হেলাল হাফিজ ! এক জীবন্ত কিংবদন্তীর নাম
ঋতু মীর
“তাকানোর মত করে তাকালেই চিনবে আমাকে
আমি মানুষের ব্যাকরন
জীবনের পুস্পিত বিজ্ঞান
আমি সভ্যতার শুভ্রতার মৌল উপাদান...
আমাকে না চেনা মানে
মাটি আর মানুষের প্রেমের উপমা সেই
অনুপম যুদ্ধকে না চেনা "
-- হেলাল হাফিজ
এক
তিনি কষ্টের ফেরিওয়ালা! কবিতার প্রতি ছত্রেই তিনি কষ্টকে ধারণ করেন, কষ্ট তৈরি করে নেন, নিজের মধ্যে নিজেই! বিরহে নিমগ্ন এক সত্ত্বা, ‘দুঃখের’ আরেক নাম - কবি হেলাল হাফিজ ! জীবন, প্রেম, বিরহ, ভালবাসা, স্বদেশ এবং স্বাধীনতাকে যিনি কবিতায় এক সুরে বেঁধেছেন । বাঙলা কবিতার ভাব, রুপ, ছন্দ বিশেষতঃ ভালবাসার পূর্ণতা- অপূর্ণতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মানবিক কিছু বিষয় তাঁর কলমে পেয়েছে অনিন্দ্যসুন্দর লাবণ্য, পরিপূর্ণ শাশ্বত রুপ। প্রেমে ব্যর্থতা, বিচ্ছেদের কষ্টে তার কলমে জন্ম হয়েছে অবিস্মরণীয় প্রেমের শব্দ, বিরহীমনের চাওয়া এবং না পাওয়ার অকথিত সব বেদনা। যাপিত জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন কবিতার জন্য। কবিতাকেই করেছেন জীবনের ধ্রূবতারা । জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে অবিচল সিন্ধান্ত ছিল- অর্থ নয়, কবিতার ভালবাসায় মানুষকেই জমাতে চান নিজের আশেপাশে । কবিতা প্রেমী, কবিতা বোদ্ধা তার কবিতার যাদুকরী ক্ষমতায় হয়েছে মোহাবিস্ট আর কবিতা না বোঝা মানুষ কবিতায় আগ্রহী হয়ে হাতে তুলে নিয়েছে কবিতা। উচ্ছল তারুন্যের প্রতিনিধি, বাঙলা কবিতার ইতিহাসে সৌকর্যময় এক যুবরাজ তিনি! প্রথম মৌলিক কবিতা গ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র আকাশ ছোঁয়া খ্যাতি কবি হেলাল হাফিজকে দিয়েছে অমরত্ব।লেখালেখি জীবনের প্রায় সতের বৎসর পর ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত মোট ছাপান্নটি কবিতা সম্বলিত প্রথম কবিতা গ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে‘ একুশের বইমেলায় সেই বছরে ছিল সর্বাধিক বিক্রয়ক্রিত বই। ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুথানের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ নামে কবিতার পংতি ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ তরুণ প্রজন্মের জন্য এক উদ্দীপক শ্লোগান হয়ে ধ্বনিত হয়েছে বারবার। ‘কবিতা একাত্তর’ (২০১২) তার দ্বিতীয় বই যেখানে ‘যে জলে আগুন জ্বলের’ কবিতা সহ আরও পনেরটি নতুন কবিতা স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের নেত্রকোনায় (১৯৪৮) জন্ম নেয়া এই বরেণ্য কবি যুগান্তকারী কবিতার জন্য ২০১৩ সনে বাঙলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।
দুই
সেচ্ছা নির্বাসন, নিভৃতচারী এক সন্ন্যাস জীবন নিয়ে কবির বর্তমান সময়। ‘‘যে জলে আগুন জ্বলে’ শিরোনামে অনলাইন ‘ নিউজ ২৪’ চ্যানেলে প্রচারিত সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানের অসাধারণ আলাপচারিতায় কবি যেন এক প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনের খোঁড়াখুঁড়িতে উঠে আসেন লোকালয়ে। কখনো বক্তা, কখনো শ্রোতা কবির অবয়বে গোপন কষ্টের প্রগাঢ় এক ছায়া মিশে থাকে, দুঃখের মন্থনে তিনি যেন হয়ে ওঠেন সৌম্য, পবিত্র। তিনি কথা বলেন তাঁর কবিতার মতই স্নিগ্ধতায় মন ভিজিয়ে , হৃদয় ছুঁয়ে, অভিজ্ঞতালব্ধ সমৃদ্ধতায় সমৃদ্ধ করে। প্রশ্ন ছিল তাঁর কাছে – কবিরা বোধহয় কষ্ট পেতেই ভালোবাসে , কষ্ট কি কারও বেঁচে থাকার মূলধন হতে পারে? সমর্পণের স্বর্গীয় হাসিতে তিনি বলেন- সুখ স্মৃতি নয়, তাকে প্রেরণা দেয় দুঃখ। তার কবিতার রসদ হয়ে যায় বেদনা, বিরহ, বিচ্ছেদ। জীবনে অল্প যে কয়েকটি সুখ স্মৃতি আছে তার বিস্মৃতি চান তিনি। জীবনের ছকটাকে তিনি চারটি জিনিষের মধ্যে বাঁধতে চেয়েছেন- অক্সিজেন, খাদ্য, প্রেম, এবং কবিতা। মানুষের জীবনে প্রেম অনিবার্য। প্রেমের ক্ষেত্রে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বলে কোন স্তর ভেদ নেই। প্রতিটি প্রেমই এক নতুন রুপ নিয়ে আসে । যদি অক্সিজেন এবং খাদ্য ছাড়া জীবনধারণ করা যেত তাহলে হয়তো তিনি প্রেমকেই প্রথম ভাবতেন। প্রেম, অনুরাগ, রাগ, অভিমান প্রকাশের পরও তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়েছে নারীর কাছে ‘আশ্রয় ‘ পাওয়ার এক আকুতি। সঞ্চিত এক বেদনায় কিছুটা ভারাক্রান্ত শোনায় কবির কণ্ঠ । বালক বয়সেই মাতৃহীন কবি সবসময় আশ্রয় খুঁজেছেন মাতৃরুপ নারীর কাছে। ‘এক জীবনে এক মানবী আর কতটা কষ্ট দেবে’- কে সেই মানবী যাকে না পাওয়ায় কবির প্রেম পরিপূর্ণতা পায়নি, আর সেকারনেই কি তিনি বেদনার কবি? অকপট , স্বচ্ছ স্বীকারোক্তির আত্মস্থতায় কবি যেন অজানালোকে হারিয়ে যান-আসলে প্রেমের এই অপূর্ণতা , অপ্রাপ্তির রূপটা শাশ্বত। নির্দিষ্ট কোন মানবীর উল্লেখে সীমাবদ্ধ নয় বলেই কবিতার আবেদনটা মানুষের মর্মমূলে এভাবে গেঁথে গেছে। প্রেম, ভালোবাসা, বিদ্বেষ , ঘৃণা- এই সব কিছুর মধ্যে যে মানুষ তাকে পেতে হলে বিরহ বিসর্জনই বুঝি একমাত্র পথ। দুঃখ সুখকে ম্লান করে দেয়, সেটা সত্যি, কিন্তু এই ভূখণ্ড, এই আকালের দেশে ‘শৈল্পিক কষ্ট’ দেবার মানুষেরও যেন বড় অভাব। কোন অভিমানে কবির এই সেচ্ছা নির্বাসন ? ধীর লয়ে বলে চলেন তিনি- শিল্প, কবিতার স্বার্থেই এই অভিমান। অভিমান আছে বলেই হয়তো তিনি কবিতায় বেদনাকে এভাবে ধারণ করতে পেরেছেন। কথোপকথনের এই পর্যায়ে ঋজু এক দৃঢ়তা কবির মুখে খেলা করে, বলেন- সমাজে কবি এক ‘সার্বভৌম’ সত্তা। কবিতা মানুষের অ-সুখে কথা বলে, মানুষকে আলোর পথ দেখায়। একজন কবিকে সমাজ পরিমাপকের ‘ব্যারোমিটার’ বলা যেতে পারে। কাজেই সে যদি শেখানো বুলিতে ‘পোষা পাখি’ হয়ে যায় তাহলে ধরে নিতে হবে সেই সমাজ নষ্ট , ভ্রষ্ট হয়ে গেছে। সমাজ এখন এক ক্রান্তিলগ্নে। শুভ্রতা, স্নিগ্ধতা, সুকুমার বুদ্ধিবৃত্তির জায়গাটা এখন বড় নড়বড়ে । বৃক্ষ যেমন ফল ভারে নত হয়ে যায়, ছুঁয়ে থাকে মাটি , মানুষকেও ঠিক তেমনি বিনয়ে অবনত হয়ে মিশে যেতে হবে মৃত্তিকায় । মানুষের ভালবাসায় তিনি নিজেও নত, কবিতায়ও তারই প্রতিফলন ঘটেছে –“ওইটুকু নিয়ে তুমি বড় হও , বড় হতে হতে নত হও, নত হতে হতে হবে পৃথক পাহাড়, মাটি ও মানুষ পাবে , পেয়ে যাবে ধ্রূপদী আকাশ” (পৃথক পাহাড় , ৯.১০.৮০)। মৌলিক কবিতা নিয়ে কবি আবার কবে আবির্ভূত হবেন ? উন্মুখ প্রশ্ন পাঠকের। বিনয়াবনত দেহ আরও নত হয়ে যায়-খ্যাতির বিড়ম্বনায় তিনি যে ভারাক্রান্ত! নতুন কবিতা ‘যে জলে আগুন জ্বলের‘ জনপ্রিয়তাকে যদি ছাড়িয়ে না যায় অথবা ছুঁতে না পারে সেই শঙ্কায় তিনি দ্বিধান্বিত, ভীত। সবশেষে, সমাজ পতনের এই ক্রান্তিলগ্নে কবির কলমে জন্ম হোক নতুন কবিতা, যুগান্তকারী, দিশারী সৃষ্টিতে আরও একবার কালের কিংবদন্তী, রুপকথার রাজকুমার হয়ে উঠুন কবি –বিমুগ্ধ পাঠকের এই প্রত্যাশাই আজ।
তথ্য সুত্রঃ
১। হেলাল হাফিজ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ , অনিন্দ্য প্রকাশন, ২৪৪ নবাবপুর রোড ঢাকা।
২। সাক্ষাৎকার ‘যে জলে আগুন জ্বলে’, অনলাইন চ্যানেল ‘নিউজ ২৪’
৩। Helal
Hafiz- Ferrywala of Dreams, Hopes and Rebellion, by, Afsan Choudhury, bdnews24.com
আলোকরেখা নিজেকে আলোকিত করার অনেক সুযোগ পাই ।ঋতু মীর-এর হেলাল হাফিজ ! এক জীবন্ত কিংবদন্তীর নাম পরে অনেক অজানা কথা জানলাম।এই গবেষণা মূলক লেখা প্রশংসার দাবীিদার।আলোকরেখার চলার পথ সুগম ও সুন্দর হোক এই কামনা রইল।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো ঋতু মীরের কবি হেলাল হাফিজের উপর লেখা পড়ে। খুবই তথ্যবহুল। একই জায়গায় সবটুকু পড়তে পেরে বিশেষ সাচ্ছন্দ ও আত্মতৃপ্ত বোধ হচ্ছে যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। আলোকরেখাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDelete"হেলাল হাফিজ ! এক জীবন্ত কিংবদন্তীর নাম " লেখাটা তথ্য বহুল।ঋতু মীরের লেখা এই প্রথম পড়লাম। পড়ে খুব ভালো লাগলো। লেখককে অনেক অভিনন্দন। ভালো থাকুন আর এমনি ভালো ভালো লেখা উপহার দিন।
ReplyDelete"হেলাল হাফিজ ! এক জীবন্ত কিংবদন্তীর নাম " লেখাটা প্রশংসার দাবি রাখে। ঋতু মীরের লেখা এই পড়ে খুব ভালো লাগলো। কবি হেলাল হাফিজ শুধু একজন কিংবদন্তী লেখক নয় তান্র ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত ।তাকে কিছু শব্দে ধারন করা অসম্ভব। আর এই অসম্ভব কাজটাকে সুনিপূণতার সাথে অংকিত করেছেন লেখক ঋতু মীর। লেখককে অনেক অভিনন্দন। আমার চাওয়া ভালো থাকুন আর এমনি ভালো ভালো লেখা উপহার দিন।
ReplyDeleteঋতু মীর তার ভালো লাগা - খারাপ লাগা খুব চমৎকার ও সাবলীল বাংলায় প্রকাশ করতে পারেন। এবং সে লেখা পড়ে আমরা যে বিষয়টা নিয়ে উনি লিখেছেন সেটা যেমন সহজে বুঝে যাই - একই সাথে আমরা একটা সুচারু ও চিত্তনন্দন সাহিত্যকর্ম উপভোগের সুযোগ পাই! ঋতু মীর এর বিষয় ভিত্তিক শব্দ চয়ন ও সেগুলোর বিন্যাসে সাবলীল মুন্সীয়ানা পাঠকদের তড়তড়িয়ে নিয়ে যায় এক শব্দ থেকে আরেক শব্দে, এক বাক্য থেকে আরেক বাক্যে ! আলোকরেখায় ঋতু মীর এর লেখা নিয়মিত পাবো এই আশা আমাদের!
ReplyDeleteসূর্যালোকিত পাঠকের ঝলমলে আলোয় আলোকরেখা নিত্য আলোকিত! আমার কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই এখানে- ‘আমারে তুমি অশেষ করেছো …’ পাঠক!! আলোকরেখা! প্রাণঢালা ধন্যবাদ!!
ReplyDeleteদুঃখ নেবেন দুঃখ?
ReplyDeleteহরেক রকম দুঃখ
লাল, নীল সবুজ, হলুদ খামের অপূর্ণতার দুঃখ।
কিংবা ভেঙ্গে যাওয় কোন স্বপ্ন পুরন করতে না পারার দুঃখ।
দুঃখ নেবেন দুঃখ?
আমি দুঃখের জগতে ফেরি করছি বিষাদ
শুনাতে চাই সকলকে
পৃথিবীর মানুষগুলো আজ ভালো নেই বিষাদের কবলে।
পড়ে আছে সব আধভাঙ্গা মন নিয়ে
ক্লান্ত সকলে করতে অভিনয়,
এই ভয়ে তটস্হ
এই বুঝি গ্লানীমাখা মুখটা বেরিয়ে যায়।
রাতহলে বাড়ে যতো অপারগতা আর অপূর্ণতার দামামা
ক্লান মুসাফির খুঁজে ফেরে নিজ নিজ ঠিকানা।
আফসোস হায় রাত শেষে ভোর হয়
অপেক্ষার অবসান তবু ও নাহি দেখা দেয়।
ভেবে ভেবে ক্লান্ত আসবে কবে সুদিন
গাইবে পূর্ণতার গান
সেই দিনের আশায় বেঁচে থাকে সকলে।
কিন্তু জানে না তারা এ আশা তাদের কভু না মিটিবে।
সে তো রয়ে যাবে করতে রাত ভারি
আর বাড়াতে প্রতিযোগিতা।
এসব মেনে বুঝতে পারলে হয়তো
কখনো ধরা দিতে পারে ও একটুখানি পূর্ণতা।
পূর্নতা।
এই কবিতাটা কি হাশয় হেলাল হাফিজের লেখা?
হেলাল হাফিজ ! এক জীবন্ত কিংবদন্তীর নাম পড়ে খুব ভালো লাগলো। বিশেষ করে তাঁর জন্মদিনের সময়। আলোকরেখায় নতুন কোন পোস্ট পাই না। তাই পুরোনো লেখাগুলোই উল্টে পাল্টে দেখি। কি অনবদ্য লেখনী গুলো। তাইতো আলোকরেখা ছেড়ে আর কোথাও যাওয়া হয় না। এক ধরণের নেশার মতো। আশা করছি তাড়াতাড়িই আবার নতুন লেখা পাবো। নতুন প্রাণের উদ্দীপনায় আবার মুখরিত আন্দোলিত হবে আলোকরেখা। শুভ কামনা।
ReplyDelete