বাইরের পারাবারের সেতু বা মেল বন্ধন এই বারান্দা
সানজিদা রুমি
আমার নানী বাড়ী “আমেনা মাঞ্জিল”- গেন্ডারিয়া,শরাফত গঞ্জ লেন-এ। এখানেই আমার জন্ম -এখানেই নাড়ী পোতা-এখানেই আমার বেড়ে ওঠা। শৈশব থেকে কিশোরী – কিশোরী থেকে যুবতী।
শৈশব থেকে কিশোর কাল অব্দি এই বারান্দাই ছিল আমার খেলার স্থল। সে পুতুল খেলাই হোক-- এক্কা দোক্কা বা প্রায় সমবয়সী ছোটমামার সাথে লগী দিয়ে ঘুড়ি ধরা।অথবা সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে দু’ আনা দামের বাক্সের আইস্ক্রিম না হাওয়াই মিঠাই খাওয়া হোক। ১লা বৈশাখে মেলার পসরা বহন করা বাচ্ছাদের টমটম গাড়ী বা বাঁশীর বেসুর সুর শুনতে দৌড়ে বারান্দায় ছুতে যাওয়া।এক দৌড়ে বারান্দায় এসে দেখা বর যাত্রা বা শব যাত্রা দেখা। বাইরের পারাবারের সেতু না মেল বন্ধন ছিল এই বারান্দা।
"তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না "মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি-৫২'সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন রত ছাত্রদের বুকে গুলি চালানো হয়৷ রফিক, সালাম, বরকতসহ অনেকে শহিদ হন৷ সেই তার সঙ্গে সঙ্গেই রচিত হয় বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের পটভূমি৷“আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি-আমি কি ভুলিতে পারি” প্রভাত ফেরি দেখা সারা রাত এই বারান্দায়। কাদামাটি গায়ে মেখে মুক্তিকামী যোদ্ধা বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অথবা অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীর মূর্তি সেজে জয় বাংলার মিছিল দেখা। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক৷ মুক্তিযুদ্ধের জন্য আওভান,ওষুধ,খাবার,কাপড় সংগ্রহ করা,সেবা করা,চিকিৎসা করা, এমন কি অস্ত্র শিক্ষার জন্য চাঁদা তোলা ।শুধু তাই নয়, স্বাধীন বাংলার জন্য শিল্পীদের মুক্তির গান গেয়ে অবরুদ্ধ, পীড়িত, নির্যাতিত নারী-পুরুষকে জাগিয়ে তোলা ।সেই আলোর মিছিল দেখা।এই বারান্দার কোনে লাঠি দিয়ে ২৩শে মার্চে মামার সাথে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তলন করা ।
তারপর ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের ভয়াল ২৫শে মার্চের সেই রাত ছিল সত্যিই এক কালো রাত্রি।ইতিহাসের এই দিনে বাংলার বুকে নেমে আসে কালরাত্রি।পাশবিকতা,নৃশংসতা আর হিংস্রতার কালো থাবা। একাত্তরের এই রাতে স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী হিংস্র হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকহানাদারবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ণ সমর সজ্জায় রাত ১০টা অতিক্রম করার সাথে সাথে শুরু করে সারা দেশব্যাপী পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা। সামরিক ভাষায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত ছিল এই হত্যা-অভিযান।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই বর্বরোচিত হামলায় বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে দেখেছিল উন্মত্ত পাক বাহিনীর গণহত্যাকাণ্ড। মধ্যযুগীয় কায়দায় হানাদাররা রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ,ইপিআর সদর দফতর ও ঢাকা বিশ্ব- বিদ্যালয়সহ গোটা ঢাকা শহরে চালায় হত্যাযজ্ঞ এবং অগ্নিসংযোগ। মধ্য রাতের পর গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।গ্রেফতারের আগে তিনি দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান।২৫শে মার্চের কালো রাতের বেদনাদায়ক ঘটনা সমগ্র জাতিকে শিহরিত করে। নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে পাখির মত গুলি করে হত্যা করে সেদিন মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠ স্তব্ধ করা যায়নি।২৫শে মার্চের ভয়াবহ সেই কালো রাতের হত্যাযজ্ঞ বাঙালিকে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রণোদনা যোগায়।
রাত ১টা বাজার সাথে সাথে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানা ইপিআর হেড কোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টারে গার্ডে ১৮ জন বাঙালি গার্ড থাকলেও তারা পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পায়নি।
পিলখানা আক্রমণের সাথে সাথে রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারি বাজারসহ সমগ্র ঢাকাতেই শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ। বিভিন্ন এলাকাতে যথেচ্ছ হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করে চলে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী।
মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে মার্কিন ট্যাংক, সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল), জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতা। শহীদ হন কয়েক শ’ ছাত্রছাত্রী। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয়জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। আরও হত্যা করা হয় সাধনা ঔসাধনালয়ের জোগেস বাবু সহ আরো অনেককে হানাদারেরা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে গুলি ছুড়ে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ, গরীব মানুষকে। মেডিক্যাল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুড়ে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষ। রাজারবাগে পুলিশের বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তাদের সামান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই। ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের মুখে এ প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো সদর দপ্তর।
২৬শে মার্চে এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে শাঁখারী বাজার, তাঁতী বাজার,মালাকা টোলা সুত্রাপুর, হোটেল আরযু ,শ্যাম বাজারে দাউ দাউ করে পাক আর্মি ও তাদের দোসরদের দেওয়া আগুনের লেলিহান শিখা দেখা-৭১’র মার্চের শেষের দিকে যশোর রোডের মত শারি শারি মানুষের ঢল গ্রামের পানে ধাওয়ার দৃশ্য। মনে পড়ে হানাদার বাহিনীর পায়ের শব্দ, গোলা-গুলির ভীতিকর আওয়াজ৷ লুকিয়ে লুকিয়ে পাক আর্মিদের বুটের শব্দ শোনা।
মুক্তিযুদ্ধ একদিকে যেমন স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তেমনই কেড়ে নিয়েছে বহু বুদ্ধিজীবী, আত্মার আত্মীয়দের৷বহু নারী হয়েছেন স্বামী,সন্তান হারা৷ অনেকের কাছেই যুদ্ধের স্মৃতি হয়ে উঠেছে এক তমসাচ্ছন্ন রাত্রি।এই বারান্দা তার বিমূর্ত সাক্ষী হয়ে আজ দাঁড়িয়ে আছে।
পৃথিবীর অনেক দেশ স্বাধীন হলেও অনেকের বাংলাদেশের মত মহান কালজয়ী সমৃদ্ধশালী স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নেই। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম নিজের চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি ফলে অনেকের বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের এই সংগ্রাম এবং হাজার ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর গৌরবময় দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার যেদিন বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে নিজের মানচিত্র প্রতিষ্ঠা করে বিজয় অর্জন করেছিল। বীরের দেশে সবাই যে বীর প্রমাণ দিলেন তিনি
এই যে স্বদেশ-স্বাধীনতা যাদের ত্যাগে আসা তাদের সবার জন্য আমার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা...কবির এই কবিতার মতো করে আমিও শ্রদ্ধা জানাই সব বীরকে। যেই বীরেরা তাদের রক্ত দিয়ে অর্জন করেছেন স্বাধীনতা; যেই বীরেরা তাদের জীবন দিয়ে অর্জন করেছেন আমাদের বিজয়। সেই বিজয়; সেই স্বাধীনতা বাংলা ও বাঙালির গর্ব। ১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছে এই মহান স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনি অবদান রেখেছে এ দেশের শিশু-কিশোররা, যারা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল। যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার আনন্দ মিছিল ও উৎসব দেখেছি এই বারান্দায়। ইতিহাসে বার বার উচ্চারিত হবে বীরত্বগাথা সময়ের কথা।আমরা সেই সাহসের রাস্তায় এগিয়ে গেছি বিনম্র ভালোবাসায়...।
এভাবেই এই বারান্দায় পেরিয়েছে ইতিহাস সামাজিক সংস্কৃতির নানান অধ্যায়।সময়ের সাথে সাথে বয়সের পদচারনা এগিয়ে চলেছে সমান তালে।সেই কিশোরী মেয়েটি পদার্পণ করেছে যৌবনে।
বয়সের সাথে সাথে যৌবনের উচ্ছাসের সাথে সাথে বারান্দায় জাওয়ার উপর প্রহরা হল আরপিত নিয়মের বেড়াজাল । বারান্দায় যাওয়া মানা হলেও সেই বয়সে নিষেধ ভাঙ্গাটাই নিয়ম ছিল। কত বকা কত গঞ্জনা সয়েছি খোলা চুলে বারান্দায় দাঁড়ানোর জন্য। সকল অনিয়মই যেন ছিল নিয়ম। তবুও কত সুন্দর ছিল সে সময়টা। কত ছোট ছোট কথায় কত আনন্দ ছিল। বিমূর্ত ওই জীবনটাই ছিল মূর্তিমান। মৌনতার সুতোয় বোনা একটি রঙ্গিন চাদর-সেই চাদরের ভাজে ভাজে নি:শ্বাসেরই ছোঁয়া ছিল ভালবাসা, আদর।কামনার গোলাপ রাঙা সুন্দর ওই দিনগুলো নীরব মনের বর্ষা,আনে শ্রাবণ, ভাদর।সেই বরষায় ঝড়ো ঝরে নি:শ্বাসেরই ছোঁয়া।ঝরে পড়ে ফুলেরমত মিষ্টি কথার প্রতিধ্বনি,ছড়াতো যেন আতর,যেন ছড়ায় আতর।পরিধিহীন শংকামুখি নির্মল অধর কম্পন কাতর, কম্পন কাতর।নিয়ম ভাঙ্গার নিয়ম এ যে,নিয়ম ভাঙ্গার নিয়ম এ যে- থাক না বাধার পাথর।কোমল আঘাত, প্রতি-আঘাত,কোমল আঘাত, প্রতি-আঘাত,রাত্রি নিথর কাতর।দূরের আর্তনাদের নদীর ক্রন্দন কোন ঘাটের দূরের আর্তনাদের নদীর ক্রন্দন কোন ঘাটের ভ্রূক্ষেপ নেই, পেতাম আলিঙ্গনের সাগর।সেই সাগরের স্রোতেই ছিল নি:শ্বাসেরই ছোঁয়া,ছিল ভালবাসা, আদর।
সানজিদা রুমি কর্তৃক গ্রথিত
http://www.alokrekha.com
এটি একটি বারান্দার আত্মকাহিনী ! যেখানে একটি মেয়ের কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে ওঠা! পাকসেনাদের অত্যাচার ! ভাষা আন্দোলন ! স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধনীতা প্রতীত হয়েছে ! অপূর্ব সুন্দর একটা লেখা!~ সানজিদা রুমীর বিশেষণ!
ReplyDeleteএই রুমী আমার চির চেনা! আজানু লম্বিত _চুল !অপরূপা রূপ! সর্ব গুনের অধিকারী রুমী আপণ গুনে গুণান্বিত! এই লেখার যত প্রশংসা করি কম! অনেক অনেক ভালবাসা ও শুভ কামনা রুমী! বেরা
ReplyDeleteশুধু সুন্দর বললে কিছুই বলা হবে না ! সত্যিকার অর্থে প্রাণ কাড়়া লেখা!যত প্রশংসা করি কম্! অনেক শুভ কামনা !
ReplyDeleteবাইরের পারাবারের সেতু বা মেল বন্ধন এই বারান্দা
ReplyDeleteসানজিদা রুমি।
চমৎকার প্রবন্ধ। আমার ও ছোটবেলার কথা খুব মনে করিয়ে দিলো।
Very creative and original thought.
Wonderful naration .
সানজিদা রুমিকে অভিনন্দন
বাইরের পারাবারের সেতু বা মেল বন্ধন এই বারান্দা
ReplyDeleteঅপূর্ব লেখা। খুব ভালো লাগলো।
লেখিকাকে শুভেচ্ছা।
একটা সামান্য বিষয়ের উপর লেখা কালক্রমে' র ধারায় যে এতো চমৎকার হতে পারে এই "বাইরের পারাবারের সেতু বা মেল বন্ধন এই বারান্দা" লেখা তার প্রমান। সানজিদা রুমিকে অনেক অনেক সুভানন্দন।
ReplyDelete"বাইরের পারাবারের সেতু বা মেল বন্ধন এই বারান্দা"অপূর্ব লেখা।খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteলেখিকা সানজিদাকে শুভেচ্ছা। আরো এমন ভালো লেখার প্রত্যাশায় রইলাম! নাসরিন জাহান
সানজিদা রুমির লেখা বরাবরই অন্য ধাঁচের। মন মননের প্রজ্ঞা দান করে যা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার । অনেক ভালবাশা ও শুভকামনা আরও ভাল লিখুন
ReplyDelete