সবাইকে ফেলে যদি আমরা চলে যাই -তেনারা কি ভাব্বে বল দেকি। বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে হয়েচে বলে কত দেমাগ হয়েচে
জ্ঞাতি কুটুম ফেলে চলল মেয়ের সাথে। সবাই নিন্দে মন্দ করবে যে মা-তাই কি তুই চাস মা ? মৃনাল মাথা নাড়ে তাইতো একথা তো ও ভেবেই নি। কাদম্বিনী তাড়াতাড়ি কথা ঘোরায় --
-- এদিক ফেরত মা -আগে চুলটা বেঁধে তারপর বাকিটা সাজাই
--আমি ? মানে আমি -হ্যা যাবোতো --আমতা আমতা করতে থাকে।
--সত্যি গো মা ? কি মজা হবে তাইনা মা ? বাবা দাদারাও যাবে-জানো মা- পিসি বলচিল কত বড় বাড়ি কত খাওয়া দাওয়া। আমাদের আর কোনদিন উপোস কত্তে হবে না। তাইনা মা ?
---হ্যা তাই ! কিন্তু মা একন পিসিরা এয়েচে -মাসিরা আরো কত কুটুম এয়েচে। সবাইকে ফেলে যদি আমরা চলে যাই -তেনারা কি ভাব্বে বল দেকি। বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে হয়েচে বলে কত দেমাগ হয়েচে
জ্ঞাতি কুটুম ফেলে চলল মেয়ের সাথে। সবাই নিন্দে মন্দ করবে যে মা-তাই কি তুই চাস মা ? মৃনাল মাথা নাড়ে তাইতো একথা তো ও ভেবেই নি। কাদম্বিনী তাড়াতাড়ি কথা ঘোরায় --
-- এদিক ফেরত মা -আগে চুলটা বেঁধে তারপর বাকিটা সাজাই
এ যে স্বামীকে সে ভাল করে দেখেই নি । তার জন্য এতসব কেন ? সে খুব সমীহ করেই চলে সবাইকে। সব অনুশাসন মেনেই চলে। তবুও সবাই অসুখী। কেন জানে না ছোট্ট মেয়ে মৃণাল। একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে যেন দম বন্ধ হয়ে হয়ে – চোখ খুলেতেই দেখে ওর ভাশুর ওর ওপরে চড়ে ওরকাপড় খোলার চেষ্টা করছে । ভয়ে হাত পা অসাড় –চিৎকার করে “বাচাও বাচাও ! আপনার পায়ে ধরি ছেড়ে দিন” কেউ শোনে না মৃণালের ডাক বা শুনেও শোনে নি।আঁচড়ে কামড়ে বিক্ষত ধর্ষিতা রক্তাক্ত মৃণাল!রক্তিত শিশু মন। শাশুড়ির কাছে বিচার চাইতে গিয়ে ফিরে আসে শাশুড়ির ভৎসনায় “যাক সংসারে কোন কাজেতো আসলে--আর বলে রাখি বাছা!একথা যদি পাঁচ কান হয়-মেরে ওই কুয়োতে ফেলে দেব"। জানে না মৃণাল কি উত্তর দেবে?-প্রতি রাতে বারংবার ধর্ষিত হওয়া ছাড়া। প্রতিদিনের ধর্ষিতা মৃনাল একদিন প্রতিবাদে মুখর হয়। প্রতিদানে পোটলা সহ গৃহচ্যুত হয়। অভাবী পিতৃগৃহে স্থান হয় না। তবুও কষ্ট করে কিছু টাকা জোগাড় করে একটা ট্রেনে চাপিয়ে দেওয়া হয় মৃনালকে। সে জানে না তার গন্তব্য স্থান। ক্লান্ত দেহ- মন নিয়ে, নানা ভাবনা চিন্তা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে একটা মিষ্টি ডাকে “বেটি উঠো বানারাশ আ গ্যায়া”
এই প্রথম
মায়াভরা পরশ ও মধুর ডাকে ঘুম ভাঙে মৃণালের। বেশ কিছুক্ষন এই ঘোরের আবেশ যেন কাততেই
চায় না । আরাব সেই মিষ্টি ডাক “বেটি উঠো বানারাশ আ গ্যায়া” । চোখ কচলাতে কচলাতে
উঠে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে মায়াময় এক মধ্যবয়সী শ্বেত বসনা এক নারী। অর মতই
মাথার ছুলগুলো ছোট করে কাটা, গলায়
রুদ্রাক্ষের মালা। কি যেন বলছে –মৃণাল বুঝতে পারে না ।এ ভাষাতো তার চেনা নয়।আর
জায়গা? সেও তো তার অচেনা।বাবা ট্রেনে
বসিয়ে জল আনতে গেল আর তো ফিরে এলো না।এ কোথায় এসে পড়লো সে । চারদিকের মানুসগুলিও
বাংলাদেশের মানুসের মত নয়। যেমন বিচিত্র দেখতে তেমনি আজব ভাষা। লাল জামা পরা কতেক
লোক মানুসের বাক্স পেটারা টানাটানি করছে। সবাই কেমন যেন তাড়াহুড়োয় পারলে ওকে
মাড়িয়ে চলে যায়।একজন তো কি খুব রাগ হয়ে কি যেন বলে মৃণালকে ঠেলে ট্রেনের জমিনে
ফেলে দিল । ভিত সন্ত্রস্ত মৃণাল এক কোনে বসে কান্না জুড়ে দিতেই সেই মহিলা বুকে
জড়িয়ে ধরে বলে “কয়ি ডার নেই! ম্যায় হু না! ঘাবরাও মাত” । মৃণাল তার কোন বোঝে না
কিন্তু তার বুকে নির্ভরতা খুঁজে পায় । দুহাতে আঁকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বলে
“বাবা! আমার বাবা কই? বাবা
যে জল আনতে গেল আর ফিরল না । আমি কোথায়? এরা
কারা? বল না গো তুমি কে? আমি ....” কথাটা শেষ করার আগেই ছোট্ট মানুষটার গলা বুজে আসে
না । সেই শ্বেত বসনা নারী ভাঙা ভাঙ্গা বাংলায় বলে – “কিচু ভায় নেই হাম আচি
না-একদাম ডারাবেনা না মা” । আশ্চর্য ব্যপার মহিলা একবারও জিজ্ঞেস করেনি- কে ও? বাবা কই? কেন
এখানে কেন? শুধু বুকের মধ্যে আরও জোরে চেপে
ধরল । মৃণালকে দেখি সে বুঝতে পরেছিল ওর বাবা ফিরবে। মৃণালের ভেতর তার অতিতের
প্রতিচ্ছায়া পায় । তাকেও একদিন এই ভাবে ট্রেনে চাপান হয়েছিল সেই থেকেই চলছে জবন
নানার উতরাই পেরিয়ে। ভিড়টা একটু কমতেই নিয়ে ট্রেনথেকে নিচে নামে কিন্তু মৃণালকে
বুক থেকে মানায় না । এই কাহিনীর মৃণালের সাথে ওয়াটার ছবির ছুয়িয়ার সাথে অনেক মিল।
আসলে সময় সমাজ দেশ বদলায় শুধু বিদলায় না মেয়েদের জীবন।সেখনে মৃণাল আর চুইয়া
মিলেমিশে একাকার। ক্রমশঃ
মৃণালকে বুক থেকে নামায় না |
সানজিদা রুমি কর্তৃক গ্রথিত http://www.alokrekha.com
দারুন ! এখানে বেগম জান ও চুইয়ার জীবনের সাথে মিল গল্পকে এক অন্য মাত্রা দান করেছে। খুবই সুন্দর উচ্চমানের লেখা। আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভ কামনা সানজিদা রুমি।
ReplyDeleteদারুন ! বেগম জানের গল্প এক নতুন মাত্রা পেয়েছে এই লেখায়। সানজিদা রুমিকে যত প্রশংসা করি কম। লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDeleteএত প্রাণবন্ত লেখা যেন চলচিত্র দেখছি ! বাকি লেখার অপেক্ষায় রইলাম! মঞ্তা সেন্
ReplyDeleteসানজিদা রুমির বেগম-জানের জীবনে কাহিনী-এক বিচিত্র "কাহানী" !লেখাটা এত অনবদ্য।যত-ই প্রশংসা করি কম।সানজিদা রুমির প্রতিটি লেখা সব সময় বিস্তারিত তথ্যবহুল। যা আমদের দীপ্ত প্রজ্ঞা দান করে। অনেক অনেক ধন্যবাদ!
ReplyDeleteকত কিছু জানতে পারি আলকরেখাইয়,তাই আমার প্রতিদিনের সঙ্গী ,অনেক অনেক ভাল লাগে অজানা কথা জানতে পারে। সানজিদা রুমির জমিদারির ইতিকথা!পড়ে মনে হল কত ক=ই অজানা।এখন আমাদের প্রজন্জ-এর ইতিকথা জানা খুব প্রয়োজন। সানজিদা রুমির লেখা গুলো ব্যতিক্রম ধর্মী ও তথ্য সম্বলিত। অনেক ধন্যবাদ!
ReplyDeleteসান জিদা রুমির লেখা বরাবরই অন্য ধাঁচের।যা মন মননের প্রজ্ঞা দান করে। প্রেমের এই আকিঞ্চন সত্যিই প্রশংসার দাবীদার । অনেক ভালবাশা ও শুভকামনা আরও ভাল লিখুন। আগামী লেখার অপেক্ষায় মেখলা স্যান্নাল
ReplyDeleteসানজিদা রুমি বেগম জানে'র কল্প কথা এক উন্নত অসাধারন উচ্চতাদান করেছেন।।অধীর আশায় থাকলাম বাকিটা পড়ার জন্য।
ReplyDeleteঅর্পুব ! মনে হচ্ছে ছায়াছবি দেখছি! ছবি গুলো যেন সত্যি মৃণাল!আর ভাষার প্রয়োগ অনবদ্য ! আমি সানজিদার উত্তর উত্তর সাফল্য কামনা করি!ভাল থেক! সুস্থ থেক! আরো অনেক অনেক লেখ! সেলিনা হেসেন
ReplyDelete