বরেণ্য
অভিনেত্রী রানী সরকার। একটি নাম। একটি সম্পূর্ণ
চলচ্চিত্র।বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নাম আসলে- আসে রানী সরকারের নাম। কিংবদন্তী এই অভিনেত্রী দাপটের সাথে অভিনয় করে গেছেন বাংলাদেশ
চলচ্চিত্রে। তাঁর অসাধারণ অভিনয় দিয়ে শুধু বাংলা চলচ্চিত্রের অঙ্গন কাঁপিয়ে তোলেননি দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তদানীন্তন পশ্চিম
পাকিস্তানের উর্দু ছবিতেও।
রানী
সরকারের আসল নাম মোসাম্মৎ আমিরুন নেসা খানম। রানী সরকার বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা
জেলার কালীগঞ্জ থানার সোনাতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সোলেমান মোল্লা
এবং মাতার নাম আছিয়া খাতুন। তিনি সাতক্ষীরার সোনাতলা গ্রামের ইউপি স্কুল থেকে প্রাথমিক
পাঠক্রম শেষ করেন। এরপর তিনি খুলনা করোনেশন গার্লস স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। সেই
ছোট বেলা থেকে তাঁর অভিনয়ের প্রতি ঝোক ছিল
আর সেই কারণেই তাঁর অভিনয় জগতে আসা।
আজ বলা যতোটা সহজ হচ্ছে, রানী সরকারের শুরুটা অতো সহজ ছিল না।
ষাট দশকের বাংলাদেশে মুসলিম পরিবারের একজন মেয়ে হয়ে সিনেমায় আসাটা রীতিমতো আকাশ কুসুম
কল্পনার ব্যাপার। সেই অসাধ্যও সাধন করেছিলেন রানী সরকার। নিজের অভিনয়ের ইচ্ছেটাকে তিনি ঘুড়ি বানিয়ে উড়িয়েছিলেন স্বপ্ন
জয়ের আসমানে। পেরিয়ে গিয়েছিলেন সমাজ, প্রতিকূল পরিবেশ। ত্যাগ করেছিলেন অনেক অনেক। তৈরি
করে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্রে নারীর জয়গানের আলোকিত এক পথ। সেই ত্যাগ আর আলোকিত পথ ধরেই
এসেছিলেন কবরী, শাবানা, ববিতা, শাবনূর, মৌসুমীরা। চলচ্চিত্রে নারীর জাগরণে রানী সরকার ও তার মতো অভিনেত্রীদের গুরুত্ব তাই আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে অপরিসীম। কোনোদিন সেই গুরুত্বে মরিচা ধরবে না, ধরতে পারবেও না।
এভাবেই শিল্পীরা শিল্পের জন্য পুরো একটা জীবন বিলিয়ে দেন। বিনিময়ে মেলে নাম-ডাক, যশ-খ্যাতি। সবার ভাগ্যে খ্যাতি মেলেও না। সেদিক থেকে ভাবলে রানী সরকার শুধুমাত্রই এক ভালোবাসার নাম। অভিনয় জীবনে একটা যুগের সিনেমাপ্রেমীদের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি।
তিনি ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। রানী সরকারের অভিনয় জীবন শুরু
করেন ১৯৫৮ সালে বঙ্গের বর্গী মঞ্চনাটকের মাধ্যমে
এই বছরই তার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় এ জে কারদার পরিচালিত দূর হ্যায় সুখ কা
গাঁও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এরপর ১৯৬২ সালে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার এহতেশামুর রহমান পরিচালিত
উর্দু চলচ্চিত্র চান্দাতে অভিনয় করেন। সেই ছায়াছবির পর থেকে তার পিতৃপ্রদত্ত নাম
মেরীর বদলে নতুন নাম হয় রানী সরকার। চান্দা চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর উর্দু ছায়াছবি
তালাশ ও বাংলা ছায়াছবি নতুন সুর এ কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। এই ছায়াছবি
দুটিও বেশ জনপ্রিয় হয়। এরপর তিনি প্রায় ২৫০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।তাঁর অভিনয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ বহু পুরস্কার তিনি পেয়েছেন ।
তার
মধ্যে বিশেষ বাংলা চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র
পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা পুরস্কার করে। তার অভিনীত বেশিরভাগ সিনেমাই ছিল আলোচিত। তবে কষ্টের ব্যাপার হলো সরল রেখা হয়ে কাটেনি তার জীবনটা। শেষ জীবনে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। অথচ অভিনয়ের জন্য পুরো জীবনটাই বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার পরিবার বলতে ছিল এই চলচ্চিত্র। বিয়েও করেননি এই অভিনেত্রী। কিংবদন্তিতুল্য অভিনেত্রী রানী সরকার অসুস্থ হয়ে ছিলেন অনেক দিন। শেষ জীবনে বার্ধক্যের কারণে নুয়ে পড়েছিলেন। অভাব অনটনের দিনগুলোতে ডাক পেতেন না অভিনয়ের জন্যও।তবে সরকারের সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। তার সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অসুস্থ অভিনেত্রী রানী সরকারকে ২০ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে শিল্পী বান্ধব এই সরকার। এরপর ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে আবার সরকারি তহবিল থেকে ৫ লাখ টাকার চেক দেন প্রধানমন্ত্রী। তার অসুস্থতা ও দুর্ভোগের কথা শুনে তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে নগদ ৫০ হাজার টাকা দেন।
রানী সরকার দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত ছাড়াও পিত্তথলিতে পাথর, বাতজ্বর,
জটিল কোলেলিথিয়েসিস রোগে ভুগে ২০১৮ সালের ৭ জুলাই ঢাকার ধানমন্ডি ইডেন মাল্টিকেয়ার
হাসপাতালে ইউনিটে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ
করেন। তাকে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত
করা হয়।
তিনি তাঁর অভিনয় জীবনে বহু ছবি করেছেন।তার মধ্যে উর্দু ছবি দূর হ্যায় সুখ
কা গাঁও (১৯৫৮) চান্দা (১৯৬২)
ও তালাশ (১৯৬৩) বাংলা চলচ্চিত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩) সংগম (১৯৬৪)সুতরাং (১৯৬৪) বেহুলা
(১৯৬৬) নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা (১৯৬৭) আনোয়ারা (১৯৬৭) মলুয়া ও অরুণ বরুণ কিরণ মালা প্রভৃতি। রানী সরকার বিখ্যাত চলচ্চিত্র
পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) ছবিতে অভিনয় করে বিশেষ প্রশংসিত হয়েছেন।
অভিনেত্রী রানী সরকারের চলচ্চিত্রের তালিকা
• দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও (১৯৫৮)
• চান্দা (১৯৬২)
• তালাশ (১৯৬৩)
• নতুন সুর (১৯৬৩)
• কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩)
• সংগম (১৯৬৪)
• সুতরাং (১৯৬৪)
• বেহুলা (১৯৬৬)
• সাইফুল মূলক বদিউজ্জামান (১৯৬৭)
• নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা (১৯৬৭)
• আনোয়ারা (১৯৬৭)
• বন্ধন
• ঘর ভাঙা ঘর
• কে তুমি
• ইস ধারতি পার
• পেয়সে
• কেয়সে কাহু
• আযান
• মলুয়া
• অরুণ বরুণ কিরণ মালা
• নাচঘর
• ছদ্মবেশী
• চোখের জলে
• রেশমি চুড়ি
• নোলক
• মৎস্য কুমারী
• পথে হলো দেখা
• সেই তুফান
• মায়ার সংসার
• ভানুমতি
• টাকার খেলা
• ভাওয়াল সন্ন্যাসী
• কাঁচ কাটা হীরা (১৯৭০)
• নাচের পুতুল (১৯৭১)
• তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)
• সমাধান (১৯৭৩)
• রংবাজ (১৯৭৩)
• সূর্য গ্রহণ (১৯৭৬)
• সূর্যকন্যা (১৯৭৭)
• সখী তুমি কার (১৯৮০)
• দেবদাস (১৯৮২)
• চন্দ্রনাথ (১৯৮৪)
• প্রিন্সেস টিনা খান (১৯৮৫)
• মিস ললিতা (১৯৮৫)
• শুভদা (১৯৮৬)
• শ্যাম সাহেব (১৯৮৬)
• ঘানি (২০০৬)
• আয়না (২০০৬)
• এবাদত (২০০৯)
• থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার (২০০৯)
• অবুঝ বউ (২০১০)
• কারিগর (২০১২)
• একই বৃত্তে (২০১৩)
• নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ (২০১৪)
• গ্রাস (২০১৬)[১১]
• খাঁচা (২০১৭)
সানজিদা রুমি কর্তৃক গ্রথিত http://www.alokrekha.com
বরেণ্য অভিনেত্রী রানী সরকার। একটি নাম বাংলা চলচ্চিত্রের।তার সম্পর্কে এত সুন্দর লেখা সত্যি প্রশংসারযোগ্য।
ReplyDeleteবরেণ্য অভিনেত্রী রানী সরকার বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি যে অবদান রেখেছেন তার অবদান পান নি।অবহেলিত রয়েছেন।তাঁকে নিয়ে সানজিদা রুমির লেখা সত্যি প্রশংসারযোগ্য।
ReplyDeleteবরেণ্য অভিনেত্রী রানী সরকার বাংলা চলচ্চিত্রে অবদান তুলে ধরেছেন অনন্য সুন্দর ভাবে ।তাঁকে নিয়ে সানজিদা রুমির লেখা সত্যি প্রশংসারযোগ্য।
ReplyDeleteবরেণ্য অভিনেত্রী রানী সরকারের ব্যক্তিগত জীবন ও কর্ম নিয়ে এমন গভীর ভাবনা, প্রতিফলন ও তার অভিব্যক্তির প্রকাশ সত্য প্রশংসারযোগ্য ।যেমন বিষয় বস্তু, তেমনি চমৎকার ভাষাভাব অপূর্ব ও শব্দচয়ন ও রচনা শৈলী মিলিয়ে অনবদ্য ও অনিন্দ্য। বড্ডো ভালো।
ReplyDelete