নীল বিষ নীল অজগর
মেহরাব রহমান
ভেতরে পুড়ছে সব,
রঙিন রূপকথা,
অপূর্ব আকাশ ।
পুড়ছে পোড় খাওয়া রদ্দুর
গনগনে আগুন কয়লা ।
অন্ধ অন্ধকার
গিলে খাচ্ছে চারিদিক;
ভয়ঙ্কর এই কান্না ।
নীল বিষ নীল অজগর
কামড়ে ধরে সভ্যতা ।
রোম পোড়ে;
কাঁদে রোম নগর ।
সম্রাট নিরো তখনও বাঁশি বাজায়।
পৃথিবীর নিরোরা এভাবেই গান গায় ।
কেন এমন হয়?
কেন সপ্ন ভঙ্গুর?
কেন বং থেকে বাঙলা,
বাংলাদেশ এবং
ব্যাপক বিশ্ব আজ ভাংচুর
রাগান্বিত প্রকৃতি ব্যাথাতুর,
ভীষণ নীরব, বধির l
কান পেতে শোনো
ইতিহাস কথা বলে।
একদিন অরণ্য ছিল
নবজাত শিশু।
অভেদ্য অন্ধকার
ছিল অসূর্যম্পশ্যা,
ছিল ক্ষুব্ধ চরাচর, অথৈ জলরাশি
এবং উন্মাদ সমুদ্দুর।
ঝড় বহে
বহে ঝড়।
জাগেনি প্রেম,
জ্বলেনি অলৌকিক আলোকবর্তিকা ।
প্রাচীন মানবকুল।
ধর্মপ্রচারক তখনও আসেনি ধর্ম প্রচারে।
বাঁচার জন্য পাথরে পাথরে ঘর্ষণ;
সৃজিত আগুন।
আগুন প্রেমে মত্ত লোকেরা অগ্নি—উপাসক ।
বিবর্তন,পরিবর্তনে জেগে ওঠে কৃষ্ণ গহবর l
নানা ঢঙে,নানা রঙে
নানা মাত্রার উপাসনা l
পাহাড়, নদী, ফুল, অরণ্য কথা বলে ;
ক্রমশ: মানুষ মানবিক হয়ে ওঠে ;
যেনবা শুক্লপক্ষের পূর্ণিমার চাঁদ ।
সেই সম্বৃদ্ধ ইতিহাস
আজ পুরানো সংবাদ l
সেই সম্পন্ন সময় থেকে বাকী সব ঠিকঠাক ;
চিলেকোঠার ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ, বিস্তীর্ণ মাঠ, বৃক্ষরাজি,উদার আকাশ,ঋতুচক্র, ইত্যাদি ইত্যাদি l
বিশ্ব প্রকৃতির নিজস্ব উপাসনালয়ে
মন্ত্র বাজে সুমুধুর লয়ে
সুখং স্বর্গং নিবাসং l
হায়! কেবল ক্লান্ত, অবসন্ন ,
ক্ষয়িত মানুষেরা বোঝেনা এতসব l
তাই এখন ভয়ার্ত নগর
স্তম্ভিত বন্দর, স্তব্ধ গ্রাম ;
উপরে বেদনার্ত মেঘ ভাসে
দুঃখ ঝরে অবিশ্রাম
বাজেনা আর আনন্দ ড্রাম l
সব সঙ্গীত থেমে গেছে কার ইঙ্গিতে ?
ভ্রষ্ট সমাজ l
নষ্টবীজ l
পতাকার পবিত্র পদতলে
ওঁৎ পেতে বসে থাকে
হিংস্র হন্তারক l
বিদগ্ধ পন্ডিতের খুন ঝরে
হঠাৎ মৃত্যুর কালো-হাত
কেড়ে নেয় মানব জীবন l
কত নাম, নামের মিছিল l
কষ্টগুলো জ্বলতে জ্বলতে দূর বাতিঘর l
রোম পোড়ে
কাঁদে রোম নগর;
সম্রাট নিরো তখনও বাঁশি বাজায় l
পৃথিবীর নিরোরা এভাবেই গান গায় l
তথাপি অরণ্য অন্ধকারেও
আলোর নাচন পাতায় পাতায় l
ঐযে ঘাসফুল , ঘাসপোকা ,
জেগে আছে সারারাত l
রাত্রি গভীর ; ঝিঁ ঝিঁরা গান গায়
রাত্রি গভীর ; ঝিঁ ঝিঁরা গান গায়
দরবারি কানাড়ায় l
ঐযে নাচ ময়ুরী ঝাঁকেঝাঁকে
কারুকাজ পাখা মেলে
দলেদলে নাচে l
ঐযে দিগন্তে গোধূলি বেলায়
সন্ধ্যারাগে রাগিনী বাজে l
সূর্য থেকে গলে গলে পড়ে
বেলা শেষের আবিরের রং l
এইখানে আলবাট্রস ,গাঙচিল ,
ধবল বক পাড়ি দেয় বিজন আকাশ l
ঐখানে সুন্দরবনের সুন্দরী অরণ্যে
চিতল হরিণীরা খুব চুপিসারে
পুরুষ হরিণদের সাথে
খুনসুটি প্রেমপ্রেম খেলা করে l
ঐযে খরতপ্ত চৈত্র দুপুর
মেঘদেবতা ঝরায় অমৃত জল
ঝরে জল টুপটাপ এপিটাফ l
"জল পড়ে পাতা নড়ে
জল পরে পাতা নড়ে" l
এরকম সুন্দর
জলতরঙ্গের মাঝেও
আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি
এক কঠিন শিলা খণ্ডের উপর l
তবেকি আমাদের ভীষণ অসুখ ?
বর্তমান এক শূন্য, মহাশূন্য l
আমি এক যোগী পুরোহিত ;
আমার রক্তে প্রবাহিত নুরুলদীন
"নুরুলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন শকুন নেমে আসে
এই সোনার বাংলায় l
নুরুলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
যখন আমারই দেশে এ আমারই
দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়,
ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় " l
ঐযে, ঐযে আবার মাদল বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ l
কৃষ্ণ রাত্রি থেকে জাগছে আবার
নুতন সকাল l
এমন সোনালী রোদ্দুর
এমন সোনাঝরা দিন
ভোরের পাখির গান, নবরাগ ভৈরবী তান,
নীল বিষ নীল অজগর, ক্ষুব্ধ আগুন কয়লা,
অন্ধ অন্ধকার, ভ্রষ্ট সমাজ,
নষ্টবীজ এতসব দুঃখ হবে অবসান l
অনির্বাণ উৎসবদিন আজ l
এসো আমরা যূপকাষ্ঠে বলি দেই
আরণ্যক আগ্রাসন l
হাতে হাত রাখো ;
সূর্য সাক্ষী থাক l
এসো নিষেধাজ্ঞা জারি করি
সকল অপ্রেম, বিকলাঙ্গ ধর্মের ওপর l
এসো সব কাগুজে ধর্মের মিথ্যা লেবাস
চিতার আগুনে পোড়াই l
এসো নিষিদ্ধ ঘোষণা করি
নষ্ট হাতে দুষ্ট তরবারি l
এসো আজ নির্বাসন দেই
সমুদ্র -গভীর অতলান্তে
ঘুণেধরা, ঘুণপোকা পূর্ব সমাজ l
চলো সবে উচ্চকন্ঠে বলি
পৃথিবীর একমাত্র রাজধানী
'ভালবাসা নগর'; বলো আমরা
আবার ভালবাসবো l
বলো সবে,
আমি ভালবাসি আলোর ভুবন
আমি ভালবাসি বিপন্ন মানুষ
আমি ভালবাসি ধানসিড়ি নদী ,
নলখাগড়ার বন, অরণ্যের
বিস্তীর্ণ অধিবাসি, এবং এবং এবং
আমি ভালোবাসি পোকামাকড়ের বসতবাড়ি,
সোনালি ডানার চিল,
বিশ্ব -প্রকৃতির অপরূপ রূপ, জোছনা রাতে
জোনাকির জোনাকজ্বলা প্রেম,
আরণ্যক মার্গিয় সংগীত I
ঐযে আসামের পাহাড়িয়া ঢল নামে;
হিমালয়ের বুক চিরে নেমে আসে
ব্রহ্মপুত্র নদ; নুতন জোয়ারের জলোচ্ছ্বাস;
ভূপেন হাজারিকার হৃদপিণ্ডের রক্তক্ষরণ;
সেই অতুল কণ্ঠের দীপ্ত উচ্চারণ, ঘুম ভাঙানিয়া গান
প্রেম জাগানিয়া বান ,
"মানুষ মানুষের জন্যে
জীবন জীবনের জন্যে"
l
মানুষের জন্যে অসম্ভব প্রেম নিয়ে
নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নিয়ে
এসো আমরা জেগে উঠি আরবার l
ঐখানে দূর গ্রাম
গ্রামের ভেতরে গ্রাম
গ্রামের ভেতরে গ্রাম
গ্রামের পরে গ্রাম
তারপর আনন্দধাম; মহাবিশ্বের রাজধানী
আমাদের ভালোবাসা নগর l
একদিন ঝুম বৃষ্টি নামবে l
উদিত হবে নূতন সূর্য, নূতন ভোরে ;
নব অনুরাগে l
ভয়ার্ত নীল বিষ নীল আজগর
ভাঙতে ভাঙতে
পালাতে পালাতে অবসন্ন মমি হয়ে
শুয়ে রবে
দ্বাররুদ্ধ মনুমেন্টের বদ্ধ দেরাজে l
পাদটিকা: আমি সৈয়দ শামসুল হকের নুরুলদীনের সারা জীবন থেকে কয়েকটি লাইন ব্যবহার
করেছি এই কবিতায় l
তাঁর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা এবং অন্তহীন কৃতজ্ঞতা l
http://www.alokrekha.com
কবিতার অলংকরণ বিষয় বস্তু অসাধারণ এক মার্গের। আজ পৃথিবীতে হানাহানি চালচিত্র অপরূপ ভাবা চিত্রিত করেছেন কবি মেহরাব রহমান তাঁর "নীল বিষ নীল অজগর" কবিতায়।
ReplyDeleteমেহরাব রহমান-এর "নীল বিষ নীল অজগর" সুদীর্ঘ কবিতায় উঠে এসেছে কিভাবে সকল কিছু ,সকল রঙিন রূপকথা পুড়ছে সব,গিলে কাছে সকল সভ্যতা নীল বিষাক্ত অজগর। কবিতাটা পড়ে বুকের ভেতর এক অণুরণ সৃষ্টি করেছে। কবিকে অনেক অনেক শুভকামনা এমন এক উচ্চ মার্গের কবিতা উপহার দেবার জন্য। আলোকরেখাকে ধন্যবাদ আমাদের এই কবিতা পড়ার সুযোগ করে দেবার জন্য।
ReplyDeleteমেহরাব রহমান-এর "নীল বিষ নীল অজগর" সুদীর্ঘ কবিতার মন্তব্য লিখতে গিয়ে ভাবছি কোথায় শুরু করবো ? প্রতিটি পংতি উল্লেখ্য।আমাদের সভ্যতার সভ্য সমাজে রোম পোড়ে;
ReplyDeleteকাঁদে রোম নগর তখনও বাঁশি বাজায় সম্রাট নিরো।এভাবেই গান গায় পৃথিবীর নিরোরা এ এক অমোঘ সত্য চিত্রিত করেছেন কবি তাঁর লেখায়। মনটা তৃর্তীতে ভোরে গেল। অনেক শুভেচ্ছা কবি। আলোকরেখার কাছে আমরা এমনি লেখার আশা করি। অনেক ধন্যবাদ !
অনিন্দ্য এক কবিতা " "নীল বিষ নীল অজগর" মেহরাব রহমান দ্বারা রচিত। আমরা অপেক্ষায় থাকি কবি মেহরাব রহমানের কবিতার জন্য। মনটা ভরিয়ে দিল। দারুন অনুভূতি কবিতা বার বার পড়তে ইচ্ছে করে।এখানে কবির মনে হয়েছে এই যে সমাজে কেন এমন হয়?
ReplyDeleteকেন সপ্ন ভঙ্গুর? কেন বং থেকে বাঙলা,বাংলাদেশ এবং ব্যাপক বিশ্ব আজ ভাংচুর রাগান্বিত প্রকৃতি ব্যাথাতুর, ভীষণ নীরব, বধির কান পেতে শোনো ইতিহাস কথা বলে। একদিন অরণ্য ছিল নবজাত শিশু। ! আলোকরেখাকে ও কবি মেহরাবকে অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা ।
কবি মেহরাব রহমানের "নীল বিষ নীল অজগর" অনিন্দ্য এক কবিতা । আমরা অপেক্ষায় থাকি এমন উচ্চ্ মানের কবিতার জন্য।কবির অন্তরাত্মায় ঝড় বহে ক্ষুব্ধ চরাচর, অথৈ জলরাশি উন্মাদ সমুদ্দুর।জাগে না প্রেম,জ্বলেনি অলৌকিক আলোকবর্তিকা। আলোকরেখাকে ও কবি মেহরাবকে অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা ।
ReplyDeleteনীল বিষ নীল অজগর
ReplyDeleteমেহরাব রহমান
চমৎকার ,অপরূপ এক কবিতা
মনটা ভোরে গেল
কবিকে অনেক অভিনন্দন
আর ভালোবাসা
নীল বিষ নীল অজগর
ReplyDeleteমেহরাব রহমান।
বহু দিন পর এমন একটা
উচ্চ মানের অসাধারণ কবিতা পড়লাম।
যত প্রশংসা করি , কম হবে।
কবিকে অনেক শুভেচ্ছা।
আরো এমন কবিতার অপেক্ষায় রইলাম।
উত্কৃষ্ট চমৎকার জীবন বোধের প্রকাশ।
ReplyDeleteঅপূর্ব বিষয় বস্তু,ভাষাভাব ও শব্দচয়ন
ও রচনা শৈলী মিলিয়ে অনবদ্য।”
কবিকে ও আলোকরেখাকে ধন্যবাদ।
TranslateTurn off instant translation
ReplyDeleteকবির কবিতা মন ও মননের সুগভীর অনুচিন্তন,ভাব, অভিব্যক্তি ছায়া দেখতে পাই । অপূর্ব শব্দশৈলী চমৎকার। অপরূপ-বহুবর্ণ ও ভাষার প্রকাশ। উত্কৃষ্ট ও চমৎকার সৃষ্ট কবিতা । অনেক ভালোবাসা কবি।উত্কৃষ্ট চমৎকার জীবন বোধের প্রকাশ
"ভয়ার্ত নীল বিষ নীল আজগর
ReplyDeleteভাঙতে ভাঙতে
পালাতে পালাতে অবসন্ন মমি হয়ে
শুয়ে রবে
দ্বাররুদ্ধ মনুমেন্টের বদ্ধ দেরাজে l
কি সুন্দর কথা। কি গভীর ভাবের প্রকাশ।
কবিকে অশেষ ধন্যবাদ আর অভিনন্দন।
"নীল বিষ নীল অজগর"
ReplyDeleteচমৎকার ,অস্বাক্ষরণ, তুলনাহীন।
শব্দ মালায় গেঁথেছেন জীবনের অনেক সত্য।
কবিকে অনেক অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা।
” অনেক ভালোবাসা আর প্রার্থনা কবির জন্য। ”
আলোকখার চলার পথ সুগম হোক এই কামনা করি।
" পাহাড়, নদী, ফুল, অরণ্য কথা বলে ;
ReplyDeleteক্রমশ: মানুষ মানবিক হয়ে ওঠে ;
যেনবা শুক্লপক্ষের পূর্ণিমার চাঁদ ।
সেই সম্বৃদ্ধ ইতিহাস
আজ পুরানো সংবাদ "
দারুন লিখেছো কবি , দারুন !
কি বলে প্রশংসা করবো , ভাষা নেই আমার।
মনে হয় গোটা বিশ্বটা তুলে দেই তোমার হাতে।
অভিনন্দন তোমাকে। শাবাশ ,শাবাশ , লক্ষ করতালি ,
তোমার জন্য
আবার যেন হয় দেখা , তোমার গভীর লেখার সাথে।