কথা
দাও! অভয়ারণ্য হবে পৃথিবী..
ঋতু মীর
অতটুকু
চায়নি বালিকা !
অত
শোভা, অত স্বাধীনতা !
চেয়েছিল
আরো কিছু কিছু কম
আয়নার
দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে
বসে
থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল
অতটা
চায়নি বালিকা !
অত
হৈ রৈ লোক, অত
ভীড়, অত সমাগম !
চেয়েছিল
আরো কিছু কম
একটি
জলের খনি
তাকে
দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল
একটি
পুরুষ তাকে বলুক রমণী !
---আবুল
হাসান
শীতাতপ
নিয়ন্ত্রিত সুনসান অফিস ঘরটা পর্দা টানা আলোছায়ায় অস্বস্তিকর, ভৌতিক। অপরাহ্ণ অলসতায় স্ফীত বপু দেহ আরামদায়ক চেয়ারে প্রায় এলানো। চোয়ালের
উপচে পড়া মেদে তেল চিকচিকে ভাব। অফিস ড্রেসকোড তোয়াক্কা না করে সার্টের
বোতাম অশোভন ইঙ্গিতে বুক অবধি হা করে খোলা।
দৃষ্টি আকর্ষণের অরুচিকর চেষ্টাকে উপেক্ষা করে সরাসরি তাকিয়ে প্রশ্ন করি- আমাকে ডেকেছেন? আত্মসন্মানের টনটনে অহমিকায় আমার দাঁড়ানোর ভঙ্গি অনমনীয়, ঋজু । কাজের সময়ে
শুধুই কাজ পাগল আমি অফিসের এই শেষ বেলায়
যথারীতি ক্লান্ত। কিন্তু
পিয়ন পাঠিয়ে ‘সেলাম’ দেয়া কেন এই অবেলায়? ঢুকতেই
যেন আপাদমস্তক লেহন করে চোখে। আরে বস মেয়ে! এত
কি কাজ! শাড়ি পড়নি যে আজ!
শাড়িতে খুব ভাল দেখায় তোমাকে ! মনের অজান্তে হাত চলে আসে ওড়নায়। অকারণেই টেনে স্বস্থানে আছে কিনা পরখ করি।কানে ঝা ঝা শীশার
পারদ ঢালা অনুভূতি - বলতে ইচ্ছা হয় মেয়ে নই,
একজন ডেসিগনেটেড অফিসার, যেমন আপনি! মুখে স্বভাবজাত সরল হাসি বদলে গিয়ে তখন বাঁকা, চোখে প্রত্যাখ্যানের ঘৃণা, অন্তরে বিষের ছুরি। স্পষ্ট উচ্চারণে বলি – কারও মনোরঞ্জনের জন্য নিচ্ছয়ই অফিসে আসিনা…। ব্যাগ গুছাই
তড়িঘড়ি, টেবিলে অসমাপ্ত কাজ মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। মনটা দুর্বিনীত বিদ্রোহে ফণা তুলে। শরীরটা যেন ধর্ষিতার অপমান, অসন্মানের নিগ্রহে দগ্ধ হয়, জ্বলতে
থাকে সন্ত্রাসী আগুনের মত। আমি সেই নারী! এই আগুন আমার
দেহেই জ্বলে!
১
নারী
নির্যাতন , ধর্ষণ এবং মৃত্যুর ঘটনা আমাকে এই সব অনভিপ্রেত
ঘটনার স্মৃতিতে তাড়িত করে প্রায়ই। জঙ্গলে পড়ে থাকা ধর্ষিতা রূপার রক্তাক্ত লাশের ছবি দেখে মাথায় আগাছার মতো অসন্তোষ গিজগিজ করে, নিস্ফল এক আক্রোশে মনটা
বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বড় হওয়া জীবনে কত শত ঘটনায়
পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ অপমান,
মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে আমাকেও। ঠিক একই রকম যেন! শুধু প্রেক্ষাপট আর মাত্রাটাই যা
একটু ভিন্ন। মনে পড়ে মফস্বলের কর্মস্থল থেকে ঢাকায় বাসে ফেরা আমি রাজেন্দ্রপুর জঙ্গলের কাছে ভয়ে কেমন কুঁকড়ে যেতাম। যদি এই ভর সন্ধ্যায়
গাড়িটা বিকল হয়ে যায় এখানে ! পাশে বসা পুরুষ যাত্রী যদি সুযোগ নেয় গা ঘেঁষে বসার,
ঘুমের ভান করে কাঁধে, গায়ের উপর এলিয়ে পড়তে চায় যদি, সরীসৃপ,
পিচ্ছিল স্পর্শের গোপন হাত চালায় যদি দেহের এদিক ওদিক ! জঙ্গলের পথে এইসব অনাকাঙ্খিত ঘটনার সম্ভাবনায় বাসটা ঠিক কতটা নিরাপদ এই দুশ্চিন্তায় বহুবার
চাকরী ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছে। আজ যখন নারী
ধর্ষণ, নির্যাতন এবং মৃত্যুর ঘটনা পড়ি তখন মনের মধ্যে টুকরা টুকরা, ঘৃণার অতল গর্ভে ছুড়ে দেয়া, প্রায় তলিয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো কি এক রাসায়নিক
বিক্রিয়ায় বিস্ফোরিত হয়ে উঠে আসে । পৃথিবীর এক
নিরাপদ স্বর্গে বাস করে, বয়সের এই মধ্য লগ্নেও
নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়।
২
স্টাফ
লাউঞ্জে ‘ওমেন এবিউজ’ এর পোস্টারটা প্রায়ই
অন্যমনস্কতায় চেয়ে দেখি। চোখের নিচে আঘাতের কালো কালশিটে দাগ, ঠোটের কষে রক্ত, দৃষ্টিতে আতঙ্ক, হতাশাগ্রস্থ এক নারীর মুখ।
বিশ্বের বহু নারীই এখনও ঘরে বা বাইরে, শারীরিক
বা মানসিক কোন না কোন ভাবে
নির্যাতিত। আধুনিক, প্রগতিশীল এই শতাব্দীতে ‘নারীর
ক্ষমতায়ন’ নিয়ে
গাল ভরা বুলি তাহলে কি প্রতিনিধিত্ব করে?
সেকি শুধু বিশেষ দিন পালনের আড়ম্বরে নারীকে কালের যাত্রায় আরও এক ধাপ বন্দী রাখার
আয়োজন? সেকি নারীকে নিয়ে বিপণন কায়দায় মুনাফা লুটেরার আগ্রাসী কোন পুঁজিবাদের বিস্তার? সেকি কিছু স্পর্শকাতর চটকদার বাণিজ্যিক প্রচেষ্টার অবিরাম ঢাক পেটানো? সেকি চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া যে নারীর কোন
অবস্থান নেই, অধিকার নেই, ছিলনা? প্রশ্ন জাগে- আজকের নারী উন্নয়ন, ক্ষমতায়ণ প্রক্রিয়া লাঞ্ছিতা, ধর্ষিতা রুপাদের মানুষের মর্যাদায় নতুনভাবে বাঁচার অধিকার অথবা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে কতখানি ভুমিকা পালন করছে? মানুষ হিসেবে মানুষের কিছু অধিকার জন্মগত, তা অর্জনের বা
কারো কাছ থেকে হাত পেতে নেয়ার বিষয়তো হতে পারেনা। ক্ষমতায়নের নামে নারীর ‘ক্ষমতায়িত' হবার
সূক্ষ্ম বিষয়টা আয়োজনের ঢাকঢোলে সুকৌশল এক পর্দার অন্তরালে
ঢাকা পড়ে যায়। নারী উন্নয়ন নামের সেই মহামূল্য সংবিধানটি হয়ে পড়ে অরক্ষণীয়। ক্ষমতায়ন! সেতো ঘটবে নারীর মন থেকে, তাঁর
চেতনা থেকে, তাঁর সমাজ ও ঘর থেকে।
জীবনের সব ক্ষেত্রে নারীর
নিজস্ব চিন্তা, শক্তি ভাবনার প্রতিফলন ঘটলে সর্বোপরি জীবনকে অন্যের নিয়ন্ত্রন মুক্ত রাখার যোগ্যতা সৃষ্টি হলে তবেই তো হবে ক্ষমতায়ণ
!
৩
রূপার
ধর্ষকদের ধড়া পড়ার খবরটা বারবার পড়ি । এক
জ্বালামুখ আগ্নেয়গিরি বুকের ভেতর লাভা ছড়ায় । এই মুখ,
এই দেহ, দেহের প্রতিটি বাঁকে নিস্পাপ সৌন্দর্য, পবিত্র নির্জনতা হরণ এবং সব শেষে খুন
করার ক্ষমতা, অধিকার কে, কেন, কখন, কিভাবে পেলো? তিক্ত স্মৃতির খোলা পাতাটা বন্ধ করা হয়না আমার। মনে পড়ে- মফস্বলে একটা প্রশিক্ষণের
দায়িত্বপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী প্রশিক্ষক হয়ে যাওয়া এবং পরবর্তী তিক্ত ঘটনা। কোর্স উদ্বোধনী ভাষণ, এর উদ্দেশ্য, মেটেরিয়াল
তৈরি, আনুষঙ্গিক জিনিষপত্র এবং সর্বোপরি নিজের সংসারটা গুছিয়ে রেখে তবেই রওনা। কর্মস্থলে পৌঁছে প্রস্তুত হয়ে বের হতেই চোখে পড়ে হোন্ডা পাশে ঢ্যাঙ্গা মতন একজন, দৃষ্টিতে শেয়ালের ধূর্ততা, দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে মাতব্বরি, মহা আবদার আর অভিভাবকত্ব গলার
সুরে। বলে- চলেন ম্যাডাম আপনেরে হোন্ডায় স্কুলে পৌঁছাইয়া দেই। আমার চোয়ালে ত্বরিত কাঠিন্য, গলার স্বরে স্বভাব বিরুদ্ধ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আদেশ, বলি- রিক্সা ডাকুন, আমি একাই যেতে পারবো। সারদিনের
ব্যস্ততায় শরীরে অবসাদ, যাত্রার ধকলতো আছেই। রেস্ট হাউসে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থায় মনে স্বস্তির আনন্দ। অথচ ঘুমাতে যাওয়ার উপায় নেই। ঘর জাঁকিয়ে বসে
আছে মহিলা সঙ্গলোভী পুরুষ অফিসার আর সাথে সকালের
সেই হোন্ডাধারী টাউট । সকালের কঠিন
মুখটা কি তাহলে যথাযথ
কঠিন হয়নি! অযথা গল্পে রাত বাড়ে কিন্তু ঘর ছেড়ে উঠতে
চায়না কিছুতেই। ঢাকায় ফিরে এই প্রসঙ্গ উঠতেই
ফেটে পড়ি রাগে। সেদিন ঘর ছেড়ে উঠে
যেতে বাধ্য হওয়ায় নির্লজ্জ পুরুষ আহত এক হিংস্র নেকড়ে
এখন। পিচ্ছিল কণ্ঠে, নোংরা হাসিতে শরীর কাঁপিয়ে সরু চোখে তাকায়, বলে - আপনি এমন কি সুন্দরী হইলেন
যে...! এই স্পর্ধার যোগ্য
জবাবের রুচি বা ক্ষমতা সেদিন
ছিলনা।
৪
সভ্যতার
শুরুতে নারী পুরুষের যৌথ বসতির পৃথিবীটা এমন ছিলনা বরং মানুষ হিসাবে মানুষের বাঁচার, বিকশিত হবার শ্রেয়োবোধটি ছিল প্রধান। দিনে দিনেই নারী ছিটকে পড়েছে ‘মানুষ’ নামের বিশেষণ থেকে। সামাজিক অধিকারের হিস্যা নয়, এই মুহূর্তে নারীর
মানবিক অধিকারের হিসাবটাই যেন বূঝে নেয়া জরুরী। লাঞ্ছনায়,
অবমাননার ঘটনায় লজ্জা বা ভয়ে নীরব
থাকার খেসারত নারীকে দিয়ে যেতে হচ্ছে এখনও। নির্যাতন সেটা শারীরিক বা মানসিক যে
মাত্রায়ই হোক জীবনের অপ্রীতিকর, অনাকাঙ্খিত ঘটনা প্রকাশে নারীকে অবশ্যই মুখ খুলতে হবে। নারীবাদ সমাজে নারীর সমঅধিকার ও ক্ষমতায় বিশ্বাস
করে। নারীবাদ মানেই সর্বাঙ্গে পুরুষ বিদ্বেষ- এই ধারনা ভুল।
A feminist is anyone who recognizes the equality and full humanity of women and
men (Gloria Steinem)।
এই দৃষ্টিকোণে পুরুষ আমার প্রতিপক্ষ নয়, কাঙ্ক্ষিত এক মানবিক স্বত্বা।
তাকে ভালোবেসেই ‘ভালবাসা’ শব্দটির
অর্থ উন্মোচিত আমার কাছে। পুরুষ
আমার নির্ভরতা, শক্তি, আমার স্বপ্নের পৃথিবীর নিপুণ কারিগর । আমি তার
প্রেম, প্রেরণা, তার অসহায়ত্বে সুনিবিড় আশ্রয় । পুরুষ তার
অমর ক্ষমতায় নারীর রক্ষাকবচ হবে, প্রতিহত করবে সকল সহিংসতা, সমাজ এবং নিজ মানসিকতায় পরিবর্তন আনবে আমূল- আমি সেই সময়ের স্বপ্ন দেখি। পুরুষতন্ত্রের উত্তারাধিকারে পাওয়া সেই শ্রেষ্ঠত্বে নয়, বিবেক
শাসিত ঐশ্বরিক ক্ষমতায় অর্জন কর নারীকে, হয়ে
ওঠো পুরুষোত্তম। হে পুরুষ ! অভয়ারণ্য
হবে রূপার পৃথিবী- আজ সেই কথাটাই
দাও! নিন্দিত
নরকের সব দুয়ার ভেঙ্গে
অনিন্দিত আবহে রুপা বিকশিত হবার সুযোগ পাবে, শরীরে ও মনে হয়ে
উঠবে পরিপূর্ণ এক নারী-এই
প্রত্যাশায় আমি জেগে এখনও। অমিত শক্তি আর সম্ভাবনার অভয়ারন্য
সেই স্বর্গীয় পৃথিবীতে রুপা, আমি, আমরা থাকবো তোমার পাশাপাশি, সমান্তরাল !
উৎসর্গ
– রূপাকে
http://www.alokrekha.com
কি বিষয় বস্তু, কি চমৎকার ভাষাভাব অপূর্ব ও শব্দচয়ন ও রচনা শৈলী মিলিয়ে অনবদ্য।
ReplyDeleteকথা বা শব্দ দিয়ে ছবি আঁকা, শুধু ছবি বলি কেন, চলচ্চিত্র তৈরী করে একটা বিষয়কে, একটা বক্তব্যকে তুলে ধরার শৈল্পিক যোগ্যতা ঋতু মীর এর যেন সহজাত ! তার লেখা আমি সবসময়েই ভীষণ উপভোগ করি। কিন্তু আজকের এই লেখা পড়ে একটা বিরাট সমস্যায় পড়েছি ! যদি বলি, আহা, কি সুন্দর লেখা ! সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকের মত সপাং করে একটা চাবুক যেন আঘাত করে আমার সেই উচ্ছাসটাকে! কি সুন্দর? কোথায় সুন্দর? যে বিষয়, যে ঘটনা, যে মানুষ নিয়ে লেখা সেগুলো সুন্দর? লেখায় চিত্রায়িত ঘটনাবলী, পরিবেশ আর টেবিলের ওপারের মানুষ বা হোন্ডা মোটর সাইকেলের আরোহী সুন্দর? কি সুন্দর ঘাড় মটকে মেরে ফেলা ধর্ষিতা রুপার?
ReplyDeleteআমায় মাফ করবেন, ঋতু মীর, আপনার লেখা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে "খুব সুন্দর হয়েছে" বলতে পারলাম না ওই চাবুকের আঘাতে! আর কথা দেবার কথা বলেছেন, সেটাও দিতে পারবো না। কারণ যদি বলি, কথা দিলাম, সেটা হবে শুধু "কথার কথা!"
এখানেই এক লেখকের সার্থকতা।যা অসুন্দর কুৎসিত সমাজের অপাংতেয় সত্য তা এমনভাবে তুলে ধরা যাতে আমাদের আত্মাকে নাড়া দেয় এমন করে বলে উঠতে পারে না " বাহ্ দারুন লেখাতো ".বরং বাস্তবতা,ভয়ঙ্কর সত্য দারুন শব্দের বিষাক্ত জ্বালা ধরায় মনে। এমন লেখায় আলোকরেখাকে অলংকৃত করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ ঋতু মীর।
Deleteঋতু মীর'র অনিন্দ্য এক লেখা কথা দাও! অভয়ারণ্য হবে পৃথিবী। আমি অপেক্ষায় থাকি তাঁর লেখার জন্য ।খুব কম লেখা পাই তবুও মনটা ভরিয়ে দেয়। জীবনের এমন গভীর ভাবনা, প্রতিফলন ও তার অভিব্যক্তির প্রকাশ তারউপর সমাজের সবচেয়ে ঘৃণ্যতম ছবি প্রস্ফুটিত। মনে প্রজ্জলিত এক না পাড়ার ক্ষোভ জন্মায় এমনি বিষয় বস্তু। চমৎকার ভাষাভাব অপূর্ব ও শব্দচয়ন ও রচনা শৈলী মিলিয়ে অনবদ্য । অনেক ভালোবাসা ঋতু মীর
ReplyDelete