চার্লি চ্যাপলিন - নিছক কমেডিয়ান নন।
- হাসান মীর
চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাসে নির্বাক ও সবাক - উভয় যুগ মিলিয়ে সব চেয়ে আলোচিত ও বিখ্যাত ব্যক্তিটির নাম বোধকরি স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র, বিশ্বজুড়ে মানুষ যাকে চেনেন চার্লি চ্যাপলিন নামে। আজ হঠাৎ চ্যাপলিনের কথা আমার মাথায় আসার কারণ একজনের লেখায় তাঁর বক্তব্যের তিনটি উদ্ধৃতি পড়ে।
উদ্ধৃতিগুলি এ রকম - ১. এই বিশ্বে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়, এমনকি আমাদের দুঃখগুলোও নয়। ২. আমি বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে পছন্দ করি কারণ তখন আমার অশ্রু( চোখের পানি) কেউ দেখতে পায় না, আর ৩. আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হলো আয়না, কারণ আমি যখন কাঁদি সে তখন হাসে না।
উদ্ধৃতিগুলি এ রকম - ১. এই বিশ্বে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়, এমনকি আমাদের দুঃখগুলোও নয়। ২. আমি বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে পছন্দ করি কারণ তখন আমার অশ্রু( চোখের পানি) কেউ দেখতে পায় না, আর ৩. আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হলো আয়না, কারণ আমি যখন কাঁদি সে তখন হাসে না।
অনেক বছর আগে টোকিওতে থাকাকালে টিভি পর্দায় চার্লি চ্যাপলিনের দুটি সিনেমা দেখার সুযোগ হয়েছিল, একটি - দি গ্রেট ডিক্টেটর ( ১৯৪০ ) আর অন্যটি দি কাউন্টেস ফ্রম হংকং ( ১৯৬৭ ) । ডিক্টেটর ছবিতে এক ইহুদি নাপিত আর হিটলারের দ্বৈত ভূমিকায় ( অবশ্যই ভিন্ন নামে ) প্যারোডি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ব্রিটিশ কমেডি কাউন্টেস ফ্রম হংকং ' এর কাহিনী মনে নেই তবে ওই সিনেমায় সর্বকালের আরও দুজন বিখ্যাত স্টার সোফিয়া লরেন আর মার্লন ব্র্যান্ডো অভিনয় করেন ।
চার্লি চ্যাপলিনের জন্ম লন্ডনে ১৬ই এপ্রিল, ১৮৮৯। তবে তাঁর আসল জন্মনিবন্ধনপত্রটি পাওয়া যায়নি বলে তারিখ ও স্থান নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। চ্যাপলিনের মা, বাবা দুজনেই মঞ্চ আর সঙ্গীতের জগতের মানুষ, সেই অর্থে অভিনয় তাঁর রক্তে মিশেছিল, কিন্তু সেইসাথে দুর্ভাগ্যও ছিল দারুণ ভাবে। মা প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন আর বাবা ছিলেন মদ্যপায়ী, সংসারের দিকে কোনোই খেয়াল ছিল না। পরবর্তীকালে স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কও ছিন্ন হয়েছিল। চার্লি আর তার ভাই সিডনিকে নিয়ে তাদের মাকে পড়তে হয়েছিল বেজায় বিপাকে। অথচ মানসিক অসুস্থতার জন্য তাকে ঘনঘন যেতে হতো হাসপাতালে। শেষপর্যন্ত রোগে ভুগেভুগেই অল্প বয়েসে তিনি মারা যান। অবশ্য চ্যাপলিনের বাবা চার্লস স্পেনসার সিনিয়র তার আগেই লিভার সিরোসিসে মারা গিয়েছিলেন।
চার্লি চ্যাপলিনকে খুব অল্প বয়েসেই, মাত্র ৯/১০ বছরেই বেঁচে থাকার জন্যে ছোটখাটো কাজে লাগতে হয়। সেইসাথে মঞ্চে খুচরো অভিনয়ও ছিল। ভ্রাম্যমাণ নাচ- গানের দলেও কাজ করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়েসে শার্লক হোমস নাটকে পত্রিকা বিক্রেতার চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯ বছর বয়েসে তিনি ভাগ্যান্বেষণে আমেরিকায় পাড়ি দেন। ২৫ বছর বয়েসে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেন। তখন ছিল নির্বাক যুগ, পাত্র- পাত্রীরা এখনকার মতো কথা বলতেন না। ১৯১৫ সালে সেই সাইলেন্ট মুভির যুগে তার Trump বা ভবঘুরে সিনেমাটি তাঁকে বিশেষ একধরনের চরিত্রে দর্শকপ্রিয় করে তোলে। তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ ফিচার ফিল্ম ছিল দি কিড ( ১৯২১ ) , অন্যান্য ছবি ওম্যান অফ প্যারিস ( ১৯২৩ ) , দি গোল্ড রাশ ( ১৯২৫) , দি সার্কাস ( ১৯২৮ ) , সিটি লাইট ( ১৯৩১) এবং মডার্ন টাইমস ( ১৯৩৬ ) ।
এরপর আসে টকি বা সবাক সিনেমার যুগ। সবাক ছবির ব্যাপারে তিনি প্রথমদিকে খুব উৎসাহী ছিলেন না। পরে সময়ের ডাকে সাড়া দেন। তাঁর এই সময়ের সিনেমার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দি গ্রেট ডিক্টেটর ( ১৯৪০ ) , মঁসিয়ে ভার্দো ( ১৯৪৭ ) , লাইম লাইট ( ১৯৫২ ) এবং দি কাউন্টেস ফ্রম হংকং ( ১৯৬৭ ) । তবে আমেরিকায় দি গ্রেট ডিক্টেটর ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর কম্যুনিস্টদের সঙ্গে চ্যাপলিনের সম্পর্ক নিয়ে অভিযোগ ওঠে। ১৯৪৭ সালে মুক্তিপাওয়া মঁসিয়ে ভার্দু ছবিতে দেখানো পুঁজিবাদ বিরোধী মনোভাবও একটা কারণ। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন ব্রিটিশ, আমেরিকার অনেকেই তাকে স্থায়ী নাগরিকত্ব না দিয়ে বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলাও আনা হয়। গোয়েন্দা সংস্থা FBI তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তে নামে। বস্তুত আমেরিকার মানুষের তীব্র কম্যুনিজম বিরোধী মনোভাবের কারণে তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। শেষপর্যন্ত ১৯৫৫ সালে তিনি আমেরিকায় তাঁর বিষয়- সম্পত্তি ও শেয়ার বিক্রি করে ইউরোপে ফিরে আসেন এবং সুইটজারল্যান্ডে স্থায়ী হন। এখানেই ১৯৭৭ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক করে তিনি ৮৮ বছর বয়েসে না ফেরার দেশে চলে যান। মজার ব্যাপার, পোলান্ড ও বুলগেরিয়া থেকে আসা দুই অভিবাসী চোর চ্যাপলিনের স্ত্রীর কাছ থেকে " মুক্তিপণ " আদায়ের লোভে কবর থেকে কফিনটি চুরি করে নিয়ে যায়। ক' দিন পর পুলিশ সেটি উদ্ধার করে এবং দ্বিতীয়বার কবরস্থ করা হয়।
ব্যক্তিজীবনের মতো চ্যাপলিনের পারিবারিক জীবনও খুব স্বস্তির ছিল না। তিনি চারটি বিয়ে করেন কিন্তু প্রথম তিন স্ত্রীর সঙ্গে অল্প দিনের মধ্যেই বিচ্ছেদ ঘটে। চতুর্থ স্ত্রী, ওনা ও' নীল যার সাথে বয়সের ব্যবধান ছিল ১৬ বছরের, তাঁর সাথেই কেটেছে জীবনের শেষ ৩৮ টি বছর। এই ঘরে তাদের সন্তান সংখ্যা আটটি এবং প্রথম দুইপক্ষের মিলিয়ে মোট ১১ টি।
চার্লি চ্যাপলিন ছিলেন স্বশিক্ষিত এবং একইসঙ্গে সুশিক্ষিত মানুষ। তিনি কমেডি ও সিরিয়াস অভিনয় ছাড়াও চলচ্চিত্র পরিচালনা, সংলাপ রচনা, সম্পাদনা, সঙ্গীত পরিচালনা, প্রযোজনা -- সব ক্ষেত্রেই পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর অতি পরিচিত চেহারা -- পরনে চাপা কোট, সাইজে বড় ঢলঢলে প্যান্ট, বড় জুতা, মাথায় বিশেষ ধরনের হ্যাট, হাতে ছড়ি এবং ঠোঁটের ওপর ' টুথব্রাশ গোঁফ ' -- এ এমন এক ট্রেডমার্ক যে কখনও ভোলার নয়।
চার্লি চ্যাপলিন জীবনে নিন্দা এবং প্রশংসা দুইই পেয়েছেন প্রচুর। ১৯৭২ সালে তাঁকে সম্মানসূচক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। বিলাতের রাণী ১৯৭৫ সালে তাঁকে নাইটহুড বা স্যার খেতাবে ভূষিত করেন। তবে ১৯৫০' এর দশকে সোভিয়েত আমলে তাঁকে আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার দেয়ায় এবং তিনি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করায় মার্কিনমুলুকে সমালোচিত হয়েছিলেন। তাঁর কথা দিয়েই লেখা শেষ করবো -- এই বিশ্বে কোনো কিছুই স্থায়ী হয় না .......... ।। ( তথ্য ও ছবি সংগৃহীত, প্রথমটি পোট্রেট, ৩১ বছর বয়েসের ) ।
http://www.alokrekha.com
- হাসান মীরের " চার্লি চ্যাপলিন - নিছক কমেডিয়ান নন।" পড়ে চমকৃত হলাম। যে মানুষটা আমাদের শত দুঃখের মাঝেও তাঁর অভিনয় তার হাস্যরসাত্মক অঙ্গ ভঙ্গী দিয়ে আনন্দ দিয়েছে। কি ভীষণ চরম কষ্টের জীবন পার করেছেন। লেখক তার কলমের আঁচড়ে চার্লি চ্যাপলিনের জীবনের ছবি এঁকেছেন তা অনবদ্য।
ReplyDeleteহাসান মীরের " চার্লি চ্যাপলিন - নিছক কমেডিয়ান নন।" উত্কৃষ্ট ও চমৎকার সৃষ্ট রচনা।চার্লি চ্যাপলিন - নিছক কমেডিয়ান নন। তার জীবনের কষ্ট বেঁচে থাকার লড়াই
ReplyDeleteউত্কৃষ্ট চমৎকার প্রকাশ।অপূর্ব বিষয় বস্তু,ভাষাভাব ও শব্দচয়ন ও রচনা শৈলী মিলিয়ে অনিন্দ্য।অনেক শুভেচ্ছা লেখককে আলোকরেখাকে অনেক ধন্যবাদ এমন গুণী একজন লেখককে পরিচিত করিয়ে দেবার জন্য।
হাসান মীরের " চার্লি চ্যাপলিন - নিছক কমেডিয়ান নন।" সমুন্নত ও চমৎকার তথ্যবহুল রচনা।লেখকের যথেষ্ট গবেষণা ও তত্ত্বানুসন্ধানের ফসল। তার লেখা পরে আমরা অনুধাবন করতে পারি রচনার শিরোনামের সফলতা। লেখকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
ReplyDeleteসমস্যাটা কোথায় বুঝতে পারছি না ।আজ বেশ কত দিন হল আলোকরেখায় কোন নতুন লেখা প্রকাশিত হছছে না ।
ReplyDeleteআলোক রেখায় নুতন লেখা পাচ্ছি না। অধীর অপেক্ষায় আছি.
ReplyDeleteহাসান মীরের লেখা "চার্লি চাপলিন " পড়লাম , বেশ ভালো লাগলো
ReplyDeleteহাসান মীরের লেখা "চার্লি চাপলিন " পড়লাম , চমত্কার, লেখককে অভিনন্দন আর সাধুবাদ
ReplyDeleteহাসান মীরের "চার্লি চাপলিন " পড়ে অনেক পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল , হাসান মীরকে ধন্যবাদ।
ReplyDeleteহাসান মীরের "চার্লি চাপলিন " আমার মনে খুব দাগ কেটেছে। হাসান মীরকে অভিনন্দন
ReplyDeleteহাসান মীরের "চার্লি চাপলিন " আমার মনে খুব দাগ কেটেছে। হাসান মীরকে অভিনন্দন
ReplyDeleteআলকরেখায় কোন নতুন লেখা প্রকাশিত হচ্ছে না ।পুরনো লেখা পড়ছি ।কর্তৃপক্ষ দয়ে করে জানাবেন কারনটা। আমরা অপেক্ষায় রয়েছি।
ReplyDeleteআলকরেখার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক।অনেক ওয়েব সাইট আছে কিন্তু আলক রেখার পাঠক সংখ্যা এত বেশি হবার কারন এখানে আমরা নিত্য নতুন লেখা পড়ার সুযোগ পাই ।পাই দীপ্ত প্রজ্ঞার অন্বেষণ।আজ অনেকদিন লেখা পাইনা।জানি না কবে অপেক্ষা শেষ হবে ।
ReplyDelete