বৈষ্ণব পদাবলি
সানজিদা রুমি
বৈষ্ণব
পদাবলি বা বৈষ্ণব পদাবলী
বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের রসভাষ্য নামে খ্যাত এক শ্রেণীর ধর্মসঙ্গীত
সংগ্রহ। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যর সূচনা ঘটে চর্তুদশ শতকে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস-এর
সময়ে তবে ষোড়শ শতকে এই সাহিত্যের বিকাশ
হয়। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রধান অবলম্বন রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা।
বৈষ্ণব পদাবলীর তত্ত্ব - শ্রীকৃষ্ণ হলেন সৎ-চিৎ-আনন্দের মূর্তিমান বিগ্রহ।রাধা তাঁরই প্রকাশাত্মিকা শক্তি।শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী অংশ সঞ্জাত রাধা সৃষ্টি হয়েছেন তাঁরই লীলাসুখানুভবের জন্য।শ্রীরাধা আয়ান বধূ।তাই শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাঁর প্রেম অসামাজিক, পরকীয়া।জীবও তেমনই তত্ত্বের দিক থেকে শ্রীকৃষ্ণের স্বকীয় হলেও রূপ-রস-গন্ধযুক্ত জগতের সংগে সে এমনই নিবিড়ভাবে আবদ্ধ যে সে তার স্বকীয়তা ভুলে যায়।সেই ভুল ভাঙলে জীব ভগবানের ডাকে সাড়া দেয়, তখন ঘটে তার পরকীয়া অভিসার।এভাবেই তৈরী হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলীর তত্ত্ব। বৈষ্ণব পদাবলির শিল্পীরা ছিলেন নরহরি সরকার , বাসু ঘোষ, লোচন দাস,জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, প্রমুখ। 'লীলাকীর্তন' সংগঠনের প্রধান, নরোত্তম ঠাকুর ও ছিলেন শিল্পী। শ্রীচৈতন্য পরে একে ধর্মীয় আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন। বৈষ্ণব পদাবলি ব্রজবলি ও বাংলা ভাষায় রচিত। রাধাকৃষ্ণ-পদাবলীর প্রধান সুর বিরহের। এই বিরহ-সুরের রণনেই বাৎসল্যের,অনুরাগের এবং মিলনের শ্রেষ্ঠ পদগুলি উৎকর্ষপ্রাপ্ত।সংস্কৃত সাহিত্যে বিরহ প্রধানত পুরুষের তরফে।যেমন ঋগ্বেদে পুরুরবার বিরহ, রামায়ণে রামের বিরহ, মেঘদূতে যক্ষের বিরহ।নবীন আর্যভাষার সাহিত্যে তথা বৈষ্ণব গীতিকাব্যে বিরহ একান্তভাবে নারীরই।এর কারণ দুটি- এক, ইতিমধ্যে সংসারে নারীর মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে।দুই, প্রাদেশিক সাহিত্যের প্রধান বিষয়গুলি মেয়েলি ছড়া-গান থেকে গৃহীত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু গান যেমন-'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' বৈষ্ণব পদাবলী দ্বারা প্রভাবিত। এগুলি বেশিরভাগ ব্রজবুলি ভাষায় রচিত।এর মধ্যে বিখ্যাত- 'মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান','গহন কুসুম কুঞ্জমাঝে','শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা' ইত্যাদি। এছাড়া-'ওহে জীবন বল্লভ', 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই', 'নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে', 'আমি জেনেশুনে তবু ভুলে আছি' ইত্যাদি গানে বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব পরিস্ফুট।
বৈষ্ণব সাহিত্য বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শনকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে রচিত একটি কাব্যধারা। রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা এর মূল উপজীব্য। বারো শতকে সংস্কৃতে রচিত জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ এ ধারার প্রথম কাব্য। পরে চতুর্দশ শতকে বড়ু চন্ডীদাস বাংলা ভাষায় রচনা করেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে একখানি আখ্যানকাব্য। বাংলা ভাষায় রচিত এটিই প্রথম কাব্য। এতে রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক বিভিন্ন ভাবের ৪১৮টি স্বয়ংসম্পূর্ণ পদ রয়েছে। পদগুলি গীতোপযোগী করে রচিত; পদশীর্ষে সংশ্লিষ্ট রাগ-তালের উল্লেখ আছে। নাটগীতিরূপে পরিচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নানা কারণে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজও অতুলনীয়। এ শতকেরই দ্বিতীয় ভাগে চন্ডীদাস নামে একজন পদকর্তা আবির্ভূত হন। তিনি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে উৎকৃষ্ট মানের অনেক পদ রচনা করেন। পনেরো শতকে মিথিলার কবি বিদ্যাপতি (আনু. ১৩৭৪-১৪৬০) ব্রজবুলিতে রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক অনেক পদ রচনা করেন। পদগুলি বাঙালিদের নিকট এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, সেগুলির কারণে ব্রজবুলি ভাষাটিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে অনেক বাঙালি কবি এ ভাষায় বৈষ্ণবপদ রচনা করেন। এক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান ভেদ ছিল না। বর্ধমানের কুলীনগ্রাম নিবাসী মালাধর বসু শ্রীকৃষ্ণবিজয়
(১৪৭৪) নামে সংস্কৃত শ্রীমদ্ভাগবতের দশম-একাদশ স্কন্ধের বঙ্গানুবাদ করেন। এতে শ্রীকৃষ্ণের প্রেমলীলা অপেক্ষা ঐশ্বর্যলীলা অধিক প্রকটিত হয়েছে। একই সময়ে মুসলমান কবি আফজল রাধাকৃষ্ণের প্রেমের রূপকে কিছু পদ রচনা করেন। পরে বাংলাদেশে চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাব ঘটে। তিনি জয়দেব, বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের পদ আস্বাদন করে আনন্দ পেতেন এবং কৃষ্ণস্মরণে আবেগাপ্লুত হতেন।
চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে যাঁরা কৃষ্ণচরিত্র প্রকাশ করেছেন, তাঁরা কেউ বৈষ্ণব ছিলেন না। উপরন্তু তাঁদের রচিত পদাবলিতে রাধাকৃষ্ণলীলার আধ্যাত্মিক দিক প্রকাশ পায়নি; তাঁরা রাধাকৃষ্ণের রূপকে লৌকিক প্রেমের কথাই ব্যক্ত করেছেন। এজন্য কেউ কেউ প্রাকচৈতন্য পর্বের এসব রচনাকে বৈষ্ণব সাহিত্য বলার পক্ষপাতী নন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এগুলি বৈষ্ণব সাহিত্য বলেই আখ্যাত ও আলোচিত হয়ে আসছে।
ব্রাহ্মণ-সন্তান শ্রীচৈতন্য তরুণ বয়সে কেশব ভারতীর নিকট বৈষ্ণবমতে দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাসী হন এবং কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর হয়ে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। তিনিই গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মমতের প্রবর্তক। মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ চৈতন্যদেব পার্ষদ-পরিকর, ষড়গোস্বামী এবং অসংখ্য ভক্ত সহযোগে দেশব্যাপী একটি ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে তোলেন, যা ইতিহাসে বৈষ্ণব আন্দোলন নামে পরিচিত। চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব সাহিত্য এ আন্দোলনেরই স্বর্ণফসল। এর মধ্য দিয়ে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার দিগন্ত বিস্তৃত হয় এবং এক সময় এর সঙ্গে চৈতন্যদেবের লৌকিক-অলৌকিক জীবনলীলাও যুক্ত হয়। চৈতন্যলীলা বিষয়ক গৌরপদ ও বিশাল আকৃতির চরিতকাব্য এ পর্বেই রচিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ সময় অনেক মহান্তজীবনীও রচিত হয়েছে। বৈষ্ণবধর্মের তত্ত্ব-দর্শন ও চৈতন্যদেবের জীবনী নিয়ে সংস্কৃত ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে ( চৈতন্যচরিতামৃত,
চৈতন্যচন্দ্রোদয় ইত্যাদি)। বাংলা ভাষাতেও রসসমৃদ্ধ পদাবলি, তথ্যসমৃদ্ধ চরিতকাব্য, তত্ত্ববহুল শাস্ত্রগ্রন্থ ইত্যাদি রচিত হয়েছে।
পদাবলি ষোলো থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত তিনশ বছর ধরে বৈষ্ণবপদ রচিত হয়েছে। গীতোপযোগী ও ভণিতাযুক্ত ছন্দোবদ্ধ রচনা ‘পদ’ নামে অভিহিত। প্রেমের একেকটি ভাবকে অবলম্বন করে পদগুলি রচিত। প্রতিটি পদের শীর্ষে রাগ-তালের উল্লেখ আছে। চৈতন্যোত্তর কালে বৈষ্ণবপদের ভাব ও রসের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাৎসল্য ও সখ্য রসের নতুন পদাবলি। বন্দনা, প্রার্থনা ও আধ্যাত্মিক সাধনাযুক্ত পদগুলিও নতুন মাত্রা যোগ করে। এ যুগের কবিগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমবিষয়ক পদে ঐশী মহিমা ও আধ্যাত্মিকতার রূপক আরোপ করেন। তাঁদের কাছে বৈষ্ণব কবিতা ছিল বৈষ্ণবতত্ত্বের রসভাষ্য। এ পর্বে কতজন কবি কী পরিমাণ পদ রচনা করেছেন, তা সঠিকভাবে বলা দুষ্কর। দু-চারজন ছাড়া অন্যান্য কবির রচনার পান্ডুলিপিও পাওয়া যায়নি। সম্ভবত তাঁরা তা লিপিবদ্ধ করেননি; কীর্তন গায়কদের মুখে মুখে পদগুলি প্রচারিত হতো এবং ভণিতা থেকে কবির নাম ও তাঁর রচনা শনাক্ত করা হতো। আঠারো শতকের গোড়া থেকে কিছু পদ-সংকলন পাওয়া যায়, যেমন বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর ক্ষণদাগীতচিন্তামণি (১৭০৫), রাধামোহন ঠাকুরের পদামৃতসমুদ্র, বৈষ্ণবদাসের পদকল্পতরু (১৭৬০), নরহরি চক্রবর্তীর গীতচন্দ্রোদয় ইত্যাদি। পদকল্পতরুতে প্রায় দেড়শত কবির তিন হাজার বৈষ্ণব পদ সংকলিত হয়েছে। এতে পদগুলি বৈষ্ণব রসতত্ত্বের নিয়মানুযায়ী বয়ঃসন্ধি, পূর্বরাগ, দৌত্য, অভিসার, সম্ভোগ, মান, বিরহ, প্রেমবৈচিত্ত, ভাবসম্মেলন ইত্যাদি ক্রমে বিন্যস্ত। আবার নায়িকার অবস্থাভেদেও মানিনী, খন্ডিতা, অভিসারিকা, বিপ্রলব্ধা, বাসকসজ্জা ইত্যাদি প্রকার বিভাজন আছে। উনিশ শতকের শেষ দিকে দীনেশচন্দ্র সেন বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (১৮৯৫) গ্রন্থে ১৬৪জন পদকর্তার নাম এবং ৪৫৪৮টি পদসংখ্যার উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে নতুন পুরাতন কবির আরও অনেক পদ পাওয়া গেছে। বর্তমানে বৈষ্ণবপদের সংখ্যা সাত-আট হাজার। এগুলির মধ্যে মুসলমান কবির রচিত পদও রয়েছে। আফজল, আলাওল, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ মর্তুজা, আলি রজা প্রমুখ মুসলমান কবি চৈতন্যলীলা, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা, ভজন, রাগানুরাগ প্রভৃতি বিষয়ক পদ এমনভাবে রচনা করেছেন যে, বৈষ্ণব কবিকৃত পদাবলি থেকে সেগুলিকে পৃথক করা যায় না। মুসলমান কবিরা সম্ভবত সুফিতত্ত্বের আলোকে শ্রীচৈতন্যকে পীর-গুরু এবং রাধাকৃষ্ণকে জীবাত্মা-পরমাত্মার প্রতীকরূপে দেখেছিলেন।
পদকর্তা হিসেবে ষোলো শতকে মুরারি গুপ্ত, নরহরি সরকার, বাসুদেব ঘোষ, লোচনদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরাম দাস, দ্বিজ চন্ডীদাস; সতেরো শতকে কবিরঞ্জন (ছোট বিদ্যাপতি), কবিশেখর, রাধাবল্লভ দাস, ঘনশ্যাম দাস, রামগোপাল দাস; আঠারো শতকে বৈষ্ণব দাস, চন্দ্রশেখর, রাধামোহন ঠাকুর, নরহরি চক্রবর্তী, যদুনন্দন প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। এঁদের মধ্যে আবার জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, চন্ডীদাস, কবিরঞ্জন, যদুনন্দন প্রমুখ শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। নানা ভাবের পদ রচনা করেও যেমন বিদ্যাপতি বিরহের পদ ও চন্ডীদাস প্রেম-মিলনের পদ রচনায় অধিক কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, তেমনি জ্ঞানদাস অনুরাগের এবং গোবিন্দদাস অভিসারের পদ রচনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁদের শিল্পগুণসম্পন্ন পদগুলি ধর্মের মোড়ক ভেদ করে সার্বজনীন সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। রাধাকৃষ্ণের প্রণয় বর্ণনা করতে গিয়ে বৈষ্ণব কবিরা মর্ত্যের নরনারীর আবেগ-অনুভূতিকেও স্পর্শ করেছেন। তাঁদের ভাব এবং ভাষার কুশলতায় বৈষ্ণব কবিতার এক অর্থ অপ্রাকৃতলোকে আধ্যাত্মিকতার দিকে গেছে, অপর অর্থ মর্ত্যের মানব-মানবীর সুখদুঃখপূর্ণ চিরন্তন প্রেমের দিকে গেছে। সমালোচকদের মতে কিছু কিছু পদ ভাব, রস ও শিল্পগুণে বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে সহজেই স্থান করে নিতে পারে। নিঃসন্দেহে বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দ দাসের পদাবলি এরূপ চিরায়ত কাব্যসৌন্দর্য ও মর্যাদার অধিকারী।
বিষয় ভিত্তিতে বৈষ্ণবপদগুলি চার ভাগে বিভক্ত: গৌরলীলা, ভজন, রাধাকৃষ্ণলীলা ও রাগাত্মিকা। প্রথম শ্রেণির পদে গৌরলীলা অর্থাৎ চৈতন্যলীলার বর্ণনা আছে। দ্বিতীয় শ্রেণির পদে গুরু-মহাজনের প্রতি বন্দনা-প্রার্থনা করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির পদে ব্রজধামে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার বিস্তৃত বর্ণনা আছে। এ ধারার পদ রচনায় কবিরা সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছেন। আর এরূপ পদের সংখ্যাও সর্বাধিক। তত্ত্বভিত্তিক রাগাত্মিকা পদগুলিতে গুহ্য সাধনার কথা আছে। ফলে পদগুলি সরলতা হারিয়ে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। সময়ের বিচারে ষোলো শতক বৈষ্ণবপদ রচনার শ্রেষ্ঠ সময়, সতেরো শতকে এর বিকাশ সাধিত হয়, আর আঠারো শতকে অবনতি ও সমাপ্তি ঘটে। বৈষ্ণব সাহিত্যের অপরাপর রচনা সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। বস্ত্তত বৈষ্ণব আন্দোলনের উত্থান-পতনের সঙ্গে বৈষ্ণব সাহিত্যও সম্পৃক্ত ছিল।
চরিতকাব্য শ্রীচৈতন্য ও তাঁর কয়েকজন সহযোগীর জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে বৈষ্ণব চরিতশাখা গড়ে ওঠে। কেবল বৈষ্ণব সাহিত্যেই নয়, মধ্যযুগের সমগ্র বাংলা সাহিত্যেই চরিতকাব্য একটি অভিনব ধারা। সমকালের অথবা ঈষৎ পূর্ববর্তী কালের ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নিয়ে বিশালাকার এরূপ কাব্য অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায় না। সংস্কৃতে রচিত প্রথম জীবনীগ্রন্থ চৈতন্যচরিতামৃত। এর রচয়িতা মুরারি গুপ্ত ছিলেন চৈতন্যদেবের সতীর্থ। গ্রন্থখানি গদ্য-পদ্যের মিশ্রণে ‘কড়চা’ বা ডায়রি আকারে রচিত। এজন্য এটি ‘মুরারি গুপ্তের কড়চা’ নামেও পরিচিত। এতে শ্রীচৈতন্যের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা আছে। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম জীবনীকাব্য চৈতন্যভাগবত (১৫৪৮) তাঁর মৃত্যুর ১৫ বছর পরে রচিত হয়। শ্রীচৈতন্যের ঘনিষ্ঠ সহচর নিত্যানন্দের উৎসাহে বৃন্দাবন দাস প্রায় ২৫ হাজার জোড় চরণে এ বিশাল কাব্য রচনা করেন। মুরারি গুপ্ত রাধাকৃষ্ণের যুগলরূপ হিসেবে চৈতন্যদেবের ভাবমূর্তি তুলে ধরেন, আর বৃন্দাবন দাস শ্রীকৃষ্ণের অবতাররূপে চৈতন্যলীলা প্রচার করেন। সময়ের দিক থেকে লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল (১৫৭৬) দ্বিতীয় এবং ষোলো শতকের শেষদিকে একই নামে জয়ানন্দ রচনা করেন তৃতীয় গ্রন্থ। তুলনামূলকভাবে লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল অধিক পরিশীলিত ও বৈদগ্ধ্যপূর্ণ। তিনি নিজ বাসস্থান শ্রীখন্ডের ভাবধারা অনুযায়ী ‘গৌরনাগর’ রূপে শ্রীচৈতন্যের ভাবমূর্তি তুলে ধরেন। চৈতন্যদেবের চতুর্থ জীবনীকাব্য কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত 'চৈতন্যচরিতামৃত'
(১৬১২)। কৃষ্ণদাস বৃন্দাবনের অন্যতম গোস্বামী রঘুনাথ দাসের শিষ্য ছিলেন। প্রামাণিক তথ্য, বিষয়বৈচিত্র্য,
রচনার পারিপাট্য প্রভৃতি গুণে কাব্যখানি পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। চৈতন্যজীবন মুখ্য বিষয় হলেও এতে বৈষ্ণবধর্মের তত্ত্ব, দর্শন, বিধিবিধান, সমকালের ইতিহাস, সমাজ এবং ঐতিহ্যের নানা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। রাধাকৃষ্ণের যে ঐশী প্রেম ও ভক্তিবাদের ওপর গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম প্রতিষ্ঠিত, কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীচৈতন্যকে তারই বিগ্রহরূপে চিত্রিত করেছেন। পাঠকনন্দিত এ কাব্যখানির একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সি ডিমকের ইংরেজি গদ্যানুবাদ টনি কে স্টুয়ার্টের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে।
চৈতন্যপরিকরদের মধ্যে সবচেয়ে বর্ষীয়ান অদ্বৈত আচার্যের জীবনী নিয়ে সংস্কৃতে একখানি এবং বাংলায় চারখানি কাব্য রচিত হয়েছে। বাল্যলীলাসূত্র
(১৪৮৭) নামে সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করেন হরকৃষ্ণ দাস। এতে অদ্বৈত আচার্যের বাল্যলীলার বিবরণ আছে। বাংলা ভাষায় অদ্বৈতপ্রকাশ (১৫৬৯) নামে প্রথম কাব্য রচনা করেন ঈশান নাগর। এরূপ দ্বিতীয় কাব্য হরিচরণ দাসের অদ্বৈতমঙ্গল। একই নামে শ্যামদাস তৃতীয় কাব্য রচনা করেন, তবে তার পান্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। নরহরি দাস অদ্বৈতবিলাস নামে চতুর্থ কাব্য রচনা করেন আঠারো শতকে। এসব কাব্যে অদ্বৈত আচার্যের সঙ্গে চৈতন্যদেবেরও অনেক প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে। অদ্বৈত আচার্যের পত্নী সীতাদেবীর জীবনী সীতাচরিত ও সীতাগুণকদম্ব যথাক্রমে লোকনাথ দাস ও বিষ্ণুদাস আচার্য রচনা করেন। চৈতন্যদেবের অপর ঘনিষ্ঠ সহচর শ্রীনিবাসের জীবনচরিত প্রেমবিলাস (১৬০১) রচনা করেন নিত্যানন্দ দাস। যদুনন্দন দাসের কর্ণানন্দ (১৬০৮), গুরুচরণ দাসের প্রেমামৃত এবং মনোহর দাসের অনুরাগবল্লরী কব্যেও শ্রীনিবাসের কথা আছে। নরোত্তম আচার্যের জীবনী নিয়ে নরোত্তমবিলাস রচনা করেন নরহরি চক্রবর্তী। তাঁর অপর কাব্য ভক্তিরত্নাকরে একাধারে শ্রীনিবাস, নরোত্তম আচার্য ও শ্যামানন্দের জীবনী স্থান পেয়েছে। সতেরো শতকে শ্রীচৈতন্যের অন্যতম পার্ষদ বংশীবদনের জীবনীকাব্য বংশীবিলাস রচনা করেন রাজবল্লভ। এগুলি ছাড়া আঠারো শতকে আরও কয়েকখানি চরিতকাব্য রচিত হয়। অকিঞ্চিৎকর হলেও বৈষ্ণব সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় সেগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। ব্যতিক্রম ছাড়া চরিতকাব্যের সাহিত্যিক মূল্য কম, কিন্তু বৈষ্ণব ধর্ম ও সম্প্রদায় সম্পর্কে বিশেষভাবে এবং বাংলার সমকালীন সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে সাধারণভাবে জানার জন্য এগুলি আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও দেবদেবীর প্রভাব-প্রতিপত্তিতে ভারাক্রান্ত মধ্যযুগের সাহিত্যাঙ্গনে মানুষ মানুষের কথা লিখেছে; এতে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাই প্রকাশ পেয়েছে।
নাটক কবিকর্ণপূর সংস্কৃতে চৈতন্যচন্দ্রোদয় নামে চৈতন্যলীলাশ্রিত নাটক রচনা করেন। প্রেমদাস চৈতন্যচন্দ্রোদয়কৌমুদী নামে বাংলায় এর স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করেন। দশ অঙ্কের এই নাটকে চৈতন্যদেবের সন্ন্যাস জীবনের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। চৈতন্যদেব এ পর্বে কৃষ্ণের প্রতি প্রেম ও ভক্তিভাবে বিভোর থাকতেন। চৈতন্যের জীবনী অবলম্বনে রামানন্দ রায় সংস্কৃতে রচনা করেন জগন্নাথবল্লভনাটকম্, যার বঙ্গানুবাদ করেন লোচনদাস।
আখ্যানকাব্য প্রধানত ভাগবতের অনুসরণে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কিছু আখ্যানকাব্য রচিত হয়েছে। তবে লৌকিক ও পৌরাণিক উৎস থেকেও তথ্য গৃহীত হয়েছে। ষোলো শতকে মাধবাচার্যের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল, সতেরো শতকে কৃষ্ণদাসের শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল, অভিরাম দাসের গোবিন্দবিজয়, ঘনশ্যাম দাসের শ্রীকৃষ্ণবিলাস,
রঘুনাথের শ্রীকৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিণী প্রভৃতি এ শ্রেণির কাব্য। কাব্যগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শ্রীকৃষ্ণের প্রেমলীলার সঙ্গে ঐশ্বর্যলীলার বর্ণনা।
শাস্ত্রকথা বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, সমাজ, সঙ্গীতবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কিছু নিবন্ধ বা খন্ড কবিতা রচিত হয়েছে। নিত্যানন্দের প্রেমবিলাস, যদুনন্দনের কর্ণানন্দ, মনোহর দাসের অনুরাগবল্লরী, অকিঞ্চন দাসের বিবর্তবিলাস প্রভৃতি এ জাতীয় রচনা। সঙ্গত কারণেই সাধনভজনসংক্রান্ত এসব রচনায় সাহিত্যগুণের তেমন প্রকাশ ঘটেনি।
মধ্যযুগে কৃষ্ণকথা, রাধাকৃষ্ণ প্রেম, চৈতন্যলীলা, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি অবলম্বনে যে বিশাল বৈষ্ণব সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার মূল প্রেরণা ছিল শ্রীচৈতন্যের অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও ধর্মবোধ। এসব বিচিত্র বিষয় রচনার অঙ্গীভূত হওয়ায় বাংলা ভাষার চর্চা ও প্রকাশ ক্ষমতা অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়। কবিগণ পদাবলির মাধ্যমে মানব মনের অতি সূক্ষ্ম ভাব, ব্যক্তিজীবনের বিচিত্র ঘটনাপঞ্জি, শাস্ত্রের নিগূঢ় তত্ত্ব ইত্যাদি বর্ণনা করায় বাংলা ভাষা নানা মাত্রিকতায় বিকাশ লাভ করে। ফলে বৈষ্ণব পদাবলি একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিষয় হয়েও সাহিত্যগুণে কালের সীমা অতিক্রম করে সর্বশ্রেণীর পাঠক-গবেষকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। তাই বৈষ্ণব সাহিত্যের ব্যাপ্তির ও গভীরতার পাশাপাশি বাংলা ভাষার উৎকর্ষ ও উন্নতির কথাও সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়।
চৈতন্য-উত্তর বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি গোবিন্দদাস কবিরাজ। ষোড়শ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা বলা চলে একাধারে সাধক, ভক্ত ও রূপদক্ষ এই কবিকেই। যৌবনের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়ে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন গোবিন্দদাস। অতঃপর রূপ গোস্বামীর উজ্জ্বলনীলমণি আয়ত্ত্ব করে বৈষ্ণব রসশাস্ত্র অনুসারে রচনা করতে থাকেন রাধাকৃষ্ণ-লীলা ও চৈতন্য-লীলার পদাবলি। তাঁকে বলা হয় বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। যদিও বিদ্যাপতির রচনার সঙ্গে তাঁর রচনার সাদৃশ্য ও বৈপরীত্য দুইই চোখে পড়ে। তাঁর একটি পদ ‘সুন্দরী রাধে আওয়ে বনি’ পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক সুরারোপিত হয়ে আধুনিক অ-বৈষ্ণব সমাজেও সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
গোবিন্দদাসের জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ভক্তমাল গ্রন্থ, নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকর ও নরোত্তমবিলাস
(এই গ্রন্থদ্বয়ে কবির রচিত অধুনালুপ্ত সঙ্গীতমাধব নাটকের অংশবিশেষ উদ্ধৃত) ও রামগোপাল দাসের রসকল্পবল্লী কবির সম্পর্কে কিছু কিছু তথ্য জানা যায়। তিনি অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত শ্রীখণ্ডে এক বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চিরঞ্জিত সেন ছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ। জন্মকাল সঠিক জানা না গেলেও গবেষকেরা অনুমান করেন যে তিনি ষোড়শ শতকে মধ্যভাগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চিরঞ্জিত সেন ভক্তকবি দামোদর সেনের কন্যা সুনন্দাকে বিবাহ করে স্বগ্রাম কুমারনগর ত্যাগ করে বৈষ্ণবতীর্থ শ্রীখণ্ডে বসবাস শুরু করেন। সুনন্দা দেবীর গর্ভেই নৈয়ায়িক রামচন্দ্র ও তাঁর ছোটো ভাই কবিরাজ গোবিন্দদাসের জন্ম। প্রথম জীবনে গোবিন্দদাস শাক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। বৈষ্ণবধর্মে তাঁর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। যৌবনের শেষভাগে গ্রহণী রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মনে কৃষ্ণভক্তির উদয় হয়। তখন তাঁর দাদা রামচন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় শ্রীনিবাস আচার্য গোবিন্দদাসকে বৈষ্ণবমন্ত্রে দীক্ষিত করেন। গোবিন্দদাসের বয়স তখন ৪০। গদাধর প্রভুর প্রয়াণের সংবাদ পেয়ে শ্রীনিবাস আচার্য বৃন্দাবনে চলে গিয়েছিলেন। শ্রীখণ্ডের রঘুনাথ ঠাকুরের আদেশে রামচন্দ্র তাঁকে ফিরিয়ে আনতে যান। যাওয়ার আগে গোবিন্দদাসকে অধুনা মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলার কাছে তেলিয়া-বুধরী গ্রামে যেতে নির্দেশ দেন। শ্রীনিবাস আচার্য ফিরে এলে তিনি গোবিন্দদাসের কাছে কিছুকাল অবস্থান করেন। এই সময় তিনি গোবিন্দদাসের স্বমুখে তাঁর রচিত পদাবলি গান শুনতেন। এই সময়েই শ্রীনিবাস আচার্যের অনুরোধে গোবিন্দদাস গীতামৃত রচনা করেন। মুগ্ধ শ্রীনিবাস আচার্য তাঁকে ‘কবিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর তিনি বৃন্দাবনে তীর্থে গিয়ে জীব গোস্বামী, গোপাল ভট্ট প্রমুখের সম্মুখে নিজের পদাবলি গান করেন। ফিরে এলে ভক্তগণ তাঁকে নিয়ে মহোৎসব করেন। এই সময় নরোত্তম ঠাকুরের পিতৃব্যপুত্র রাজা সন্তোষ দেবের অনুরোধে তিনি ভক্তিমূলক নাটক সঙ্গীতমাধব রচনা করেন। গোবিন্দদাসের পুত্র দিব্যসিংহও পিতার ন্যায় ভক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর শেষজীবন তেলিয়া-বুধরীর পশ্চিমপাড়াতেই অতিবাহিত হয়েছিল।
গোবিন্দদাস ছিলেন সৌন্দর্যের কবি, রূপানুরাগের কবি। তিনি ভক্তি ও রূপের মধ্যে এক নিবিড় ঐক্যসাধনে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর পদগুলি ভাষা, অলংকার ও ছন্দের সৌন্দর্যে এবং ভাবের গভীরতায় পরিপূর্ণ। রূপসৌন্দর্যের ভাবপ্রতিমা সৃজনে তিনি কতদূর সক্ষম হয়েছিলেন তা পূর্বরাগের এই পদটির বর্ণনা থেকেই পরিস্ফুট হয় –
যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।
তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি।।
এই তীব্র রূপাসক্তিই ছিল গোবিন্দদাসের কাব্যরচনার মূল। তাঁর ভক্তি যত বেড়েছে, যতই তিনি সাধনার উচ্চস্তরে উপনীত হয়েছেন, ততই এই রূপমুগ্ধতা তাঁকে নিয়ে গেছে পূর্ণতার দিকে।
রাসাভিসারের পদে গোবিন্দদাসের জুড়ি সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যে নেই। এই সকল পদে ছন্দে, সুরে, ভাবে ও ভাষায় যে স্বতঃস্ফুর্ত উল্লাস ঝরে পড়েছে, তা অনুধাবন করতে এই একটি পদই যথেষ্ট:
শরদ চন্দ পবন মন্দ বিপিনে ভরল কুসুমগন্ধ।
ফুল্ল মল্লিকা মালতী যূথী মত্ত মধুকর ভোরণী।।
হেরত রাতি ওছন ভাতি শ্যামমোহন মদনে মাতি।
মুরলী গান পঞ্চম তান কুলবতী-চিত-চোরণী।।
শুধু রাসাভিসারই নয়, সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অভিসারের পদে গোবিন্দদাসের জুড়ি নেই। অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মতে, অভিসারের পদে গোবিন্দদাস রাজাধিরাজ। সৃষ্টির আদি মুহুর্ত থেকে বিবর্তনের পথে মানবজীবনের অগ্রগতির সঙ্গে অভিসারের ধারণাটি সম্পৃক্ত। অভিসারের অর্থ নিছক সঙ্কেতস্থানে মিলনার্থে প্রণয়ী-প্রণয়িণীর গুপ্তযাত্রা নয়, অভিসারের অর্থ কাম্যবস্তু লাভে কঠোর কৃচ্ছসাধন। জয়দেব অভিসারের কথা বলেছেন কোমল-কান্ত সুরে – ‘চল সখি কুঞ্জং সতিমির পুঞ্জং শীলয় নীল নিচোলম্।’ কিন্তু গোবিন্দদাসের অভিসার অনেক পরিণত। এই অভিসার সাধনার নামান্তর –
মন্দির বাহির কঠিন কপাট।
চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।
তঁহি অতি দূরতর বাদল দোল।
বার কি বারই নীল নিচোল।।
সুন্দরী কৈছে করবি অভিসার।
হরি রহ মানস সুরধুনী পার।।
ঘন ঘন ঝন ঝন বজর নিপাত।
শুনইতে শ্রবণে মরম মরি জাত।।
দশ দিশ দামিনী দহই বিথার।
হেরইতে উচকই লোচনভার।।
ইথে যদি সুন্দরি তেজবি গেহ।
প্রেমক লাগি উপেখবি দেহ।।
গোবিন্দদাস কহ ইথে কি বিচার।
ছুটল বাণ কিয়ে নয়নে নিবার।।
গোবিন্দদাসের রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদেও পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মিলন, বিরহ, মাথুর প্রভৃতি পর্যায় আছে। তাঁর রাধার মধ্যেও বাসকসজ্জা, খণ্ডিতা, মান-অভিমান, কলহান্তরিতা দশা লক্ষিত হয়। বিদগ্ধ গোবিন্দদাস অন্তর-সংঘাতে বিধ্বস্ত রাধার আত্মগ্লানি, দীনতা, মিনতি পরিস্ফুট করেছেন উৎকৃষ্ট ভাব ও ভাষায়। তবে বিরহের পদে তাঁর সার্থকতা নেই। তিনি আরাধনার কবি। প্রেমের কবি। তাঁর রূপোল্লাসের প্রদীপে বিরহের অন্ধকার অপহৃত হয়েছে।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ছিলেন গোবিন্দদাসের জীবনদেবতা। স্বীয় পদে তিনি এঁকেছেন দিব্যভাবচঞ্চল মহাপ্রভুর অন্তর্জীবনের ছবি –
নীরদ নয়নে নীর ঘন সিঞ্চনে পুলক মুকুল অবলম্ব।
স্বেদমকরন্দ বিন্দু বিন্দু চূয়ত বিকশিত ভাবকদম্ব।।
গোবিন্দদাসকে বলা হয় বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। কবি বল্লভদাস তাঁকে বলেছেন দ্বিতীয় বিদ্যাপতি। তবে বিদ্যাপতির সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য নিছকই ভাষাগত। ভাবগত নয়। বিদ্যাপতির ভাষা ব্রজবুলি। গোবিন্দদাসের ভাষাও বাংলা-অনুসারী ব্রজবুলি। এমনকি তাঁর খাঁটি বাংলা পদও দুর্লভ নয় –
ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণী অবনী বহিয়া যায়।
ঈষৎ হাসির তরঙ্গহিল্লোলে মদন মুরছা পায়।।
ছন্দ-অলংকারের ঝংকারে ধ্বনিমাধুর্যে গোবিন্দদাসের পদ বিদ্যাপতির সমতুল। কিন্তু বিদ্যাপতির পদে ভক্তের আকুতি অনুপস্থিত। তিনি জীবনরসিক কবি। মনে রাখতে হবে, ধর্মক্ষেত্রে বিদ্যাপতি ছিলেন শৈব। গোবিন্দদাস, অন্যদিকে, স্বয়ং বৈষ্ণবই শুধু নন, ষোড়শ শতাব্দীর বৈষ্ণব ধর্মনেতাদের অন্তরঙ্গও বটে। চৈতন্য-প্রবর্তিত ভক্তিধর্মের অন্যতম রসভাষ্যকার গোবিন্দদাস কবিরাজ। বিদ্যাপতি সভাকবি, গোবিন্দদাস ভক্তকবি। স্বভাবতই, বিদ্যাপতির পদে আছে বুদ্ধির দীপ্তি, রাজকীয় আভিজাত্য। সেখানে ভক্তি এসেছে কদাচিত। কিন্তু গোবিন্দদাসের সব ছন্দ, সব অলংকার, সকল ধ্বনির এক এবং একমাত্র গতি হল ভক্তি। রাধাকৃষ্ণ-প্রেমলীলার অন্তর্নিহিত সত্যটি যে সেই জীবাত্মা-পরমাত্মার অপার্থিব সম্পর্ক – সেই বৈষ্ণব তত্ত্বের অনুভূতিরই অন্যতম প্রকাশস্থল গোবিন্দদাসের পদাবলি। এই প্রসঙ্গে তাঁর অভিসার পর্যায়ের পদগুলির উল্লেখ করা যেতে পারে – যেখানে তাঁর প্রতিস্পর্ধী কবি বৈষ্ণব সাহিত্যে বিরল।
http://www.alokrekha.com
বাংলা ভাষা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশাল তথ্য ও ইতিহাস সহ লেখা খুবই প্রশংসনীয়।
ReplyDeleteমধ্যযুগে কৃষ্ণকথা, রাধাকৃষ্ণ প্রেম, চৈতন্যলীলা, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি অবলম্বনে যে বিশাল বৈষ্ণব সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার মূল প্রেরণা ছিল শ্রীচৈতন্যের অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও ধর্মবোধ। এসব বিচিত্র বিষয় রচনার অঙ্গীভূত হওয়ায় বাংলা ভাষার চর্চা ও প্রকাশ ক্ষমতা অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়।
ReplyDeleteলেখাটা মান সম্মত ও অনেক তথ্যবহুল। এই ধরণের লেখা আমাদের আরো বেশি বেশি করে পড়া দরকার আলোকরেখাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDelete"বাল্যলীলার পদে বলরাম দাসের কৃতিত্ব" যদি একটু আলোচনা করেন তাহলে খুব উপকার হয়।
ReplyDelete