দাগ
মেহরাব রহমান
নতুন জামায়
দাগ, কান্না পাচ্ছে
নতুন
গাড়িতে দাগ, হৃদয় চিরেছে
এরকম
কিছু দাগ মুছে যায়
কিছু-কিছু আবছা হয়ে থেকে যায়, থেকে যায়।
ঈশ্বর
যদি কারুকাজে আঁকেন জন্মদাগ
ইচ্ছে
হয় বড্ড যত্নে তাকে
বাঁচিয়ে রাখি।
দাগে-দাগে সব ছেয়ে গেছে
খুব ভোরে যদি পথ্রম বাস পাওয়া যায়
তখন আমি রাজাধিরাজ, চেপেছি সিংহাসনে
নিভাঁজ কাপড়ে লাগে না এক ফোঁটা দাগ।
পড়ে না আত্মায় কালি। তুমি চলে গেলে
আমি অন্ধকারে শীতল চাটাইয়ে পড়ে থাকি
মশার অস্তিত্ব নিয়ে একা একা
আমি শুয়ে থাকি। আমার নিঃসঙ্গতার
সাথে যুদ্ধ করে অসংখ্য মশা মরে থাকে
চাটাইয়ে পড়ে দাগ।
মৃত্যুর দাগ কার ভালো লাগে?
মানুষের পচা রক্ত খেয়ে কেন ওরা মরে?
সাদা কাফনে দাগ পড়লে কষ্ট পায়
কাফনের অন্তরালের মানুষ।
চুমুর ছলে তুমি যখন কামড়ে দাও গালে
এঁকে দাও রক্তাভ দাগ, তুমি চলে গেলে
আয়নায় বারবার দেখি সেই রোমান্টিক দাগ।
মা তুমি যে মোরগ দো-পেঁয়াজা শেষে
গরম তেলে পেঁয়াজ দাগিয়ে দিতে
সে-স্বাদ এখনও ভুলিনি আমি
ভুলিনি ছোটবেলার তেলের চঙের উপর পড়ে
ঠোঁটের সেই কেটে যাওয়া দাগ।
দাগ আমাকে অবিরত ফেরায় শৈশবের বিস্মৃত দিনে
এবং তোমার স্নেহের কোলে।
প্রাতঃভ্রমণের নাম করে মার্বেল খেলতে বসায়
সেই কবে বাবার দেয়া চড়ের দাগ
স্মৃতি হয়ে লালিত হচ্ছে গালে
সেই দাগ কত প্রিয় হয়ে ঘুমের মধ্যে
স্বপ্নে বাজায় তারসানাই।
জমির দাগ নম্বরের গণ্ডগোলে
মানসী হারাল তার প্রিয় মানুষ
গলাকাটা পচালাশ ভেসে ওঠে মাইনির বুকে।
এতসব দাগ ইচ্ছে করলেই কি ভোলা যায়?
মুছে ফেলা যায় একেবারে?
তার স্তনে ফুটেছে শুভ্র চেরি এবং রক্তকরবী
শিল্পী অতিক্রান্ত জৈবিক শরীর।
কটিতে সুগন্ধি রোদের খেলা
মননে সম্পৃক্ত ধ্যানমগ্ন নারী
অপরূপের বারান্দা ডিঙিয়ে যায়।
সন্তর্পণে দাগ কাটে, ইচ্ছে না থাকলেও
দাগ পড়ে যায়। দাগ শুভ্র করে
এবং নষ্ট করে।
আমি পুবে-পশ্চিমে তাকালে
উত্তর-দক্ষিণে পারি না এবং
দক্ষিণ-উত্তরে তাকালে পুবে নয়
এই অক্ষমতার জন্যে নিকটতম বন্ধুর
কথা শুনতে হয় কখনো কখনো।
একদিকের মানুষ
চারদিকে তাকাতে গেলে
স্নায়ুতন্ত্রে চাপ পড়ে
রক্তচাপ বেড়ে যায়।
অহেতুক পারি না- পারি না এতসব
আত্মায় কেবলই দাগ পড়ে।
বোধকরি ম্যাকিউলা ফুটো হয়ে গেছে
বোধকরি চারপাশে পড়েছে গভীর দাগ
পুরু কাচের চশমা-চোখে
কখনও আন্দরকিল্লাকে মনে হয় টাইগার পাস
টাইগার পাসকে বাদুড়তলা।
রৌদ্রদগ্ধ রিকশাচালকের পিঠে জমেছে
লবণের শুভ্র দাগ- হয়তো প্রেয়সী কিংবা
মায়ের আদরমাখা হলুদের ছোপলাগা
আঁচল সস্নেহে মুছিয়ে দিচ্ছে অষ্টপ্রহর
এই অনাকাঙ্খিত দাগ।
কোনো কাজ নেই অথচ কাজ নিয়ে এতই ব্যস্ত
সময় পাই না কবিতা শোনবার এবং কবিতা
পড়বার কি কবিতা লিখবারÑকবিতার
মতো সুকুমারভাবে লালিত করি না সময়
ভালোবাসা ভুলে জনারণ্যে শিকার করি নিরীহ
পাখি। তাই তো করিমন
কৈশোরের সীমানা পার না হতেই পাজামায়
রক্তাভ দাগ নিয়ে পড়ে থাকে এখানে-সেখানে
তার জীবন পরিব্যাপ্ত হলো দাগ এবং দাগে।
দাগ কত কলঙ্কের অথচ দাগ ছাড়া হয় না
তাবিজ তুমার হয় না সোনার গহনা। সিঁথির
সিঁদুরের দাগ বলে দেয় তার জানালার প্রাচীর
ভেঙেছে। দ্যা ভিঞ্চি দাগ দিয়ে এঁকেছে মোনালিসার
অপরূপ হাসি আর শাহজাহান তুমি গড়লে
তাজমহল। জেনেছ কি শ্রমিকের শতফোঁটা রক্তের
দাগ শতবার শতবর্ণে লেগে আছে, সেঁটে
আছে শুভ্র তাজের গায়। বলো কত দাগ মুছে
ফেলা যায়?
নিজের নখের আঁচড়ে কেটেছে বুকের ধার
হায় রে দাগ-কেউ ভেবেছে অন্য নারীর অন্য
মেঝেতে শুয়েছি আজ।
রং-করা তার নখের আঁচড়
মনের গহনে ফেলেছে দাগ।
পুব আকাশে হঠাৎ এলো
আলতা রঙের ছায়া এবং মেঘের দাগ
এ যেন এক বেলাশেষে
রাঙা বউয়ের অনুরাগ
মনে পড়ছে, মনে পড়ল
সেই মেয়েটির চোখের কোলের কৃষ্ণ দাগ।
তারই সঙ্গে কত কী যে সাঁটা আছে
প্রেমিক পুরুষ দোল খাচ্ছে
বুকের ভেতর-তারও ভেতর-আরও ভেতর
দগদগে এক রক্তজবা ক্ষতের দাগ
হায় রে দাগ! কেন তুমি মুছে যাও না?
কেন দূরে সরে রওনা?
কেন কেবল কাঁদাও এবং রাঙাও?
আমি অন্ধকারে কথা বলি।
অন্ধকারে ভালোবাসি।
অন্ধকারে বিরামহীন স্বপ্ন দেখি,
অন্ধকারে কৃষ্ণপাখির ছবি আঁকি।
আমি অন্ধকারে সাদাকালো কত দাগকে
মুছতে চাই, ভুলতে চাই
কালরাতের নষ্ট অতীত।
আলোকের পথের তীক্ষ্ণ দাগ
সকল আঁধার তলিয়ে রেখে
অজানা কষ্ট ভুলিয়ে দেয়;
উপচে পড়ে পূর্ণিমা রাত;
ঢেউয়ের তোড়ে পাড়ের ওপর
স্বর্গজনে ভাঙতে থাকে আলোর ফেনা
দাগ তুমি দাবানলে দগ্ধ করো এবং বাঁচাও।
দারুন বাস্তবতা "দাগ" কেবল একটা উপমা যা আমরা বহন করে চলেছি জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে। কবির সার্থকতা এখানেই তিনি যেভাবে কবিতায় তা ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিকে অনেক শুভেচ্ছা।
ReplyDeleteবিমূর্ত এক উপমা "দাগ" - দাগ অর্থ আঁচড় যা আমরা নেতিবাচকভাবে বিচার করি। কিন্তু কবি মেহরাব রহমান তাঁর "দাগ " কবিতায় অপূর্ব অভূতপূর্ব,সুনিপুনভাবে অংকিত করেছেন। কবির কাছ থেকে আরো এমন কবিতার আশায় থাকলাম। আলোকরেখাকে অনেক ধন্যবাদ কবি মেহরাব রহমানের এমন একটি চমৎকার কবিতা প্রকাশ করার জন্য।
ReplyDeleteকি অদ্ভুত অপূর্ব সুন্দর শব্দের খেলা। অভিনব ব্যঞ্জন ভাবের আদান। দারুন প্রতিভার কবি ! প্রাচুর্য্যের কবিতার সম্ভার! আলোকরেখাকে ধন্যবাদের অন্ত নেই এই কবিতার সন্ধান দেবার জন্য। কবি মেহরাব রহমানের কবিতায় আলোকিত হলাম ! ভালো আরো ভাল লিখুন! আরো ভাল থাকবেন !
ReplyDeleteশুধু বিবয়বস্তু নয় " দাগ" কবিতার ভাব প্রকৃতি,অলংকরণ , উদ্দীপনা,চিন্তন অনুধ্যায়,মাত্রা ছন্দের বাঁধন কবিতাকে অনন্যতা দান করেছে। এমন একটা কবিতা পরে খুব ভালো লাগলো যেন আরশিতে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। অনেক শুভেচ্ছা কবি মেহরাব রহমানকে।
ReplyDeleteঅনন্য অতুলনীয় বিষয়বস্তু ভিত্তিক এক অনবদ্য অনিন্দ্য কবিতা। অনেক শুভেচ্ছা কবি মেহরাব রহমানকে।
ReplyDeleteএত শত অর্থ যে হতে পারে আমাদের বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত একটি শব্দ আর সেই শব্দটিকে দিয়ে ব্যঞ্জনাময় অনবদ্য এক রচনায় পাঠকের মনে অনন্য ভালোলাগার অনুরণন সৃষ্টির যে সুচারু পরিবেশনা তা আমি মঞ্চে উপবিষ্ট শিল্পীর দিকে চেয়ে থাকা বিমোহিত এক দর্শক-শ্রোতার মতো উপভোগ করেছি আমার প্রিয় কবি মেহরাবা রহমান এর এবারের কবিতা! "দাগ"! দাগ শব্দটার সাথে এযাবৎ কালিমা, দুঃখ, বেদনা আর মলিনতার যে একটা অনুরণন মনে প্রভাব ফেলতো এখন থেকে তার অবসান হলো! এই সেদিন দুপুরে দরোজার কোণাটা আচমকা কপালের ঠিক মধ্যিখানে যে দাগটি সৃষ্টি করেছে তা নিয়ে যে অস্বস্তি আমার তার সবটাই গেলো কেটে। এখন সেটা যেন আমার "রাজটিকা"!
ReplyDelete