ইফতেখার আজিজ
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ । চারিদিকে প্রচণ্ড যুদ্ধ,
মৃত্যুর দামামা আর আগুনে জ্বলছে গোটা জার্মানি। কিন্তু প্রেম মানে না
কোন বাধা। প্রেমকে বেঁধে রাখতে পারে না কোন যুদ্ধ কোন বিগ্রহ। তেমনই দ্বিতীয় মহা
যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে একটি সত্য ঘটনা
অবলম্বনে এই গল্প।
দ্বিতীয় মহা যুদ্ধের সময় জার্মানির
বার্লিন শহরে একটি ইহুদি মেয়ে সোফিয়া আর একটি ইহুদি ছেলে এরিক, পরস্পর পরস্পরকে ভীষণ
গভীর ভাবে ভালোবাসে। । তাদের জীবনের ঘটনাবলী আজকের গল্প গাঁথা।
সোফিয়া খুব ছোট থাকতে বাবা মাকে হারিয়ে একটি "foster home" এ বড় হয়।সোফিয়া বার্লিনের একটি ছোট রাস্তার মোড়ে একটি ফুলের দোকানে কাজ করে আর এরিক স্থানীয় পোস্টঅফিসের পোস্টমান। ফুলের
দোকানে চিঠি বিলি করতে গিয়ে সোফিয়ার সাথে এরিকের পরিচয় আর সেই থেকে বন্ধুত্ব
। অপরূপ সুন্দরী সোফিয়া'র মিষ্টি হাসি ও
স্বভাবসুলভ অমিয় ব্যবহারে এরিক সোফিয়ার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে।এরিক ছিল খুব লাজুক প্রকৃতির তাই কথাটি
সোফিয়াকে তখনও বলতে পারেনি।
মাঝে মাঝে সোফিয়া আর এরিক কাজ শেষে একসাথে একই পথে বাড়ি ফেরে। একদিন তারা একটি পুলের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখতে পায় পুলের নিচে পানিতে পড়ে একটি বেড়াল হাবু
ডুবু খাচ্ছে। এরিক সাথে সাথে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে
বেড়ালটিকে উদ্ধার করে আনে। সোফিয়া বেড়াল খুব ভালোবাসতো আর এই ঘটনার পর সোফিয়া
এরিকের প্রেমে পড়ে। শুরু হয় তাদের প্রেম গাঁথা ,একসাথে সিনেমা দেখা ,ছুটির দিনে দূরে সমুদ্রো তীরে হাতে হাত ধরে হাঠতে
হাঠতে জার্মানির সমুদ্র তীরের অপূর্ব সূর্যাস্ত দেখা ,
রাতে পাশাপাশি বসে আকাশের তারা
গোনা।
একদিন একটি নির্জন পার্কে পাশা পাশি বসে এরিক সোফিয়ার ঘাড়ে আর চুলে মাঝে মাঝে আলতো ভাবে নাক ঘষে আদর
করছিলো, তখন সোফিয়া বললো "এরিক আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি , আমাকে কোনোদিন ছেড়ে যেও
না।এরিক বললো
এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় মহা যুদ্ধের
প্রচন্ড ধ্বংস আর প্রলয় অবক্ষয়। পৃথিবী ঢলে পড়ে ধ্বংস আর অনিশ্চয়তায়। শুরু
হয় এডলফ হিটলারের ইহুদিদের উপর অমানুষিক অত্যাচার
নিপীড়ন নির্যাতন। লাখো ইহুদিদের ধরে ধড়ে পাঠানো হলো "forced labour "camp,concentration camp" ও বিভিন্ন "Ghetto "- এ তে।
সোফিয়ার ফুলের দোকানে হলো ভাঙচুর আর
লুটতরাজ ,পরে বেদখল করে ফেলে জার্মান সৈন্যরা । এরিকের চাকরি
যায় । চারিদিকে ইহুদিদের ধর পাকড়। সোফিয়া আর এরিক ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়। এই বিপদের
দিনেও তারা উপলব্ধি করে পরস্পরের প্রতি
পরস্পরের ভালবাসা আরো গভীর ভাবে ।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। কালো পোশাকের Heinrich
Himmler এর Special Gestapo বাহিনী ইহুদিদের ধর পাকড়
আরো জোরদার করলো।আরো কিছুদিন পালিয়ে থাকার পর অবশেষে একদিন দুজনে একসাথে ধরা পড়লো।
সোফিয়া এরিককে জড়িয়ে ধরলো ,কান্নায় ভেংগে পড়ে বললো "আমি নিতে দেব না তোমাকে". গেস্টাপো পুলিশ
টেনে হিচড়ে এরিক কে নিয়ে গেল ,সোফিয়া এরিক এরিক বলে চিত্কার করতে লাগলো। ওলোট পালট হয়ে গেল ওদের জীবন ,ভেংগে ছুড়ে চুরমার হয়ে
গেল সব স্বপ্ন।
ট্রেন-এ ওদের পাঠানো হচ্ছে কোনো Forced Labour Camp
এ। স্টেশন - এ দুটো ট্রেন পাশাপাশি ,
জানালা দিয়ে সোফিয়া হঠাৎ দেখতে পেলো অন্য ট্রেন-এর জানালায় এরিক।
এরিক এরিক-- বলে সোফিয়া চিৎকার করতে থাকে
,
"চিন্তা করো না লক্ষিটি,
তোমার আমার আবার দেখা হবেই , আমার বুকের
মাঝে থাকবে তুমি-"---এরিক বলে।
সোফিয়ার ট্রেন-এর whistle বেজে উঠলো, ধীরে ধীরে আগাতে লাগলো ,সোফিয়ার দৃষ্টি থেকে তার
এরিক হারিয়ে গেল, চলে গেল দূরে। .............অনেক দূরে.
সোফিয়াকে পাঠানো হল রাশিয়ান বর্ডারে ,আহত জার্মান সৈনিকদের সেবা করার জন্য।
আর এরিকের দুর্বিষহ জীবন কাটতে লাগলো forced
labor camp এ।
পাঁচ বছর চললো দ্বিতীয় মহা যুদ্ধ, প্রায় সাত কোটি মানুষ মারা গেল সারা পৃথিবীতে। নারী
শিশু নির্বিচারে সত্তর লাখ ইহুদি
হত্যা করলো হিটলার। মিত্র বাহিনীর carpet bombing এ ধূলিসাৎ হলো জার্মানির
সব শহর।
যুদ্ধ শেষ হলো ,ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেল এরিক।
যুদ্ধ বিধস্ত জার্মানিতে এরিক বহু বছর
দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে
খুঁজে ফিরলো তার প্রাণ প্রিয় সোফিয়াকে।
সোফিয়াকে না পেয়ে শেষে এরিক পাড়ি দিল সুদূর
আমেরিকায়। এরিক সোফিয়ার স্মৃতি
বুকে করে কাটিয়ে দিলো জীবনের আরো ৫০টি
বছর।
এখন বয়স ৭০ বছর ,শেষে জায়গা হলো এক
বৃদ্ধাশ্রমে। একদিন বিকেলে এরিক পাশের একটি পার্কের বেঞ্চে বসে সোফিয়ার কথাই ভাবছিলো ,হঠাৎ দেখে একটু
দূরে এক বৃদ্ধা লাঠিতে ভর করে , মৃদু পায়ে অতি কষ্টে হেটে যাচ্ছে-
চোখের দৃষ্টিও কমে গেছে এরিকের ,চশমাটা মুছে আবার চোখে দিলো এরিক ,এবার বৃদ্ধাকে চেনা চেনা
মনে হলো , একটু এগিয়ে গেলো এরিক ,কাছে গিয়ে অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ালো এরিক ,এ যে সোফিয়া ,
এও কি সম্ভব ? অতি কষ্টে আবেগকে সামলে ,বলে ,
"সোফিয়া ", সোফিয়া-
সোফিয়া ঘুরে তাকালো এরিকের দিকে, এরিক আর সোফিয়া জানে না সেদিন কতক্ষন তারা এভাবে একে
অপরের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল।
তাই মনে হয়।
....... বহু দিন বিসৃত, বহুকাল মৃত ,
কোনো শুকনো ফুলের পাপড়ি যদি কেউ
আবিষ্কার করে তবে তার যেটুকু মূল্য আছে , সে শুধু তার
কাছেই যে তাকে একদিন সুন্দর সজীব সুগন্ধময় অবস্থায় ধরে রেখে ছিল।
http://www.alokrekha.com
দ্বিতীয় মহা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা প্রেমের গল্পটি পরে খুব ভালো লাগলো। ভালোবাসা অবিনশ্বর তাই প্রমান করে এই গল্প। অনেক মর্মস্পশী ও মন মুগ্ধ্কর চিরঞ্জীব প্রেম।
ReplyDeleteইফতেখার আজিজের "আরেকটি অমর প্রেম" গল্পটি পড়ে খুব ভালো লাগলো। অতি সাধারণ ব্যঞ্জনায় তিনি তুলে ধরেছেন একটি প্রেম কথা ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। আন্তরিক অভিনন্দন লেখককে।
ReplyDeleteএতদিন আলোকরেখায় কোন কিছু না প্রকাশ হওয়ায় বেশ হতাশ হয়েছিলাম। আজ একেবারে দুটি অনবদ্য লেখা পেয়ে খুব আনন্দিত হলাম। আমাদের যেন আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে না হয়।
ReplyDeleteঅনিন্দ্য এক প্রেম কাহিনী। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম লেখার প্রকাশের জন্য । ইফতেখার আজিজের এই "আরেকটি অমর প্রেম" গল্পটি পড়ে খুব ভালো লাগলো। মনটা ভরিয়ে দিল। দারুন অনুভূতি বার বার পড়তে ইচ্ছে করে। ! আলোকরেখাকে ও লেখককে অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা ।
ReplyDeleteইফতেখার আজিজের এই "আরেকটি অমর প্রেম" গল্পটি পড়ে খুব ভালো লাগলো। সহজ সরল ভাষায় অনিন্দ্য এক প্রেম কাহিনী। ছবিসহ গল্পটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা আলোকরেখাকে ও লেখককে।
ReplyDeleteঅতি সারাধন একটা গল্প দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অনন্য হয়েছে। ছোট ছোট ঘটনা -যুদ্ধের ভয়ংকর প্রলয়ে ওদের জীবনে যে অভিশাপ নেমে এসেছিলো। ওদের অমর প্রেমের কাছে নতি স্বীকার করে প্রেম জয়ী হয়েছে। ভাল লাগলো গল্পটা পড়তে। বিশেষ করে ছবিগুলো গল্পটিকে অন্য মাত্রা দান করেছে
ReplyDelete