অজন্তার দিনলিপি
মেহরাব রহমান
এখানকার সময় যেন দ্রুতগামী পাতাল রেলগাড়ি ।
বাহ্যত আছি বেশ ।
রঙিন ঘুড়ি সুতা কেটে নিরুদ্দেশ ।
নাটাই-হাতে আকাশের শূন্য ক্যানভাসে চেয়ে থাকি রাত্রি-দিন।
নিজ বাসভূম ছেড়ে সোনার হরিণ খোঁজা ।
এই পরবাসে বন্দি এ-জীবন ।
আমি কি পাব না আর কাকডাকা ভোর?
কলের পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে
সেলফোনে বেজে ওঠে কিচিরমিচির
রৌদ্র-দাপটে কখন বরফ গলে
মেঘের দিন থেকে বৃষ্টি নামে
হিসেব মেলাতে হিমশিম ।
কোনো কোনো জোছনায়
দাঁড়াই ঝুল-বারান্দায় ।
অজস্র হাইরাইজের ফাঁক থেকে
ঝুলে-থাকা পূর্ণিমার হাইব্রিড চাঁদ
ভুল মনে হয়; খুব পর পর, ব্যথা ঢেলে দেয় ।
মাঝে মাঝে দীনতা পেয়ে বসে
কোথায় সেই ভরাবর্ষার আষাঢ়ে গল্প?
চৈত্রের অলস দুপুর?
অভাবের ফরিস্তিি অনেক লম্বা,
স্মৃতির মলাট খুলেই দেখা যায়,
মহিলা সমিতির মঞ্চনাটকের ফাঁকে ফাঁকে
জম্পেশ আড্ডা : বোনাসের টাকায় ঈদ উৎসব;
ইস্টার্ন প্লাজা , নিউমার্কেট, বেইলি রোড ঘুরে ঘুরে হুলস্থূল
কেনাকাটা। সময়মতো ফুচকা-চটপটি, আর ঠান্ডা
লাচ্ছির স্বাদ চেখে নেয়া ।
এখন আমার প্রিয়রং শাড়িগুলো,
নাকের নোলক, কানের দুল, বাহারি চুড়ি,
ঝকমারি অলংকার মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে,
গুমরে কাঁদে নিথর আলমারির কারাগারে ।
মাঝে মাঝে পরা হয়; হঠাৎ কখনও ।
শহরময় আজ তুষারপাত
তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক অনেক নিচে ।
ওরা কেউ নেই ঘরে;
খাঁ খাঁ যন্ত্রণা, বিষাদের ভার
বুকের পাঁজর ভেঙে চুরমার। মধ্যদিনে
গোট্রেনটা বিকট গোঙানির শব্দে তীক্ষ্ন হুইসেল
দিয়ে এ শহর ফেলে চলে যায় অন্য শহরে ।
সময়ের বড্ড টানাপোড়েন;
শয়নকক্ষের ঘুম বাকি থেকে যায় ।
কিছুটা সারতে হয় রেলের কামরায় ।
এমনকি বৈরী আবহাওয়ায়
আমি চলে যাই কাজে
তখন আমার আদর, আমার ভালোবাসা ঘরে ফেরে;
ওর সাথে দেখা হয় বটে। রোজ বিছানায়। গভীর রাতে
কিংবা ভোরে। ঘটনার মতো ঘটে যায়
অচিরাৎ উষ্ণ সাক্ষাৎ ।
আমাদের যৌথ জীবন বড্ড এলোমেলো
এই প্রবাসে পরবাসে ।
তবু কিছু-কিছু ভালোলাগা আছে। ভালোলাগা থাকে ।
প্লাষ্টিক কার্ড গিলে খায় জাদুকর
উগলে দেয় কড়কড়ে, তরতাজা নোট ।
আহ! ডলারের মৌ মৌ ভালোলাগা গন্ধ বুকে
নিয়ে ছুটে যাই মলে। এরপর
ঘুরে-ঘুরে টুকটাক কেনাকাটা ; কখনও আবার
টিমহর্টনসের অণুবীক্ষণ আড্ডা,
ডাবল-ডাবল কফি হাতে সাবওয়েতে ছুটে চলা ।
পিজ্জা-পিজ্জার উত্তাপে গলে-যাওয়া বুদবুদ চিজ ও
অলিভ মেশানো গরম পিজ্জার স্বাদ ভালো লাগে ।
কিছুটা সুখের সুবাতাস দেয় ড্যানফোর্থের বাংলা পাড়া ।
অনেক চেনা মুখ দেখা যায়; কথা হয় কথায় কথায় ।
অথচ কোথায় যেন গড়মিল। কী যেন বলতে চায়,
হয় না বলা, কেন যে পাঁচিল তোলে, আড়াল
করে সব। দুঃখ নড়ে উথাল-পাথাল
প্রাণের ভেতর।
মাটির সোঁদা গন্ধ নিয়ে
হিমেল শীতল শীতের হাওয়ায়
নাঙা পায়ে ঘাসের কুয়াশা মাড়িয়ে
বেড়ে উঠেছি, বৈশাখী ঝড়ের দাপটে গড়েছি
মনের সুঠাম কাঠামো। আমি আজ
মুকুল থেকে বৃক্ষ ।
এই কারাবাসে, এক জীবনে
কী করে বদলাব এতসব?
নিয়তি, আমার ছেলে
এখানে সাঁড়াশি নোঙর।
যদি বলি এইসব ছেড়েছুড়ে চলে যাব,
ফিরে যাব ঘরে; হাসি-হাসি মুখ করে
বলে যায় ‘কেন নয়, যাব যাব’
জানি আমি, কোনোদিনও যাবে না সে
শেকড়-সন্ধানে ।
পরবাসে সবাই রেসের ঘোড়ার মতো;
সপ্তাহান্তে কিনি লটারির টিকিট ।
মিলিয়ন ডলারের স্বপ্নে বিভোর
চোখের সামনে ভাসে প্রাণের স্বদেশ ।
এখানে সুলভে নারীর বিকিকিনি ।
মদমত্ত ওয়াইনের জৌলুস ।
তড়িঘড়ি মিলে যায় কস্তিরি গাড়ি
হাত বাড়ালেই বাড়ি ।
দীর্ঘমেয়াদি ঋণ
শোধ দিতে দিতে
একদিন চিতার আগুনে জ্বলা
অথবা মাটির অতলে মিশে যাব জানি ।
আগামীর হাতে থেকে যাবে
অজন্তার রক্তেলেখা এই দিনলিপি ।
http://www.alokrekha.com
প্রবাসী জীবনের চিত্র দারুণভাবে তুলে ধরেছেন প্রিয় কবি মেহরাব রহমান। আমরা যারা বিদেশে থাকি তারা এই কবিতায় লেখা প্রতিটি শব্দ অনুভব করতে পারি। কবিকে অন্তরের ধন্যবাদ।
ReplyDeleteআমার কবিতা ভালো লেগেছে জেনে
Deleteএকধরণের সুখ বোধ করছি
অনেক কৃতজ্ঞতা
প্রবাসী যান্ত্রিক কারাগারে রুদ্ধ জীবনের ছবি তুলে ধরেছেন কবি মেহরাব রহমান "অজন্তার দিনলিপি" কবিতায় ।ভাব বিন্যাস লেখাটিকে আরো প্রাণবন্ত করেছে। আমরা যারা বিদেশে থাকি তারা এই কবিতা অনুভব করতে পারি। কবিকে ধন্যবাদ।
ReplyDeleteমলয়দা আপনি বিদেশে কোথায় থাকেন ?
Deleteএলেখা আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থেকে লেখা
মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে লেখা
আপনার ভালোলাগা আমাকে উজ্জীবিত করেছে
খুব সত্য কথা। প্রায়শঃই ভাবি কিন্তু বলতে পারিনা।দারুন অনবদ্য কবিতা বরাবরের মতই! অপূর্ব ভাব ! অনন্য উপমা! শব্দের মুক্তা মালা! অনেক ধন্যবাদ কবি মেহরাব রহমান।
ReplyDeleteআহসান হাবিব ভাই আপনার ভালোলাগা
Deleteআমার কাছে অনেক পাওনা
অন্তহীন কৃতজ্ঞতা
এই কবিতার অলংকরণে যে চিত্রকর্মটি ব্যাবহার করা হয়েছে তা আমার খুবই পছন্দের একজন চিত্রশিল্পী নুরুন্নাহার সুপ্তির আঁকা ছবি l
ReplyDeleteতিনি টরন্টোতে বসবাস করেন
খুবই অনন্য পেইটিং। কবি আপনাকে ও চিত্র শিল্পীকে অনেক অনেক শুভ কামনা
Deleteমমতাদি কৃতজ্ঞতা
Deleteকবিতার গঠন বা ছন্দ শুধু নয়। এই কবিতার ভাব ও বিষয়বস্তু অনবদ্য। প্রবাস জীবনের স্পর্শকাতর আকুতি ও বর্ণনা অপূর্ব। কবি মেহরাব রহমান বরাবরই একজন অনিন্দ্য কবি। তাঁর জন্য অনেক শুভ কামনা রইলো।
ReplyDeleteআনিস ভাই আপনার প্রশংসা
Deleteআমার পুরস্কার
ভালো থাকবেন
সৌভাগ্য আমার, আমার প্রিয় কবি মেহরাব রহমান যে পটভূমিতে রচনা করেছেন অজন্তার এই দিনলিপি তার পুরোটাই আমার জানা পারিপাশ আর আমার যাপিত জীবনের অংশ! আর সেই কারণে দারুণ চমৎকার এই কবিতা পড়ে ভালোলাগার অনুরণনটা শিহরিত করলো হৃদয়ের অনেক গভীরে, অনেক বেশী করে ! কবি মেহরাব রহমান কবিতা দিয়ে ছবি আঁকায় ভীষণ সিদ্ধহস্ত ! তাঁর কবিতা পড়ে আমি বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে পারি আরো বেশী করে ! সুললিত শব্দের সুবিন্যস্ত বিন্যাসে তাঁর স্বচ্ছন্দতা একজন কবিতা পাঠকের জন্যে অনেক বড় উপহার! আর সেই সাথে তাঁর কবিতা জুড়ে জীবন বোধের যে গভীরতা আর তাঁর আধ্যাতিক উপলব্ধির যে ছোঁয়া পাই তা অনেক মূল্যবান!
ReplyDeleteআশরাফ আপনার ভালোলাগা আমার রসদ এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায় l
Deleteকারণ আপনি এমন একজন মানুষ যাঁকে খুব সহজে কিছু ভালো লাগানো যায়না l
আমি আধ্যাত্মিক পথের একজন
পথিক মাত্র l
‘অজন্তার দিনলিপি’ পরবাসী জীবন, টানাপড়েনের বাস্তবতা আর ফেলে আসা মাটির শেকড় খুঁজে মনের নিভৃতে গুমরে কাঁদার হৃদয় ছোঁয়া কাহিনী ।
ReplyDelete“... প্রিয় রং শাড়িগুলো,
নাকের নোলক, কানের দুল, বাহারি চুড়ি,
ঝকমারি অলংকার মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে,
গুমরে কাঁদে নিথর আলমারির কারাগারে " - অনন্য এই অভিব্যক্তি! বাস্তবতার নিরিখে এমন বর্ণনা সত্যি অসাধারন! হৃদয়ের রক্তেলেখা এই দিনলিপি যেন কবির যেন সবার! ধন্যবাদ কবিকে!
আপনার আন্তরিক মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ঋতু মীর
Delete