স্মৃতির মশাল( সত্য ঘটনা)
ইফতেখার আজিজ
তখন আমার তরুণ বয়স , সতরের কোঠায় । মেট্রিক পরীক্ষার্থী , চোখ ভরা কত শত রঙিন স্বপ্ন। মা,বাবা আর চার ভাই , এই ছয় জনের সুখের সাংঘার।
আমি সবার ছোটো ,তাই আদরের আর ডানপিটেও বটে। বাবা ব্যাবসায়ী , মা একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী। আমাদের বাড়িটি ছিল ঢাকায় হাটখোলা দৈনিক ইত্তেফাক অফিসের পাশেই।
আমি সবার ছোটো ,তাই আদরের আর ডানপিটেও বটে। বাবা ব্যাবসায়ী , মা একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী। আমাদের বাড়িটি ছিল ঢাকায় হাটখোলা দৈনিক ইত্তেফাক অফিসের পাশেই।
১৯৭১ এর মার্চ মাস , উত্তাল সারা দেশ ।বীর বাঙালি জেগেছে তার
স্বাধিকার
আর স্বাধীনতা আন্দোলনে। চারিদিকে মিটিং ,মিছিল। পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে চলছেই চরম অসহযোগ আন্দোলন, পাকিস্তান সরকারের পূর্ব পাকিস্তান প্রশাসন একেবারেই ভেঙে পড়েছে। তার পর বঙ্গবধূর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারা দেশ যেন রাজপথে নেমে এলো , উড়লো চার দিকে লাল সজবুজের পতাকা।
২৫শে মার্চ বিকেল চারটার দিকে আমার গৃহ শিক্ষক বিমল বসু আমাকে পড়িয়ে গেলেন।উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজ বিভাগের
ছাত্র ছিলেন, থাকতেন জগন্নাথ হলে।এরপর আমি হেটে চলে গেলাম পল্টন ময়দানে , সেখানে কাজী জাফরের মিটিং চলছে। বক্তৃতা দিচ্ছেন কাজী জাফর ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বলছেন " কেন আপনি ওদের (পশ্চিম পাকিস্তানিদের ) সাথে আর কথা বলছেন ,ওরা আমাদের ক্ষমতা দেবে না , এসব পশ্চিম পাকিস্তান থেকে
এখানে আরো সৈন্য আনার টাল বাহানা”।
কদিন ধরে ঢাকা বিমান বন্দরে প্লেন বোঝাই করে পাঞ্জাবি সৈন্য আসছে। কি জানি কি ওদের মতলব ,এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে এলাম। চারিদিকে কেমন যেন একটা থম থমে ভাব। রাতে অনেক কুকুরের ডাক । মা বলতেন রাতে কুকুর ডাকা নাকি অশনি সংকেতের লক্ষন। সবার বড় ভাই আশফাকুস সামাদ ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র। ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিলেন , প্রায় রাত ১০টার দিকে উনি টেলিফোনটা রেখেই বললেন , পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে কথা বার্তা "fail " করেছে , রাত বারোটায় পাকিস্তানী সেনা বাহিনী নামছে আন্দোলন দমন করতে।
দৌড়ে পাশে ইত্তেফাক পত্রিকা অফিসে গেলাম , বার্তা কক্ষে দেখলাম সাংবাদিকদের মাঝে উত্তেজনা বিরাজ করছে । ওনারাও বললেন আজ রাতে কিছু একটা ঘটতে ।যাচ্ছে। পাশে গোপীবাগ গলির ভেতরে গেলাম। দেখি আমার বন্ধুরা আরো অনেকের সাথে পাড়ার বড় ভাইদের নেতৃত্বে রাস্তার ড্রেনের বড় বড় "স্লাভ" উপড়ে ব্যারিকেড দিচ্ছে । আমিও হাত লাগলাম ওদের সাথে। তখন রাত বারোটা। দূরে মেশিনে গানের গুলির আওয়াজ। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল , বুকের ভেতর ধপ ধপ করছে , কিছুটা ভয় আর চরম উত্তেজনা মেশানো এক অনুভতি যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
শুরু হলো পৃথিবীর জঘণ্যতম নর হত্যা। পাকবাহিনী এই হামলার নাম দিয়েছিল "অপারেশন সার্চ লাইট"- এর পরিকল্পনা করেছিল মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা। অধিনায়ক ছিল ব্রিগেডিয়ার জাহান -জেব আরবাব। ট্যাংক, কামান , মেশিনগান ও ভারী অস্ত্র নিয়ে পাক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরস্ত্র বাঙালির উপর। প্রথমে আক্রমণ করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে। হল গুলোর ঘরে ঘরে ঢুকে নির্বিচারে হত্যা করলো অসংখ ছাত্র ও শিক্ষকদের। ওদের বেশি আক্রোশ ছিল জগন্নাথ হলের উপর, ছাত্রদের গুলি করে আর বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করে হলের মাঠেই গণ কবর খুদে ওদের পুঁতে ফেললো। এদিকে পাক বাহিনীর আরেক অংশ আক্রমণ করলো রাজারবাগ পুলিশ লাইন আর পিলখানা বি ডি আর সদরদফতর। ওখানে আগেই কৌশলে নিরস্ত্র করা হয়েছিল বি ডি আর বাঙালি জোয়ানদের। মারা গেল বহু বাংলালি সৈনিক।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশরা ঘটনা টের পেয়ে অস্ত্রাগারের তালা ভেংগে নিয়ে নিলো রাইফেল আর গুলি। পাক বাহিনী রাজারবাগের প্রধান ফটকে আসতেই ওদের উপর প্ৰচণ্ড গুলি বর্ষণ করলো বাঙালি পুলিশ , হতাহত হলো বহু পাঞ্জাবি পাক সৈন্য। প্রথমে না পেরে পরে দূর থেকে কামান দিয়ে প্রচন্ড গোলা বর্ষণ করতে লাগলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উপর। সারারাত যুদ্ধ চললো - ভোরের দিকে ভারী কামানের গোলায় পুলিশ লাইন প্রায় ধূলিসাদ। চারিদিকে আগুন, দাঁড়াবার কোনো জায়গা নেই। অনেক বাঙালি পুলিশ শহীদ হলো, বাকিরা পুলিশ লাইন ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে গেল , পরে যোগ দিলো মুক্তি বাহিনীতে। পরে ট্যাঁক নিয়ে পাক বাহিনী ঢুকলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনে।
২৬ তারিখ সারা দিন রাত চললো পাক বাহিনীর নারকীয়
হত্যাযজজ্ঞ । জালিয়ে দিলো দৈনিক ইত্তেফাক , The Peoples দৈনিক পত্রিকা ও আরো অনেক প্ত্রিকা অফিস বাড়ি ঘর। পাক বাহিনী রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ফুটপাথে শুয়ে থাকা নিরিহ গরীব মানুষ , রিকশাওয়ালা , দিন মজুর ,ভিক্ষুক ,ছোট দোকানদার আর যাকেই সামনে পেলো তার উপর চালালো মেশিন গানের ব্রাশ ফায়ার।
পুরোনো ঢাকার শাখারি বাজার আর তাঁতি বাজার ছিল হিন্দু প্রধান এলাকা। ওখানে শাখারী আর কিছু স্বর্ণকাররা বসবাস করতো।আর ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো বাদ্য যন্ত্রের দোকান "যতীন " - হিন্দু বলে ওদের ওপর ছিল পাক বাহিনীর বিশেষ আক্রোশ। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করতো যে এখানকার সব হিন্দু পাকিস্তানের শত্রু , আর তারা ভারতীয়দের সাহায্যে মুসলমান বাঙালিদের উসকে আন্দোলনটাকে এই অবস্থায় এনেছে।
সেখানে বাড়ি বাড়ি ঢুকে গুলি আর অত্যান্ত নৃশংসভাবে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করলো অসংখ হিন্দু নারী ,পুরুষ আর শিশুদের। সেকালে শাখারি বাজারের অনেক বাড়িতে পানির কুয়া ছিল।ওখানকার অনেক হিন্দুদের মেরে ওই সব কুয়ায় ফেলেছিলো , অনেক কুয়া মহিলা,শিশুদের আর বৃদ্ধদের লাশে ভোরে গিয়েছিলো।পুরু রাস্তাটা একটি মধ্যে যুগীও কসাই খানায় পরিণত হয়েছিল। সক্ষম পুরুষেরা কেউ কেউ পালাতে পেরেছিলেন , তাদেরই বংশধররা আজও আছেন সেখানে। কিছু বিহারি অনেক দোকান ধখল করেছিল আর রাস্তাটির নাম বদলে "টিক্কা খান রোড" রাখা হয়েছিল।
২৭ তারিখে সকালে ৩ ঘন্টার জন্য কার্ফিউ শিথিল করা হলো । আমি ইচ্ছা করে হাফ প্যান্ট পরে চলে গেলাম জগন্নাথ হলে। আমার গৃহ শিক্ষক বিমল বসুর কক্ষটি চিনতাম ,-- ঢুকে দেখি রক্তাক্ত বিছানা , মেঝেতে রক্ত ।তার পর লাশটিকে টেনে নিয়ে গেছে গণকবর পর্যন্ত। জগন্নাথ হলের অন্যান্য রুমে দেখলাম একই চিত্র।
ভীষণ বিষন্ন হৃদয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
এর পর আমরা ৪ ভাই চলে গেলাম মুক্তি যূদ্ধে, ঢাকার অদূরেই হোমনা থানা, তারপর কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ, চারগাছা পেরিয়ে কসবা দিয়ে প্রবেশ করলাম ভারতের আগরতলায়। সেখানে মেজর খালেদ মোশাররাফ আর ক্যাপ্টেন হায়দারের নেতৃত্বে মেলাঘর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিলাম। চললো ৯ মাস মুক্তি যুদ্ধ। শোচনীয় পরাজয় হলো পাক বাহিনীর।
১৬ ই ডিসেম্বর স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। রণাঙ্গন থেকে বাড়ি ফিরলো মুক্তিযোদ্ধারা।
আমার বড় ভাই লেফটানেন্ট আশফাকুস সামাদ ডাক নাম ছিল "তানি" ২১ এ নভেম্বর ১৯৭১ রংপুরের ভূরুঙ্গামারীতে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে এক প্রচন্ড সুমুখ যুদ্ধে শহীদ হন।তাঁকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়।
শহীদ লেফটেন্যান্ট বীর উত্তম আশফাকুস সামাদ
প্রায় অর্ধ শতাব্দী কেটে গেল কিন্তু আর বলতে পারিনি আমরা ৬ জনের একটি সুখী পরিবার।
স্কুল শিক্ষয়িত্রী , মিসেস সাদেকা সামাদের কোল খালি করে চলে গেল তার বড় আদরের মিষ্ট ভাষী ,সদা হাস্য উজ্জ্বল ,৬ ফুট লম্বা ,সুন্দর সুঠাম দেহি জোষ্ঠ পুত্র "তানি"।
http://www.alokrekha.com
ইফতেখার আজিজ-এর স্মৃতির মশাল পরে খুব ভালো লাগলো। সেই সময়কার স্মৃতি তার মনে আজ মশালের মোট উজ্জ্বল ও জ্বলন্ত। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল একটি সুখের সংসার তছনছ হয়ে গেল পাক বর্বর হানাদার বাহিনীর কোরাল গ্রাসে। লেখকের সাথে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি
ReplyDeleteউদয়ের পথে শুনি কার বাণী নিস্শেষে প্রাণ যে করিবে দেন ক্ষয় নাই তার ক্ষয় না - শহীদ লেফটেন্যান্ট বীর উত্তম আশফাকুস সামাদ আপনার রক্ত বৃথা যায়নি। আজ আমরা পেয়েছি একটি দেশ ,পেয়েছি জাতি সত্ত্বা ও একটি মানচিত্র। আপনার ঋণ কোনদিন শোধ হবে না কিত্নু আপনি থাকবেন অম্লান বাঙালির মনে চিরকাল।
ReplyDeleteঅনিন্দ্য এক লেখা । স্মৃতির মশাল ইফতেখার আজিজের ২৫ শে মার্চের স্মৃতি নিয়ে গেল সেই ভয়াল ৭১-এর ২৫ শে মার্চ-এ ।কত কষ্টের অনুভূতি কত ভয়াবহ সেই দিনগুলি।জীবনের এমন গভীর ভাবনা, প্রতিফলন ও তার অভিব্যক্তির প্রকাশ। অপূর্ব ও শব্দচয়ন ও রচনা শৈলী মিলিয়ে অনবদ্য ও অনিন্দ্য এক লেখা ।খুব ভালো। অনেক ভালোবাসা লেখক।
ReplyDeleteসুন্দর এক লেখা ।আমরা ৭১ এর ২৫ শে মার্চ ও তার তান্ডব ভহাবহ প্রলয় দেখিনি।স্মৃতিচারণ পড়ে আমরা জানতে পারি কত কষ্টের কত ভয়াবহ ছিল সেই দিনগুলি।যারা সেই দিনগুলি প্রতক্ষ্য করেছে তাদের উচিত আমাদের প্রজন্মের জন্য এসব লিপিবদ্ধ করা। শহীদ লেফটেন্যান্ট বীর উত্তম আশফাকুস সামাদ আপনার রক্ত বৃথা যায়নি। আজ আমরা পেয়েছি একটি দেশ ,পেয়েছি জাতি সত্ত্বা ও একটি মানচিত্র। আপনার ঋণ কোনদিন শোধ হবে না কিত্নু আপনি থাকবেন অম্লান বাঙালির মনে চিরকাল।
ReplyDelete