হাসান মীর
জাপানে হরিজন ও আদিবাসী :
বুরাকুমিন ও আইনু ।
কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের জন্য
একটা দেশে গিয়ে সেই দেশের সবকিছু জানা যায়না। আমি জাপানে গিয়েছিলাম সেও অনেক বছর
আগে। সেখানে গিয়ে মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মতো জাপানও হয়তো এক জাতি, এক ভাষার সমজাতিক বা Homogeneous রাষ্ট্র।
কিন্তু একদিন কথা
প্রসঙ্গে সিনিয়র সহকর্মী ইসকান্দার চৌধুরী ( প্রয়াত ) যিনি বহুবছর থেকে জাপানে বাস
করছিলেন, আমাকে জানালেন বিষয়টি তেমন নয়। জাপানেও এখনো অল্প সংখ্যায় হলেও অস্পৃশ্য বা
দলিত্ শ্রেণীর লোক আছে,
আছে মূল জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন কয়েক হাজার আদিবাসী । এই
দলিত শ্রেণী বুরাকুমিন নামে পরিচিত আর আদিবাসীরা হচ্ছে আইনু।
প্রাচীন ভারতে যেমন উচ্চবংশীয়
আর্যরা তাদের সেবার জন্য পেশার ভিত্তিতে মুচি, মেথর, ডোম, চণ্ডাল ইত্যাদি নিম্নবর্ণের
অস্পৃশ্য জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি করেছিল, জাপানেও সেই আদিকাল থেকে বুরাকুমিনদের উদ্ভব। মূলশ্রোতের
জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের কোনো সংস্রব ছিলনা। তারা বাস করতো শহর বা গ্রামের বাইরে
নির্দিষ্ট এলাকার বস্তি বা ঝুপড়িতে, বঞ্চিত ছিল সব ধরণের নাগরিক সেবা ও সুযোগ সুবিধা থেকে। তবে
মধ্যযুগের পর সামন্ত রাজাদের পতন এবং উনিশ শতকের শেষ দিকে সম্রাট মেইজি সমগ্র জাপানের
শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর শ্রেণিভেদ প্রথা বিলোপ করে এক ডিক্রি জারী করেন। এরপর ধীরে
ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে তবে বহুশত বছর ধরে চলে আসা অভ্যাস ও সংস্কার দূর
করা সহজ কাজ নয়। তদুপরি মেইজি আমলে বংশাবলী বা ফ্যামিলি রেজিস্টার চালুর যে নিয়ম
বাধ্যতামূলক করা হয় তা থেকে কে অভিজাত, কে সামুরাই, কে কৃষক বা কারুশিল্পী আর কে অস্পৃশ্য বুরাকুমিনদের বংশধর
তা জানা সহজ ছিল। এরমধ্যে বুরাকুমিনরা লেখাপড়ায় এগিয়ে আসে এবং চাকুরি, বিবাহ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে
বৈষম্য সত্ত্বেও ধীরে ধীরে মূল শ্রোতধারায় মিশতে শুরু করে। তথাপি সরকারি উদ্যোগ
এবং নিজেদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বুরাকুমিনদের অধস্তন পুরুষের অবস্থা এখনও ভালো নয়।
সারা দেশে এই অদৃশ্য জাতিগোষ্ঠীর ( invisible race ) সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ লাখের মতো। ভালো
কাজ, ভালো পরিবেশ থেকে তার এখনও বঞ্চিত। ফলে জাপানের যে সংগঠিত অপরাধচক্র বা ইয়াকুজা
( Yakuza ) তার অধিকাংশ সদস্যই নাকি এসেছে এই সাবেক বুরাকুমিন গোষ্ঠী থেকে।
এবার আদিবাসী আইনুদের ( Ainu / Aynu ) কথা। বলা হয়ে থাকে আইনুরা জাপানি
ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল এখন থেকে ১৪ হাজার বছর আগে। আর জাপানের বর্তমান অধিবাসী যার
নিজেদের সূর্য দেবীর ( জাপানি পুরাণে সূর্য দেবতা নয়, দেবী ) সন্তান বলে দাবী করে থাকেন
তাদের আবির্ভাব তারও চার হাজার বছর পরে। আইনুরা মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়া নাকি দক্ষিণ এশিয়ার
কোনো দেশ থেকে চারিদিকে সমুদ্রবেষ্টিত জাপানে প্রবেশ করেছিল তা নিয়ে বিতর্ক
রয়েছে। মূলধারার জাপানিদের সঙ্গে এদের চেহারা ও গায়ের রঙ মেলেনা। তারা আইনুদের
স্বজাতি বলে কখনো গ্রহণও করেনি বরং ক্রমাগত দক্ষিণ থেকে বিতাড়িত করে শেষপর্যন্ত
একেবারে সর্বউত্তরের হোক্কাইদো দ্বীপে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন হোক্কাইদো ( Hokkaido ) ছাড়াও রাশিয়ার দক্ষিণ সাখালিন ও
কুরিল দ্বীপ ও চীনের কিছু এলাকায় এদের দেখা পাওয়া যায় ( উল্লেখ্য, ১৯০৪-৫ সালে রুশ- জাপান যুদ্ধে
জাপানিরা এই দ্বীপগুলি জাপান দখল করেছিল কিন্তু ১৯৪৫ সালের বিশ্বযুদ্ধে জাপানের
পরাজয়ের পর রুশরা সেগুলি পুনর্দখল করে নেয় ) ।
বস্তুত জাপানের অধিবাসীদের কাছে
আইনুরা চিরকালই বহিরাগত বলে বিবেচিত হয়েছে। মূলধারার জাপানিরা এদের কখনোই স্বীকৃতি
দেয়নি, বরং তাদের অধিকারে থাকা জমি কেড়ে নিয়েছে, কখনোবা পশু ও মৎস্য শিকারের অধিকার
থেকে বঞ্চিত করেছে। দুই পক্ষের মধ্যে কয়েকবার যুদ্ধও হয়েছে এবং যথারীতি আদিবাসী আইনুরা
পরাজিত হয়ে, আগেই যেমন বলেছি ক্রমে ক্রমে দক্ষিণ থেকে উত্তরপ্রান্তে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে।
এভাবে স্থানচ্যুত হতে গিয়ে রোগ- শোক আর দারিদ্রের কবলে পড়ে বহু আইনু মারা যায়।
অনেকেই জাপানিদের দাসে পরিণত হয়। একসময় এদের সংখ্যা দুই লাখ বলে বিবেচনা করা হলেও
এখন জাপানি ভূখণ্ডে এদের সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি নয়।
মেইজি সম্রাটের আমলে আইনুদের
জাপানের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও তাদের দখলে থাকা জমি কেড়ে নেয়া হয়, নিজস্ব ভাষার ( যার লিখিত বর্ণমালা
ছিলনা ) পরিবর্তে জাপানি ভাষা শিখতে বলা হয়। এরও পরে তাদের জাপানি নাম গ্রহণ এবং
পুরাতন ধর্মীয় রীতিনীতি বাদ দিতে বাধ্য করা হয়। এসব ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও
মানবাধিকার সংগঠনগুলির বিরোধিতা থাকলেও খুব একটা কাজে আসেনি। বস্তুত এভাবেই ধীরে
ধীরে আধুনিক শিক্ষা ও জীবনধারার সঙ্গে পরিচয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের
মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে আদিবাসী আইনুরা মূলধারার জীবনের সাথে মিশে
যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের আইনগত স্বীকৃতিও মিলেছে। তবে এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর
লোকেরা সংখ্যায় কম হলেও কতদিন তাদের পুরনো ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির চিহ্ন ধরে
রাখতে পারবে তা কেবল সময়ই বলতে পারে।
( বিভিন্ন সূত্রে সংগৃহীত তথ্য।
প্রথমে বুরাকুমিন ও পরে আইনুদের পুরনো দিনের ছবি ইন্টারনেট থেকে নেয়া। পুরনো লেখা
) ।
http://www.alokrekha.com
লেখক হাসান মীর-এর লেখাটা তথ্যবহুল ও অনবদ্য। আমাদের অজানা কতকিছু জানলাম এই লেখাটা থেকে। অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা লেখককে।
ReplyDeleteজাপানের মত সভ্য দেশেও জাতি বিভেদ রয়েছে তা আমার জানাই ছিল না ।লেখক হাসান মীরের লেখাটা তথ্যবহুল ও অনবদ্য। অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা লেখককে আলোকিত করার জন্য।
ReplyDeleteলেখক হাসান মীরের চমত্কার বিরল লেখাটি পড়লাম।
ReplyDeleteমনে হলো আমরা কত কিছু জানি না। নুতন কিছু জানলাম।
লেখককে অনেক ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা
জাপানে হরিজন ও আদিবাসী : বুরাকুমিন ও আইনু ।
ReplyDeleteহাসান মীর
চমত্কার সম্পূর্ণ নুতন বিষয় একটি দারুন লেখা।
জাপানে যে এমনটি থাকতে পারে ভাবতে পারেনি।
অনেক কিছু শিখলাম।
লিখককে অনেক অভিনন্দন
সুন্দর লেখা। আইনুদের সম্পর্কে আরোও জানতে পারলে, ভালো লাগবে।
ReplyDelete