বোবা রাজহাঁস
লেখক: দেবনারায়ণ চক্রবর্তী
ইলিশ নিবেন গো মা – ইলিশ মাছ – পদ্মার ইলিশ – ’মাছওয়ালা পাড়ায় হেঁকে বেড়াচ্ছে
অনেকক্ষণ থেকে। বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁকে গেল কয়েকবার। কার্তিকবাবু রাস্তার দিকের ঝুলবারান্দায়।
বর্ষার ভিজে বাতাসে ইলিশের আমন্ত্রণ! তৃতীয়বার লোকটা আসতেই – চাকরির প্রবাস থেকে বউ গোলাপবালার
কাছে ফেরার মতো অমোঘ আকর্ষণে মাছের ব্যাগ নিয়ে নিঃশব্দে পথে নেমে এসেছেন
কার্তিকবাবু।‘ওগো শুনছ,
দেখে যাও একটা জিনিস, একটু বারান্দায় এসো – ’ যদিও কার্তিকবাবু ডাকলেই গোলাপবালা
কিশোরী, কিন্তু বাস্তবে হাঁটুর মচমচানি ব্যথা নিয়ে আসতে সময় লাগে।হাঁপানি, হার্টের অসুখ, চর্বির বরফ সরিয়ে পিত্তথলির পাথর
নাকি বার করা যায়নি। এই সুইট সেভেনটি এইটেও মসৃণ ত্বক, কুচকুচে কালো মাথায় চুল, ভ্রু, আঁখিপল্লব। একটু যা পৃথুলা। তা
নব্বই-পঁচানব্বই কী আর এমন ওজন। এখনো হাসলে মনে হয় যেন নতুন বউ। বুক ধড়ফড় করতে
থাকে কার্তিক নস্করের।বারান্দার রেলিংয়ে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছেন গোলাপবালা।
রুপালি ইলিশে সকালের মিঠে রোদ্দুর পড়ে ছিটকে এসে জিভ ঝলসে দেয় যেন তাঁর। ইশারায়
দাম জেনে নেন,
বারোশো টাকা কেজি।বউ জিভে ঠোঁট ভিজিয়ে সম্মতি জানিয়েছেন – কার্তিকবাবু নিচে বড় ছেলে, ওপরে ছোট ছেলের জানালায় চোখ বুলিয়ে
নেন। মোটা পর্দা ঝুলছে,
তবু ছেলের বউদের চোখে পড়ে যেতে পারে! অত জোরে গিন্নিকে ডাকা
উচিত হয়নি। কিন্তু গোলাপবালার অনুমতি ছাড়া কার্তিকবাবু কোনো কাজ করতে পারেন
না।ছেলের বউরা অসহায় রাক্ষুসীর মতো জুলজুল চোখে গোলাপবালার সুখের সংসারের ওপর নজর
রাখে সারাক্ষণ। নানা অছিলায় শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। বড় বউ তার পোষা
বেড়ালের নাম রেখেছে গোলাপি। দুপুরে কলমিশাক ভাজা দিয়ে ভাত খেয়ে উচ্ছিষ্ট কলপাড়ে
ঢেলে পোষা বেড়ালকে চিৎকার করে ডাকবে, গোলাপি মাছ খেয়ে যা!ছেলেগুলো যেন রথের মেলার ঘাড়-নাড়া মাটির
পুতুল। বউদের কিচ্ছুটি বলবে না।
গোলাপবালাও ছাড়বার পাত্রী নন। সেদিন কী নিয়ে যেন
বড় বউ শাশুড়ির মুখে মুখে কথা বলে যাচ্ছে। বড় ছেলে ব্রত তখন বাড়িতেই।ব্রতর মার সব
রাগ গিয়ে পড়ে ছেলের ওপর। বলেন, ব্রত তর রক্ত খামু একদিন দেখিস! বউরে, তুই কিচ্ছুটি বলিস না। আমারে সকল
সুমায় অপমান করে!কার্তিকবাবু ছুটে গিয়ে উত্তেজিত গোলাপবালাকে অনেক বুঝিয়ে ঘরে নিয়ে
আসেন। উত্তেজনার বশে পড়ে গেলে আর দেখতে হতো না। নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক!আজ সকালে
ব্রত যখন বেরোচ্ছিল,
কার্তিকবাবু তখন ছাদে পায়চারি করছিলেন। পরিষ্কার কানে এলো, বড় বউ ব্রতকে বলছে, টাকা তো কিছু দিয়ে গেলে না। রান্না
কী করব?ব্রত বলে,
চাল তো আছে। কাল রাতে যে পুঁইশাক আনলাম, ওই দিয়ে আজকের দিনটা চালিয়ে
নিও।ছমাস ব্রতর কারখানা বন্ধ। পাড়ার ক্লাবে আটশো টাকায় রাতপাহারা দেয়। ভোরে ফেরে, একটু গড়িয়ে নিয়ে চা প্যাকেটবোঝাই
দুটো ব্যাগ সাইকেলে চাপিয়ে দুপুর পর্যন্ত দোকানে দোকানে ফেরি করে –আজ সাইকেল নিয়ে বেরোয়নি। কারখানা
নাকি খুলছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হচ্ছে এখন। কবে থেকে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে পারবে
খবর নিতে আজ কারখানায় গেল ব্রত।পুঁইশাক। কানে যেতেই – ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাক, ইলিশের নানা পদ ছাড়াও ভাজা আর ইলিশ
মাছের তেল দিয়ে একটা সবুজ কাঁচালংকা কামড়ে গরম ভাত, আহ্! জিভে জল এসে গিয়েছে
কার্তিকবাবুর। সেই তখন থেকে একটা জ্যান্ত ইলিশ মাছ কার্তিক নস্করের পেটের মধ্যে
যেন খলবল করছে। ব্রতর মা গোলাপবালার গর্ভ হলে যেমন। সিঁড়ির মুখে ওপরে ছোট ছেলের বউ।
হাতে তোয়ালে-সাবান। নিচে স্নান করতে নামছে। নিচের বাথরুম ভাড়াটে আর দুই ছেলের
সংসারের জন্য। ওপরে কার্তিক-দম্পতির বাথরুমে অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই।ছেলেবউদের
সঙ্গে কথা নেই কার্তিকবাবুদের। সে-কথা যত না বলে ততই ভালো। নিজেরা সুখে-শান্তিতে
থাকো তাহলেই হবে।বড়বউ কাপড়ের ব্যবসা করে। বিশ-পঞ্চাশখানা কাপড় আড়তদারদের কাছ থেকে কিনে
আনে। বাড়ি এসে পছন্দ করে কাপড় নিয়ে যায় পাড়ার লোক। কিস্তিতে টাকা শোধ করে। মেয়ের
ক্লাস টেন, ছেলের ফাইভ।ছোট ছেলের কারখানাও এখন টালমাটাল অবস্থায়। বন্ধ হয়ে যাবে। মাসে
পনেরো দিন কাজ পায়। ছোট বউ কোনো বীমা কোম্পানির এজেন্সি নিয়েছে। ওর মেয়ের সিক্স, ছেলের ওয়ান।ছেলেরা নিজেদের সংসার
চালিয়ে নেয়। মাঝেমধ্যে যৎসামান্য সাহায্য করলেই চলে। বিদ্যুতের বিল, খাজনা-ট্যাক্স, সুইপার এমনকি ব্রত যে রাতপাহারার
জন্য পাড়ার ক্লাব থেকে আটশো টাকা পায় সেখানেও কার্তিকবাবুর চাঁদা আছে। কেননা
বাড়িটা তাঁর। দুছেলের জন্যই ওপর-নিচে একখানা করে ঘর আর বারান্দায় রান্নার জায়গা
বরাদ্দ। নিচে রান্নাঘরসহ একখানা বড় ঘর ভাড়াটে না থাকলে তালা দেওয়া পড়ে থাকে।‘অত চিল্লাও ক্যান, মরণ নাই তুমার!’সোফার গদিতে শরীর ডুবিয়ে বসে আছেন
গোলাপবালা। কার্তিকবাবুকে দেখেই হুংকার। হাতের কাছে চিরুনি পেয়ে সেটাই ছুড়ে মারেন
সোয়ামির দিকে।ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান ব্রতর বাবা। বুঝতে পারেন না কী অন্যায় করেছেন।
গোলাপবালার ক্ষরদৃষ্টির বাইরে যেতে পারেন না। আবেগভরা মোলায়েম গলায় বলেন, ‘কী আবার হইল। অত রাগ করো ক্যান? তুমারে না জিগাইয়া -’রান্নাঘর থেকে রাঁধুনি ছুটে আসে।
মাছ দেখে সেও খুব খুশি। বলে, ‘কত বড় ইলিশ ঠাকমা! কিন্তু বাবা কী ঠান্ডা! যেন মর্গের লাশ।’ ‘আস্তে কথা তুই বলতেই পারিস না, না? আর ঠাকমা আবার কী ডাক? মাসিমা বলতে পারিস। বউদি বললেই-বা
দোষের কী আছে!’
দাঁত খিঁচিয়ে ওঠেন কার্তিকবাবু।রাঁধুনি মুখে আঁচল চেপে
হাসে।‘বুলটি, এখানে মেঝেয় খবরের কাগজ বিছিয়ে কাট। পরে মুছে দিবি। ইলিশ মাছ কাটা দেখতে আমার
খুব ভালো লাগে।’খিক্খিক্ করে হাসেন গোলাপবালা। হাসতে হাসতে কাশি এসে যায়। ‘আহা অমন অস্থির হও ক্যান। শরীর
খারাপ লাগতাছে?’কার্তিকবাবু বউয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দেন, মৃদু মুষ্ঠাঘাত করেন
পিঠে।গোলাপবালার হাঁটুতে,
কোমরে, ঘাড়ে সর্বত্রই ব্যথা। সোহাগের। তবু দেখ না দেখ, যে না সে-ই কুদৃষ্টি দেয়। সেদিনই
যেমন, বিকেলে স্নান করে,
পাটভাঙা হলুদ শাড়ি পরে, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ – তখনই এসেছে বড়দার বড় মেয়ে। গল্প
করতে করতে আচমকা জিজ্ঞেস করে, ‘কাকিমা আপনার বয়েস কত হইল?’ফোঁস করে ওঠেন কার্তিকবাবু, ‘মাইয়ালোকের বয়েস জিগাইতে নাই সোনা!
এমনিতেই শরীর ভালো না তুমার কাকিমার।’ভাইঝি চলে গেলেই গোলাপবালার হাত টেনে নিয়ে মণিখচিত
অঙ্গুরীশোভিত কনিষ্ঠায় মৃদু কামড় দিয়ে দেন কার্তিকবাবু। নজর লেগে থাকলে কেটে
যাবে।গরম তেলে ইলিশ পড়তে সারাবাড়িতে সুঘ্রাণ – বারান্দায় বড় খাঁচায় কোকিল-দম্পতিও
চিৎকার করছে। কার্তিকবাবুর এক কলিগ বলেছিলেন, ‘কোকিল পুষলে সারাবছর বাড়িতে
বসন্তকাল বিরাজ করে।’কোকিলের খাঁচায় নাক ঠেকিয়ে আদরের সুরে কার্তিকবাবু বলেন, ‘আরে পাখি ছটফট করো ক্যান! জানি তো
ইলিশের ঝোল দিয়া মাখা ভাত খাইতে তুমরা ভালোবাস -’তখনই নিচতলা থেকে ব্রতর ছেলের
কান্না ভেসে আসে। ইস্কুলে যাবে, পুঁইশাক চচ্চড়ি দিয়ে ভাত মেখে তাড়াতাড়ি খেতে গিয়ে শাকের
মধ্যে লুকিয়ে থাকা কাঁচালংকা কামড়ে ফেলে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছে। ব্রতর বউ আবার
ছেলের পিঠে দুঘা বসিয়ে দেয়।মুখগহ্বরে ঝাললংকা-মেশা বিষ অন্ন, দুচোখে জলের ধারা। ব্রতর বউ যেন
বিশ্বরূপ দেখতে পায় ছেলের মুখগহ্বরে। ভয়ে চমকে উঠে তাড়াতাড়ি জলের গ্লাস ধরে ছেলের
মুখে। বলে, ‘খা, জল খা। দেখে খেতে পারিস না! অতবড় ছেলে ক্লাস ফাইভে পড়িস!’ইলিশের গন্ধ পেয়ে ওপরে ছুটে এসেছে
কার্তিকবাবুর মেয়ে। বলে,
‘আজ একাদশী আর আজই ইলিশ মাছ কিনলা!’‘একদিন একাদশী না করলে কিছু হয় না।’ খিঁচিয়ে ওঠেন গোলাপবালা। মেয়ের
বিয়ে হয়েছিল। এক মাস পর জামাই বলে, ‘আপনার মেয়ে পাগল, লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছেন!’গোলাপ-দম্পতি জামাইয়ের মুখের ওপর
বলতে পারেননি,
সব মেয়েরই বিয়ের আগে একটু-আধটু মাথার দোষ থাকে। বিয়েটা হলে, সন্তান হলেই ঠিক হয়ে যায়। কপালও
মেয়েটার খারাপ। এক মাস তো সংসার করেছে, সন্তান এসে যেতেই পারত। জামাইয়ের ব্যবসাপত্র ভালোই। বাবা-মা, ভাইবোনদের নিয়ে একান্নবর্তী সংসার।
ওরা অনেক চেষ্টাও করেছিলেন মেয়েজামাইকে ও বাড়ির ঘেরাটোপ থেকে বার করে আনতে।
প্রয়োজনে টাকা খরচ করতেও রাজি ছিলেন। কিন্তু জামাই বেঁকে বসল। দানসামগ্রীসহ
মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেল একদিন। আর কী মেজাজ হারামজাদার। কার্তিক নস্করের মতো
রাশভারী মানুষ,
মোটা অংকের পেনশনভোগী রাজকর্মচারী। তাঁর মুখের ওপর টক্টক্
করে কথা বলে জামাই! আইনি ছাড়াছাড়িটাও করিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। আবার বিয়ে করেছিল সে; কিন্তু ভালোটা কী হলো তোর। ঘটনার
দুবছরের মাথায় ক্যান্সার ধরা পড়ল।সত্যিই মেয়েটা বোধহয় পাগল। এখনো স্বামীর স্মৃতি
আঁকড়ে আছে। যতদিন মানুষটা বেঁচে ছিল শাঁখা-সিঁদুর পরেছে। মৃত্যুর খবর পেয়ে খুব
কাঁদল কদিন। তারপর থেকে বিধবার মতো একাদশী, অম্বুবাচী – আরে সে তোর কদিনের স্বামী ছিল? দুদিনের পরিচয়! মেয়েকে সেসব কথা
বোঝাবে কে। শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরত আসা আসবাবে সাজানো একটা ছোট ঘরে থাকে সে নিচে
সিঁড়ির পাশে একটেরে। মেয়ের যত রাগ-অভিমান সব বাবা-মার ওপর।তিনটে ব্যাংকের কাজ সেরে
ফিরতে বেলা একটা বাজল কার্তিকবাবুর। ব্যাংক থেকে ফেরার সময় কানে গিয়েছিল, ব্রতর বউ অস্থিরভাবে হইচই করছে।
ব্রতর প্রেসক্রিপশনের ফাইলটা কোথায় রেখেছে খুঁজে পাচ্ছে না – মেয়ে দেখেছে কি না। সে কেন কাজের
জিনিস গুছিয়ে রাখেনি!কারখানা থেকে ফেরার পথে ব্রত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। খেয়াঘাটে
বসিয়ে রেখে পথের মানুষ ফোন করেছিল। ব্রতর সঙ্গেও ওর বউয়ের কথা হয়েছে। ব্রতর কথা
অস্পষ্ট জড়ানো,
যেন দূরে কোথাও ছুটতে ছুটতে চলে যেতে যেতে কিছু বলে গেল।
পথের মানুষ বলেছে,
এখনই ভর্তি করতে হবে। অবস্থা ভালো না। খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে!
এসব কথা মেয়েকে বলছিল বড় বউ।গোলাপবালা ব্যাংকের পাশবইগুলো দেখছিলেন। মুখে তৃপ্তির
হাসি। দেখে খুব ভালো লাগছিল কার্তিকবাবুর। ছেলের অসুস্থ হয়ে পড়ার কথাটা বলতে ভুলেই
গেলেন।সত্যিই টাকা গচ্ছিত রাখলে টাকার গাছ ফল ফুল হয়!প্রতিবেশীরা মাঝেমধ্যে বোঝায়, সব ছেলেদের নামে লিখে দিয়ে ঝামেলা
মিটিয়ে দিন। কার্তিকবাবু শুধু হাসেন। বলেন, ‘খানপাঁচ-ছয় ক্যাশ সার্টিফিকেট আর
এই পেনশনের কয়টা টাকা ছাড়া আমার আর কিছুই নাই। অবশ্য চাকরির শেষ বেতন যা পাইতাম, এখন সাতাশ-আটাশ বছর পর পেনশনেই পাই তার তিনগুণ। ছেলেদেরও কিছু কিছু সাহায্য
করতে হয়। ওদের নামে সব টাকা নমিনি করা আছে। আমরা দুজন না মরলে তো আর ছেলেরা কিছু
পাবে না।’তবে তিনি খুব হিসেবি। মনে পড়ে, সে অনেকদিনের কথা –অসুস্থ মেজদাকে দেখতে গিয়েছেন ফল
নিয়ে। দেখে মনে হলো মেজদার বাঁচার আশা নেই। অফিসের ছুটি শেষ। উইদাউট পে চলছে।
সংসারে খুব অভাব। মেজবউদির হাতে পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে এসেছেন।মেজদা সুস্থ হলে, খবর পেয়ে দেখতে এলেন, সঙ্গে লিস্ট। কোন কোন তারিখে
মেজদাকে দেখতে এসে নগদ টাকা মেজবউদির হাতে কত দিয়েছেন সব মিলিয়ে। সে-টাকা তখনই
শুধতে হবে!কার্তিকবাবু বললেন, ‘ফলের দামটা না হয় ছেড়েই দিলাম।’শেষে মেজবউদি তাঁর কানের দুল
বিক্রি করে তখনই দেওরের ঋণ শোধ করে দিয়েছেন। চল্লিশ বছরে সেই টাকা এখন নিশ্চয়ই
অনেক হয়েছে। এভাবে হিসাব করে চলেছেন বলেই না এখন কার্তিকবাবু চোখ বুজলেই দেখতে পান
তাঁর চারদিকে টাকার গাছ!দুপুরে রোজ ভাতঘুমে চোখজুড়ে আসে কার্তিকবাবুর। আজ খুব শীত
লাগছে! এসি মেশিন কমিয়ে দিতে গিয়ে ধমক খেলেন গোলাপবালার কাছে। এত ঠান্ডা যেন হিমঘর!দূরাগত
কান্নার ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছে কোথা থেকে? কোকিলদুটোও খুব ছটফট করছে খাঁচার মধ্যে। বড় বউয়ের পোষা
বেড়ালটা মাঝেমধ্যে হামলা করে কোকিলের খাঁচার ওপর। পাখিদুটো খাওয়ার মিথ্যে আশায়। কত
মোটা তারের খাঁচা। অবুঝ বেড়াল তা বুঝবে কেন?বউকে না জানিয়ে সন্তর্পণে বাইরে
এলেন কার্তিকবাবু। ঘরের দরজা টেনে বন্ধ করে দিলেন।নিচে ব্রতর ছেলেমেয়েরা কাঁদছে।
ওদের পিসি বোঝাচ্ছে,
‘নবেন্দুকাকু তোর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এখনই ফিরে আসবে দেখিস।
কাঁদিস না অমন করে!’কার্তিকবাবু ইশারায় মেয়েকে ডাকেন, ‘ওর বড়দা কেমন আছে কোন খবর পাইছিস?’ মেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘বড় বউদি ছন্দা মাসিরে ফোন করছিল।
বড়দার অবস্থা ভালো না। আইসিইউতে রাখছে। তাও ভাগ্য ভালো রাস্তায় নবেন্দুদার লগে
দেখা হইছে।’নবেন্দু ব্রতর বন্ধু। ছেলেটা খুব গায়েপড়া। ঠেস দিয়ে দিয়ে কথা বলে আর অকারণে
হাসে। কোকিলের খাঁচার সামনে কুহু-কুহু করে ডাকে। কার্তিকবাবুকে ভেঙায় বোধহয়। কী
রান্নাবান্না হচ্ছে। শরীর কেমন আছে। সব খবর তার জানা চাই। সাংবাদিকদের মতো
কার্তিকবাবুর পেছনে লেগে থাকে। খুব রাগ হয়। একদিন সহ্য করতে না পেরে কড়া করে দুকথা
শুনিয়ে দিয়েছিলেন,
‘শোনো নবেন্দু, আমরা হচ্ছি রাজকর্মচারী। তুমাগো লগে আমাদের ওঠাবসা চলে না!’মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে নিচে
নেমে গিয়েছে নবেন্দু।নিচে গিয়ে সে কি হাসি! ওপর থেকে কার্তিকবাবুর কানে যায়, ব্রতর ছেলে বিহান জিজ্ঞেস করছে, ‘হাসছো কেন কাকু?’‘রাক্ষসের মুখের সামনে আয়না ধরলেই
রাক্ষস রেগে যায়!’
বলে আবার হো-হো হাসি।রাক্ষসের মুখের সামনে আয়না ধরলে মানে
কী? বোধগম্য হয়নি কার্তিক নস্করের। সন্ধেবেলা ব্রতর মৃতদেহ বাড়ি ফিরল।বড় বউ, ছোট বউ, ছেলেমেয়েদের আর্তকান্নায় ভারি হয়ে
উঠেছে বাড়ির বাতাস। শুধু কার্তিকবাবু আর গোলাপবালার চোখে জল নেই।যতবার কান্না ঠেলে
উঠছে বুক নিংড়ে ততবারই ইলিশ মাছের ঢেকুর এসে কান্নার পথ আগলায়।প্রতিবেশীরা অনেকে
এসে ভিড় করেছে,
সবারই চোখে জল। বলাবলি করছে, ছেলেটা খুবই কষ্ট পেয়ে মরল!সবার
সামনে একটু কাঁদা জরুরি বলে মনে হলো গোলাপ-দম্পতির। দুজনই আলাদা আলাদা এবং একা হয়ে
চোখে জল আর গলায় কান্না আনার মহড়া দিয়ে দুজনই একসঙ্গে ছুটতে ছুটতে ওপর দিকে নেমে এসে
ব্রতর মৃতদেহে হাত বুলিয়ে একটু কাঁদবে – বড় বউ ক্রুদ্ধ বাঘিনির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের সরিয়ে দেয়।
অসহায় আক্রোশে চিৎকার করে বলে, ‘না,
না। আপনারা আমার স্বামীর গায়ে হাত দেবেন না।’ কার্তিকবাবু এখন ক্ষমতায় থাকলে, সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ
দিতেন, লাঠিপেটা করে এই বিদ্রোহ দমন করতে! তখন অনেক রাত। ঘর অন্ধকার। গোলাপ-দম্পতির
ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ঘুম আসছিল না
ওদের। কার্তিকবাবু মাঝেমধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা ছাদে পায়চারি করছেন। চারদিকে
থইথই জোছনায় তখনো ব্রত যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে রাতপাহারায়। যদি হঠাৎ ফু-র-র করে ব্রতর
বাঁশি বেজে ওঠে,
সেই ভয়ে কার্তিকবাবু বেশিক্ষণ বাইরে ছাদে বেড়াতেও পারছেন
না। ঘরে এসে বউয়ের পাশে শুয়ে পড়ছেন।হঠাৎ ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন গোলাপ-দম্পতি, ‘কে রে’!দরজায় শুভ্র বসন পরা ব্রতর ছেলে
সাড়া দেয়, ‘দাদু আমি বিহান।’‘এত রাতে কী ব্যাপার?’
ধমকে ওঠেন কার্তিকবাবু।‘নবেন্দুকাকু চলে যাওয়ার সময় বলে
গিয়েছিল, তোর ঠাকুরদার সঙ্গে একবার দেখা করে আসিস। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই একটু দেরি হয়ে
গেল।’শিশু দেখে কোকিলরা ডানা ঝাপটায়। জোছনার আলগা আভায় বোঝা যাবে কেন, বিহানের গালে চোখের জলের দাগ। শুধু
শিশুর হাসিকে সেলাম করে জোছনা। খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে কুহু-কুহু করে
ডেকে ওঠে বিহান। কার্তিক-দম্পতি দুহাতে কান চেপে ধরেন। পূর্বদিকে, পাঁচিলের ওপাশে চক্রবর্তীদের
পুকুরপাড়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে কিসের যেন ঝটপটানির শব্দ। পরক্ষণেই কার্তিকবাবু দেখেন, বিহান ছুটে গিয়ে পাঁচিলের ওপর উঠে
পড়ল। হাতে লাঠি। চিৎকার করছে, ‘ধর – ধর – ধর -’‘ওরে বিহান, তুই ওইখানে, জলে পইড়া যাবি তো! রাইতবিরেতে কত রকমের বিষাক্ত প্রাণী -’দাদুর বারণ ওর কানে গেলে তো! বিহান
লাফিয়ে পড়ল পাঁচিলের ওপারে।খানিক পরই দেখা গেল একটা রাজহাঁসকে কোলে নিয়ে এলো
বিহান। পাঁচিল টপকে হাঁসটা বাড়ির মধ্যে ফেলে দিলো। ওপরে তাকিয়ে বলে, ‘এত রাতে তুমি ছাদে কী করছ? ঘুমাওনি? তোমাকে একদিন বলেছিলাম না দাদু, একটা রাজহাঁস বোবা কালাও মনে হয়।
দলের তিনজন কখন বাড়ি চলে গিয়েছে। এটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। অন্ধকারে পথ চিনে বাড়ি
যেতে পারেনি। ঝটপটানির শব্দে ছুটে না এলে বনবিড়ালে একে খেয়ে নিত।’রাজহাঁসটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে, ওকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে চলে গেল
বিহান।হঠাৎ কী যে হলো কার্তিকবাবুর। মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল – সারাশরীর কেঁপে হড়হড় করে বমি উঠে
এলো। ইলিশ মাছের বিষবমি।কার্তিকবাবু বমির মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে গেলেন।বিহান কখন
ছুটে এসেছে ওপরে। বলছে,
‘দাদু তোমার কাছে তুলো লাল ওষুধ আছে? রাজহাঁসটার পিঠে বনবিড়ালে কামড়ে
দিয়েছে। খুব রক্ত পড়ছে!’
বিহানের কথা শুনতে পাচ্ছেন, কিন্তু কার্তিকবাবু কথাই বলতে
পারছেন না। হাঁ করে নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। খুব কষ্ট হচ্ছে ওঁর বুকের
ভেতরটায় –
http://www.alokrekha.com
দারুন ! এখানে মানুষের জীবনের সাথে রাজহাঁসের মিল গল্পকে এক অন্য মাত্রা দান করেছে। খুবই সুন্দর উচ্চমানের লেখা। আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভ কামনা
ReplyDeleteলেখাটা এত অনবদ্য।যত-ই প্রশংসা করি কম।লেখাটাত বিস্তারিত তথ্যবহুল। যা আমদের দীপ্ত প্রজ্ঞা দান করে। অনেক অনেক ধন্যবাদ!
ReplyDelete"বোবা রাজহাঁস"
ReplyDeleteদেবনারায়ণ চক্রবর্তী।
মদ্ধবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারকে কেন্দ্র করে
চমৎকার একটি লেখা। পড়ে খুব ভালো লাগলো।
লেখকে অভিনন্দন আর অনেক শুভেচ্ছা
লেখক: দেবনারায়ণ চক্রবর্তী "বোবা রাজহাঁস" গল্পে মধ্যবিত্ত জীবনের সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
ReplyDeleteঅপূর্ব ছোট গল্পটি পড়তে পড়তে কার্তিক
ReplyDeleteবাবুর বাড়িতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। খুবই
মন ছোয়া একটি চমৎকার গল্প।
লেখককে অনেক শুভেচ্ছা।
আলোকরেখাকে ধন্যবাদ এমন একজন
গুণী লেখোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য।
মধ্যবিত্ত ঘরের প্রতিদিনের প্রতিচ্ছবি অংকন করার সঙ্গে একটি বিশেষ দিন যেদিন সকালে ঝক্ঝকে রূপালী ইলিশ জীবনে বৈচিত্র্য এ্ৰনে দিয়েছে এই গল্পে " লেখককে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ত্ৰমন সুন্দর লেখা উপহার দেবার জন্যে "
ReplyDeleteকি সুন্দর একটি পারিবারিক গল্প।
ReplyDeleteচমৎকার বিষয়বস্তু আর ভাব।
অপরূপ প্রকাশ ভঙ্গি , পড়ে
ছবির মতো মনে ভেসে ওঠে.
লেখকে অনেক ধন্যবাদ।
অনেকদিন পর একটা পরিছন্ন গল্প পড়লাম।
ReplyDeleteমনটা ভোরে গেল।
অনেক অভিনন্দন
বোবা রাজহাঁস ..... লেখক: দেবনারায়ণ চক্রবর্তী।
ReplyDeleteসুন্দর লেখা, চমৎকার লেখা। দারুন।
লেখিকাকে অনেক অভিনন্দন।
সানজিদা রুমি কিছুদিন পর পর
আমাদের সুন্দর লেখক, কবি উপহার দেন।
অনেক শুভেচ্ছা