বারান্দা
লেখক:
দেবাশিস লাহা
জানালাটা
বন্ধই থাকত। গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ, ধোঁয়া, ধুলো, হাড়বজ্জাত মাতালের মাতলামি কোনোটিকেই কারণ হিসেবে দায়ী করা যাবে না। তথাকথিত ফ্ল্যাট-বাড়ির জানালাও এটি নয় যে, অন্ধের
কি-ই-বা দিন
কি-ই-বা রাত!
শুধু ছিটকিনি খোলার অপেক্ষা। হুড়মুড়িয়ে রোদ আর বাতাস। আহা
কী দিনই না ছিল! শুধু
কি জানালা! দরজা খুললেই চওড়া বারান্দা। শীতের সকালে আরামকেদারা আর খবরের কাগজ।
পিতৃপুরুষের সেই আসবাব থেকে এখন সপ্তাহান্তে একবার ধুলো মুছতে হয়; কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা
ছিল না। ইচ্ছা ছিল জীবনের শেষ দিনটা ওই বারান্দায় বসেই
কাটিয়ে দেবে।উলটো ফুটের ভুঁইফোঁড় বাড়িটাই বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিলো। বাড়ি তো নয় যেন
রাজপ্রাসাদ। অদ্ভুত একটা রং। হলুদই বলা চলে। পাবলিকের চোখ নাকি জুড়িয়ে যায়। মিত্তিরই কেবল সরষে ফুল দেখে। আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে যা হয়। টেক্কা
দেওয়ার মতলবে এমন একটা বাড়ি বানাবে জানলে হারগিস ওই জায়গাটা বিক্রি
করতেন না। তাও আবার জলের দরে। অথচ বছরপাঁচেক আগেও মিত্তিরদের বাড়িটাই চৌহদ্দির মধ্যে এক নম্বর ছিল।
বড় বড় থাম, চওড়া
দর-দালান, শাল-সেগুনের কড়িকাঠ, মেহগনির আসবাব … বনেদি বাড়ি বলতে যা বোঝায়! সবার
মুখে মুখে তখন ‘বাবুবাড়ি’র নাম।
আজ
সেই বাবুও নেই, বাবুগিরিও নেই। বাবুবাড়ির শেষ বংশধর নিঃসন্তান অনাদি মিত্তির এখন এক হাই ইশ্কুলের
শিক্ষক। তবু গর্ব তো হবেই। হাজার
হলেও সেই একই রক্ত। বাজার অথবা ইশ্কুল-গন্তব্য যা-ই হোক,
রাস্তায় পা দিয়ে একবার
দেখে নেওয়া চাই! রাশি রাশি বাড়িঘর! হয় হাভাতে, নয়
ঐতিহ্যহীন। তার মধ্যে হুঙ্কার ছাড়ছে মিত্তিরবাড়ির সিংহদরজা। আহা, কী শোভা! কিন্তু
ওই হলদে গন্ধমাদনটিই সব গুবলেট করে
দিলো। সর্বাধুনিক স্থাপত্যের ওপর বাহারি কাচ, ডিজাইন করা ঝুলবারান্দা। গ্যারাজভরা নামিদামি গাড়ি। চোখদুটো কেমন টাটিয়ে ওঠে। সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস। না, জানালাটা আর খোলা হয়নি।
আরামকেদারাটাও কীভাবে যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। রোদে পিঠ দিয়ে খবরের কাগজ পড়া, সে-ও এখন
ইতিহাস!সেই জানালার পাশেই অনাদি। দুটো পাল্লাই হাট করে খোলা। কাল সন্ধেতে তো দরজাটাও খুলে
ফেলেছিল। যদিও মাত্র মিনিটতিনেকের জন্য; কিন্তু গেল কোথায় ছোকরাটা! ওই তো ওপাশে।
ছেঁড়া লুঙ্গিতে একচিলতে রোদ। দুপুর গড়িয়ে এলো। এখনো ঘুমুচ্ছে নাকি? সকালেও তো এ-অবস্থাতেই
পড়ে ছিল। টেঁসে যায়নি তো! কাল তো বেশ ভালোই
ছিল। আর যা-ই
হোক ভিখিরি মনে হয়নি। ফুটো বাটি একটা আছে বটে; কিন্তু এখন পর্যন্ত বাজাতে শোনেননি। কোত্থেকে এসেছে কে জানে। এ-তল্লাটের তো মনে হয়
না। খবর শুনছিলেন। আচমকাই কাশির আওয়াজ। বেশ জোরদার। চমকেই উঠেছিলেন। পথচলতি মানুষ ভেবে গুরুত্ব দেননি। পুনরাবৃত্তি হওয়াতেই একটু নড়েচড়ে বসলেন। ঠিক কাশি নয়, কে যেন গলা
খাঁকারি দিচ্ছে। দু-এক মিনিট
বাদেই গান ভেসে এলো। আহা, গলাটা ভারি মিঠে তো! নিছক কৌতূহলের বশেই জানালাটা …। খোলেননি,
সামান্য একটু ফাঁক করেছিলেন। বারান্দায় একটা মানুষ! ফর্সাই বলা চলে। রোগাটে গড়ন। একগাল দাড়ি আর উশকোখুশকো চুল।
কিন্তু চোখদুটো কী উজ্জ্বল! প্রথমে
একটু বিরক্তই হয়েছিলেন। ভরসন্ধেতে এ কোনো আপদ।
পরমুহূর্তেই অন্যরকম একটি ভাবনা উঁকি মারল। ইতিহাসের শিক্ষক অনাদি মিত্তিরের মনে তখন বাবুবাড়ির অতীত। কত অসহায়-নিরন্ন
মানুষ এখানে আশ্রয় পেয়েছে। পুবদিকের দালানে তখন বিরাট এক লঙ্গরখানা। উনুন
কখনো নিভত না। জনশ্রুতি ছিল, বাবুদের বাড়িতে নাকি রাবণের চিতা জ্বলে। কিছু না কিছু রান্না
হচ্ছেই। হয় খিচুড়ি, নয়
লাবড়া। গরিব-গুবরোই হোক আর ভিখিরিই হোক,
খালি পেটে কেউ ফিরত না। শুধু কি খাওয়া? থাকার
ব্যবস্থাও ছিল। ঠাকুর-দালানের একপাশে ঢালাও বিছানা হতো। লেপ, কাঁথা, বালিশ, মশারির এলাহি আয়োজন। ধোপাদের আনাগোনা লেগেই থাকত। অসহায়-নিঃসম্বল বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাই অগ্রাধিকার পেত। পূজা-পার্বণের সময় তো কাতারে কাতারে
মানুষ। সেই মিত্তিরবাড়ির দালানে আজকাল একটা কাকও ঠিকঠাক বসে না। আর এ তো
জলজ্যান্ত একটা মানুষ!কিন্তু এখনো শুয়ে আছে কেন? শরীর খারাপ নয় তো? ডাকবেন
নাকি? ঘুম ভাঙালে যদি খেতে চায়? বাবুবাড়ির শেষ বংশধর হলেও বড় উপার্জন অথবা
মন কোনোটিই আর অনাদি মিত্তিরের
দখলে নেই। মাইনের একটি বড় অংশ বাড়ি
রক্ষণাবেক্ষণের কাজেই ব্যয় হয়ে যায়। তবে খুব অভাবের মধ্যে আছেন এমনটাও নয়। সন্তান লালন-পালনের কোনো খরচ নেই। সঞ্চয়ও মন্দ নয়। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বেশকিছু গহনাগাটি তো আছেই। সমস্যা
অন্যত্র। বাবুবাড়ির শেষ সলতে অনাদি মিত্তির আসলে বেশ কৃপণ। হাড়কিপটে বলে খানিক দুর্নামও কুড়িয়েছেন। খানদানি গোঁফে তা দিতে দিতে
মধ্যপঞ্চাশের বাবুটি কী যেন ভাবলেন।
যা হয় দেখা যাবে।
বাবুবাড়ির শেষ বংশধর একজন আশ্রিতকে নিয়ে এত ভাববেন কেন!
কী যেন নাম বলল!‘আরে এই বদনা, কী
ব্যাপার বল তো! এখনো
ঘুমোচ্ছিস! শরীরটরীর খারাপ হলো নাকি! তবে এই বারান্দা ছেড়ে
দিয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে মর। আরে এই বদনা!’‘ঘুমুচ্ছি
না কত্তা। এমনি শুয়ে আছি!’‘মানে? তিনটে বেজে গেল। উঠে পড়, হাঁটাচলা কর একটু।’আশ্রিতের প্রতি অজান্তেই যেন একটু স্নেহবর্ষণ করে ফেললেন বাবু
অনাদি মিত্তির।‘কী যে কন
কত্তা! খিদেটা বাড়ি যাবে যে। তাই তো ঘাপটি মেরে
শুয়ে আচি। যত নড়াচড়া তত
খিদে! কিন্তু আমার নাম বদনা নয় – বদন, বদন বসাক!’‘ওই হলো – যাহা
বদন, তাহাই বদনা!’ছোকরাটা বেশ মজাদার তো। ভারি সুন্দর কথা বলে। হাঁটাচলা করলে খিদে বেড়ে যায়, তাও জানে! কিন্তু বাবুবাড়ির আশ্রিত খিদের ভয়ে চলতে-ফিরতে পারবে না, আর মিত্তির সেটা
চেয়ে চেয়ে দেখবেন! এতে কি পূর্বপুরুষের সম্মান
বাড়বে? উঁহু, কিছু একটা করতে হয়। কিন্তু ছোকরাটার সত্যি খিদে পেয়েছে তো? নাকি মিথ্যে বলে বাগিয়ে নেওয়ার মতলব। একটু তদন্ত করে দেখলে মন্দ কী!‘শেষ কখন খেয়েছিলি রে?’‘আজ্ঞে পরশু রাতে কত্তা। খানতিনেক রুটি আর সবজি। হোটেলের
সামনে দাঁইড়ে ছিলুম। একটা বাচ্চা ছেলে দিয়ে গেল।’‘বাহ্, তোর ভাগ্যিটা বেশ ভালো তো! দাঁড়িয়ে পড়লেই খাবার পেয়ে যাস!’‘হক কথা কত্তা।
নইলে বাবুবাড়ির বারান্দায় ঠাঁই হবে ক্যানি। সেই কবে থিকা খুঁজতি নেগেছি। দাদুর মুখেই পেথম এ-বাড়ির নাম
শুনি। সংসারে অভাব বাড়ি গেলেই কইতেন – বাবা বদন যদি কখনো খেতি না পাস, তবে
বাবুবাড়ি চলে যাবি। সেথায় কেউ অভুক্ত থাকে না!’বদনা বলে কী! মিত্তিরের তো চোখ কপালে
ওঠার জোগাড়। এ তো দেখছি
মহাজোচ্চোর। আটঘাট বেঁধে এসেছে মনে হচ্ছে। তবু একটা কৌতূহল। যুগ যুগ ধরে এ-বাড়িতে অজস্র
মানুষের অন্ন-আশ্রয় জুটেছে। চারশো বছরের বনেদি পরিবার বলে কথা। দূরদূরান্ত থেকে কত লোকই না
আসত। বুকের ছাতিটা যেন আপনা থেকেই কয়েক ইঞ্চি …‘বলিস কী রে! হতেই
পারে। বাবুবাড়িতে কত লোকের পাত
পড়েছে। একটু খোলাসা করে বল না!’‘বলব
কত্তা, সব বলব। দাদুর
মুখে তো কম কিচু
শুনিনি। আমাদের আদি নিবাস হলো গিয়ে মুর্শিদাবাদ। সেবার নাকি ভয়ানক বান। কূলভাঙা নদীর সে কী আক্রোশ!
সবই পেরায় ভাসি গেল! একমাত্র ছেলে মানে আমার দাদুরে নিয়ে কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে কলকাতার দিকে হাঁটা দিলেন। মাঝপথেই ওলাওঠার কামড়। বমি আর পায়খানায় মরমর
অবস্থা। পথচলতি মানুষই বলল, বাবুদের বাড়ি লইয়া যাও। বাঁচালে তিনিই বাঁচাবেন। কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে বারান্দায় … এই বারান্দাটাই হয়তো
হবে … এমনই লাল পানা রং ছেল তার।’‘থামলি
কেন? বলে যা গর্দভ …’
মিত্তির রীতিমতো উত্তেজিত। বেঁকে যাওয়া গরাদ দিয়ে পুরো মাথাটাই বেরিয়ে আসার জোগাড়।‘তারপর আর কী। চাকর-বাকর সব হইহই করি
ছুটি এলো। আহা, কী সেবাযত্নই না
করল। ডাক্তার-বদ্যি কিচু বাদ রাখেনি। যমের দুয়ার থিকে ফিরিয়ে আনা বুঝি এরেই কয়। তারপর বড়বাবুও একদিন দেখা করতি এলেন …’‘বলিস কী রে? বড়বাবু
স্বয়ং? নামটা বল দেখি …’‘সে
কি আর মনে আছে
কত্তা। তবে দাদু প্রায়ই তেনার কথা বলতেন। তিনি দেবতার মতো মনিষ্যি, বদন। দর্শনেই পুণ্যি হয়। নাম একটি বলতেন বটে … স্মরণে আসছে না …’‘দ্যাখ না বদন, মনে
পড়ে কি না। মগজটাকে
একটু খেলিয়ে …’বদনা আবার বদন হয়ে উঠল। বদন বসাক। সেও আর শুয়ে নেই।
উঠে বসেছে। মাথায় আঙুল। বেশ হন্তদন্ত হয়েই চুলকে চলেছে।‘কি রে মনে
পড়ল? এই বদন!’ উত্তেজনার
পারদ চড়ছে।‘আজ্ঞে – ধরা দিয়েও পিছলে যাচ্ছে কত্তা! অ দিয়ে শুরু!
অ – অ – অ – অবনী – অবনী মিত্তির! বাবু শ্রী অবনী মিত্তির!’‘বলিস কী রে! মহামহিম
শ্রী অবনী মিত্তির! আমার প্রপিতামহ – মিত্তির বংশের পঞ্চম পুরুষ!’ অনাদি মিত্তিরের ডানহাতটি যেন আপনা থেকেই কপাল ছুঁয়ে ফেলল।‘সত্যিই দেবতার মতো মনিষ্যি। ভিটেমাটি সব ভাসি গেছে
শুনে দরাজ গলায় কইলেন – বাপ-ব্যাটা যতদিন ইচ্ছে থাকবে। এদের যেন কোনো অসুবিধা না হয়। দাদু
তো এ-বাড়িতেই মানুষ
হয়েছে … জোয়ান হওয়ার পর বড়বাবুই দাদুর
হাতত কিচু টেহা দিয়ে কইলেন – যা, মদন, এবার বেরিয়ে পড়। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আমার অবর্তমানে তোদের কী হবে বলা
যায় না। দাদু উত্তরে চলি যায়। কারবার শুরু করে। তারপর বিয়ে, পরিবার, বাবার জন্ম। সে অনেক কতা
… বড্ড খিদে কত্তা। প্যাটে কিছু পড়লি আপনারে সব শোনাতি পারি
…’ব্যাপারটা যে এদিকেই গড়াবে
অনাদি মিত্তির জানতেন। কিন্তু এ-মুহূর্তে তাঁর
উদার হতে বাধা নেই। খানিক ঘোরের মধ্যেই তিনি রান্নাঘরের দিকে হেঁটে গেলেন। গিন্নিকে বলে একবাটি ভাতের ওপর সামান্য কিছু ডাল-তরকারি ছড়িয়ে বাঁকা গরাদের ওপাশে চালান করে দিয়ে বললেন – ‘এই নে।’ দুইকী আশ্চর্য! পাখির ডাক মনে হচ্ছে। সকালের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে মিত্তির আর একটা হাই
তুললেন। এ-বাড়িতে তো
এমন কিচিরমিচির শোনা যায় না। পূর্ব আর উত্তর দালানের
খবর অবশ্য তিনি জানেন না। সেসব কবেই ভেঙে পড়েছে। পাখির তুলনায় সেখানে সাপখোপই বেশি। জানালাটা খুলতে না খুলতেই চক্ষু
চড়কগাছ। চারদিকে শুধু পাখি আর পাখি। শালিক,
চড়–ই, ফিঙে, বাবুই
কী নেই! সঙ্গে কিছু কাকও জুটেছে। বদন কোথায় গেল? আরে ওই তো। বুকে-পিঠে, মাথায় গাদাগুচ্ছের পাখি! ছেঁড়া বগলেও ফিঙের ঠোঁট! ছোকরাটা কি জাদু জানে!‘আরে এই বদন? সাতসকালে
এত পাখি জোটালি কোত্থেকে?’‘শুধু কি পাখি কত্তা!
কুকুরও এয়েচিল। ওই দেখুন ওদিকে
এখনো গোটা তিন-চার। আমি পশুপাখি খুব ভালোবাসি কত্তা। নিজে খেতি পাই বা না পাই,
ওদের জন্যি পকেটে কিচু না কিচু রাখি।
কখনো ছোলাভাজা, কখনো মুড়ি। পক্ষিগুলান কী সোন্দর তাই
না!’সে আর বলতে!
এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য এই প্রথম দেখছেন।
পূর্বপুরুষদের পায়রা ওড়ানোর শখ ছিল শুনেছেন,
কিন্তু অনাদি মিত্তিরের গেরস্থালিতে পায়রা তো দূরের কথা,
ক্বচিৎ-কদাচিৎ দু-একটা কাক
ছাড়া কিছু চোখে পড়েনি। তবে ভবিষ্যতে যে ঘুঘু চরবে
সে-ব্যাপারে নিশ্চিত। ছোকরাটা কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। কতই-বা বয়স হবে।
কুড়ি-বাইশ। ওর দাদু নাকি
এখানেই মানুষ হয়েছে! সে না হয়
হলো। কিন্তু এতদিন পর তার আদরের
নাতি দুটো ভাতের জন্য হাজির হয়ে গেল। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে! যাক গে, ছেলেটা কিন্তু মন্দ নয়। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। কতদিনই-বা টিকবে। শীতকাল
বলেই বৃষ্টি-বাদলার উপদ্রব নেই। কম্বল সম্বল করে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়। বর্ষা এলে বাপ বাপ করে পালাবে। বারান্দার ওপর একটু ছাউনি আছে বটে, কিন্তু তার যা অবস্থা! যদি
ভেবে থাকে দাদুর মতো ওকেও জামাই-আদর করে ভেতরে ঢোকাব … আরে বাবা দিনকাল কি একরকম আছে!
সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই! তবু যতটা না করলেই নয়
…‘এই যে বাবা বদন।
শুধু পাখিকে খাওয়ালেই হবে, বলি নিজের পেটে কিছু পড়েছে? কাল রাতে কিছু খেয়েছিলি?’হেঁসেলের দিকে এগোতে গিয়েই মনে হলো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। একটা রাস্তার ছেলের জন্য এত দরদ! সরলাকে
বললেই হয়। ঘরের কাজকর্মের ফাঁকে যদি ছোকরাটাকে দুটো ভাত-রুটি দেওয়া যায়। উঁহু, তাতে আবার অন্য সমস্যা। দরিদ্র নারায়ণ সেবার নামে মণ্ডাা-মেঠাইও যদি বিলিয়ে দেয়! তিন‘বাবা বদন, তুই কোনো কাজকম্মো করিস না কেন? এই
চেহারায় অবশ্যি ভারী কাজ করতে পারবি না। হালকা কাজ তো করতে পারিস।
ভাতের অভাব হয় না।’জানালায় মিত্তিরের মুখ। মধ্যাহ্নভোজন সারতে আজ একটু দেরিই
হয়েছে। আজই প্রথম ভাতের সঙ্গে একটুকরো মাছ দেবে ভেবেছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পাত অবধি
পৌঁছোয়নি। ছোকরার লোভ যদি বেড়ে যায়।‘আমি কি জন্ম থেকেই
এমন প্যাংলা ছিলুম কত্তা! টাইফডের কবলে পড়ি এই অবস্থা। সবাই
তো ধরেই নেচিল বদন আর টিকবে নি।
সে অনেক গল্প। যাই বলেন কত্তা, আজকের লাউঘণ্টটা যা খেলুম না।
জিহ্বায় এখনো সোয়াদ নেগে আছে। বনেদি বাড়ির রান্না এরেই কয়। দাদু কইতেন বাবুবাড়ির কচি পাঁঠার কোপ্তা আর পাকা রুইয়ের
কালিয়ার জগৎজোড়া সুখ্যাতি। সে হোক গে।
আমার তাতে নোলা নেই। নিরামিষ ছাড়া অন্য কিচু যে রোচে না।’মিত্তির
যে যারপরনাই আনন্দিত হলেন, সহজেই অনুমেয়। যাক বাবা, আর লুকোছাপা করতে
হবে না।‘তাই নাকি? এই বয়সে নিরামিষ?
সাধু-সন্ন্যাসী হওয়ার মতলব নেই তো?’‘কী যে বলেন
কত্তা! আমি ক্ষুদ্র মনিষ্যি! তেনাদের সঙ্গে কি আমার তুলনা?
আমি যে পশুপাখিদের খুব
ভালোবাসি কত্তা। যাদের ভালোবাসি, তাদের খাই ক্যামনে! না, কত্তা সে আমি পারব
নি। আচ্ছা কত্তা আমায় একদিন নলেন গুড়ের পায়েস খেতি দিবেন? কতদিন খাইনি।’‘নলেন গুড়ের পায়েস? বলিস কী রে? শখ
তো মন্দ নয়! কুকুরের পেটে ঘি কি সহ্য
হবে! দুটো ডাল-ভাত খেতে পাচ্ছিস, চোদ্দো পুরুষের ভাগ্যি! অকম্মার ঢেঁকি! শুধু খাওয়া আর ঘুম!’একটু
খারাপই লাগল। এমন কড়া করে না বললেও পারতেন।
কিন্তু কিছু করার নেই। একটা আধপাগলা ছোকরা, ভিখিরিই বলা চলে – তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করবে কী করে! হাজার
হলেও বনেদি রক্ত!বন্ধ জানালাটা সেদিন আর খোলা হয়নি।
বদন বসাক নামক হাভাতে, দ্বিপদটির রাতে কিছু জুটল কি না সে-খোঁজটি কেই-বা নেবে। চারঘুম
ভাঙতে বেশ দেরিই হয়ে গেল। কাল রাতে বদন গানও শোনায়নি। প্রতিদিন রাতে নিজের মনেই গেয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মিত্তিরও হাঁক পাড়েন … ‘এই বদন ওই
গানটা আর একবার গা
না। ভারি মিঠে লাগে তোর গলায়।’‘কোনটা কত্তা?’‘আরে ওই যে – খাঁচার
ভিতর অচিন পাখি …’কাল যে কী হলো!
নির্ঘাত কষ্ট পেয়েছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মিত্তিরও এপাশ-ওপাশ করেছে। কতদূর থেকে এসেছে ছেলেটা। ভিখিরি নয়, আধপাগল-ভবঘুরে। বাবুবাড়ির পঞ্চম পুরুষের নাম জানে; কিন্তু গেল কোথায় ছোকরাটা? সাড়াশব্দ নেই। চোখ মুছতে মুছতে দক্ষিণের জানালাটা খুলেই ফেললেন। যা ভেবেছেন ঠিক
তাই। খাঁ-খাঁ বারান্দা। না আছে বদন,
না আছে পাখি! চলে গেল নাকি! কুকুরের পেটে ঘিয়ের অনুষঙ্গটা না টানলেই হতো।
মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। রাতের বেলায় বাউল গান, দিনের বেলায় গল্প। যদিও সব জানালা দিয়ে।
তাতেও অবসরটা বেশ ভালোই কাটত। সপ্তাহখানেক ছুটি নিয়েছেন। শরীরটা ঠিক ভালো যাচ্ছিল না। সামনের সপ্তাহ থেকে আবার নাকে-মুখে দিয়ে দৌড়াতে হবে। সরলাকে জিজ্ঞাসা করবে নাকি? গিন্নির ঘুম ভেঙেছে কি না কে
জানে। মরুক গে! কোথাকার কোন ভবঘুরে! তাকে নিয়ে এত ভাবনার কী
আছে। একি! পুব দালানের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলেন। সব কেমন যেন
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ডাঁই করে রাখা অকেজো আসবাব, ভাঙা ইটের স্তূপ সব উধাও। ব্যাপারটা
কী! বেশ হন্তদন্ত হয়েই পা চালিয়ে দিলেন।
ঠাকুর দালান পেরিয়ে বাঁদিকে ঘুরতেই ঝোপঝাড়ের অন্ধকার। সেখানেই একটা মানুষ। দূর থেকে ছায়ার মতো লাগছে। মুখ না দেখেও বুঝে
নেওয়া যায় রোগা-প্যাংলা মানুষটার নাম বদন। হাতে কাটারি। ব্যাপারটা এতক্ষণে পরিষ্কার হলো। বাহ্, ছেলেটা খুব কাজের তো। একলা হাতে এত আগাছা, ঝোপঝাড়
… কিন্তু ভেতরে ঢুকল কী করে? সাহস
তো মন্দ নয়! বারান্দা থেকে অন্দরমহলে ঢুকে পড়বে না তো!‘আরে
বদনা তুই এখানে! এই সরলা … তোরা
কি চোখে ঠুলি পরে থাকিস? এই ছোকরাটা কী
করে ভেতরে ঢুকল? ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়েছে কী …’‘ওকে বকবেন না দাদা! আমিই
দরজা খুলে দিয়েছি। চারদিক যা নোংরা হয়েছিল।
সাপখোপের কামড়ে মরব নাকি। পরিষ্কার করার লোকই পাওয়া যায় না। সেদিন তো আপনিও একজনকে
বললেন। এমন মজুরি চাইল … সকালে ও যখন নিজে
থেকে বলল … আমি আর না করিনি
…’‘রাগ করবেন নি কত্তা। সরলা
মাসির কোনো দোষ নাই। আমিই তো জোরাজুরি করলুম।
প্রথম দিনই দেখেছি পুব আর উত্তর দালানগুলান
কেমন জঙ্গল হইয়ি গেচে। দাদু যেমনটি কইয়েছিল তার সঙ্গে কোনো মিলই নাই। কিন্তু সাহস হচ্ছিল না। ভেতরে না ঢুকতি পারলি
জঙ্গল পরিষ্কার করব ক্যামনে। দুদিনেই বুঝলুম আপনি আমায় কত্ত ভালোবাসেন। খেতি দেন, আলাপ করেন। তাই আজ সাহস করে
… ওদিকপানে একটু চেয়ে দেখেন … সব কেমন পরিষ্কার
… আর দু-তিন ঘণ্টার
মধ্যেই বাকিটা – ’‘বেশ! কাজ করার যখন এত সাধ জেগেছে,
কর – কিন্তু শেষ হয়ে গেলেই আবার ওই বারান্দায় গিয়ে
বসবি।’‘সে
আর বলতি কত্তা। কাজ হয়ে গেলেই তো নাইতি যাব।
আপনাদেরই পুকুর। সেথায় কি কম জঙ্গল!
তবে সুবিধেই হয়েচে। আড়ালের কাজকম্মোও সারি নেওয়া যায়।’‘কোন পুকুর রে!’‘বড় রাস্তা ধরি
হাঁটলি ডানদিকে যেটি পড়ে …’‘এজমালি সম্পত্তি! তাই এমন দশা!’গলাটা কেমন কেঁপে উঠল। দীর্ঘশ্বাসগুলো আজকাল অনুমতির অপেক্ষা করে না।পাঁচ‘বাহ্, তুই তো খুব কাজের
ছেলে! বাড়িটার ভোলই বদলে দিলি! ঘুরে বেড়াস কেন? কিছু একটা করলেই পারিস!’‘কাজ কি করিনি কত্তা!
কিন্তু মন টেকে না।
তাছাড়া মারও তো কম খাইনি।’‘কাজ
করতে গিয়ে মার? বলিস কী রে?’‘হ্যাঁ,
কত্তা। অনেকবার। এই তো গেল
বছর এক বড় ব্যবসাদারের
বাড়িতে কাজে নাগলুম। দোকানও সামলাতি হতো। একটু-আধটু লেখাপড়া জানি বলে মাঝেমধ্যে খাতাও লিখতুম। আচমকা একদিন পুলিশ এলো। খাতাপত্তর সব দেখতি চাইল।
জিগালো আরো কিচু আচে কি না। আমি
বললাম হ্যাঁ আরো আচে। তবে দোকানে নয়, বাড়িতে। সেথাও পুলিশ গেল। চলেও গেল ঘণ্টাখানেক পর। তারপরই মালিকটা কেমন চ-াল হয়ে
গেল। কী মার মারল
কত্তা। এমন মার জীবনেও খাইনি।’‘বলিস কী রে। এই
কাণ্ড! তোর মাথায় তো ছিট আছে!
চিকিৎসে দরকার।’‘হ্যাঁ, কত্তা। নোকে তাই বলে। নইলে আমার কিছু হলো নি ক্যানে। কোনো
কাজই করতি পারি না। তার আগের বছর একটা পোলট্রি
ফেরাম। মাসখানেক ভালোই চলল। খাঁচা পরিষ্কার করা, খেতি দেওয়া, গুনতি করা। একদিন কী মনে হলো
খাঁচাগুলান সব খুলে দিলুম।
ব্যস, সব মুরগি রাস্তায়।
মালিক তো হাঁসুয়া নিয়ে
তাড়া করল। আমার নাগাল অবশ্যি পায়নি।বদন কথা বলে উঠলে শুধু শুনলে চলে না, মাঝেমধ্যে নিজেকে চিমটিও কাটতে হয়। দেখে নিতে হয়, প্রাণপাখিটা ঠিকঠাক উড়ছে কি না। বাস্তব
আর রূপকথা সব কেমন তালগোল
পাকিয়ে যায়। হাসিও পায়, আবার গাও ছমছম করে। পরশু থেকে ইশ্কুল। কালই যদি ওকে নলেন গুড়ের পায়েস খাওয়ানো যায়, কেমন হয়? ছয়ছোকরা মনে হয় কেটেই পড়েছে।
কেউ কিছু বলতে পারছে না। কেউ বলতে অবশ্য কাজের মেয়ে সরলা আর ঘুমকাতুরে গিন্নি।
বেলা পড়ে এলো। শীতের দিন এমনিতেই ছোট হয়। নয় নয় করেও
বারকুড়ি জানালা খুলেছে। বদন বসাকের টিকিটিও দেখা যায়নি। ওই তো বিছানাটা।
পরিপাটি করেই গোটানো। ছেঁড়াখোঁড়া ব্যাগটাও আছে। নির্ঘাত ঘুরতে বেরিয়েছে। তবে কিছু বলা যায় না। কোনো কিছুর প্রতি মায়া আছে বলে তো মনে হয়
না। একটু খোঁজখবর করবেন নাকি? সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েছে কি না কে
জানে। পাখিগুলো আজো এসেছিল। এদিক-ওদিক উড়েই সবাই ফুড়–ত। জামরুল
গাছটাতে এখনো দুটো চড়–ই। ওরাও হয়তো
অপেক্ষা করছে।খবরের কাগজটাও পড়া হয়নি। গা-টা কেমন
ম্যাজম্যাজ করছে। সরলাকে এককাপ চা করতে বলবেন
নাকি? কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। কেমন যেন একটা ঝিমুনি। অবেলায় ঘুমোতেও ইচ্ছে করে না। ছেলেটা সব ওলটপালট করে
দিয়েছে। অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছেন।
কাল রাতেই তো বড়বাবু অবনী
মিত্তির এসে হাজির। পাটভাঙা ধুতি, হাতে ছড়ি, সোনার চশমা। স্বপ্ন বলে মনেই হতো না যদি না
মুখটা বদন বসাকের মতো হতো। ঘাম দিয়ে ঘুম ভেঙেছিল। মিত্তির বংশের ইতিহাসে এই পঞ্চম পুরুষটিই
নাকি একটু খ্যাপা প্রকৃতির ছিলেন। সবকিছুই প্রায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে
ওঠার জোগাড়। গান-বাজনার খুব শখ ছিল। নিজেও
গাইতেন। অবনী মিত্তিরের টপ্পা অনেক ওস্তাদও নাকি মন দিয়ে শুনতেন।
এক শ্রাবণের রাতে মেঘমল্লারে ডুবে থাকার সময় মেজোবাবু অনন্ত মিত্তির তাঁর বুকে ছুরি বসিয়ে দেন। কিন্তু তারপর তিনি নিজেই কোথায় যেন হারিয়ে যান। বাবুবাড়ির ইতিহাসে অনন্ত মিত্তিরের আর কোনো উল্লেখই
পাওয়া যায় না। সাত‘কত্তা, ও কত্তা! ঘুমোলেন
নাকি!’চোখদুটো কখন লেগে এসেছিল বুঝতে পারেননি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বেশ তাড়াহুড়ো করেই আলোটা জ্বাললেন।জানালা খুলতেই বদনের মুখ।‘কী রে, তুই
তো কর্পূরের মতো উবে গেছিলি! সারাদিন ছিলি কোথায়। মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে
আহ্লাদে আটখানা!’‘কইতেছি কত্তা! সব কইতেছি! সকাল
হতিই পুকুরপাড়ে। মনটা আজ বেশ উদাস
ছিল। জলের পানে বেশ কয়েকটা খোলামকুচি ছুড়ে মারলুম; কিন্তু সব ডুবি গেল।
একখানও ব্যাঙ হইল না। ফেরার পথে এক কা-।
দুজন নোক। মুখচেনা। জোর করি ধরি নিয়ে গেল। বাবুর
ছেলের নাকি জন্মদিন। সারাদিন ওখানেই। কত রকমের খাবার।
জীবনে এই পেথম দেখলাম।
আমি তো আবার মাছ-মাংস খাই না। প্রাণভরে ম-ামেঠাই। আপনার
জন্যও নিয়ে এয়েছি কত্তা। রসগোল্লা, পানতুয়া, কষা মাংস, পোলাও! আপনার তো আমার মতো
বাছবিচার নাই। জানালাটা একটু বড় করে খোলেন
তো। গলিয়ে দিই।’বুকটা কেমন যেন করে উঠল।‘কোন বাড়ি রে?’‘ওই তো হলুদ
রঙের বাড়িটা। আলোতে কেমন ঝলমল করতাছে।’গা-টা গুলিয়ে
উঠল।‘সাহস
তো মন্দ নয়। ওই বাড়ির খাবার
আমাকে গেলাবি! শুয়োরের বাচ্চা! এখনই যদি তুই এই বারান্দা ছেড়ে
বেরিয়ে না যাস …’‘এত
রাগি যাচ্ছেন কেন কত্তা? মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। অন্যায় হলি মাপ করি দেন। এই বারান্দা আমি
ছাড়ব নি কত্তা। এ-বাড়িতেই আমার দাদু মানুষ হয়েচে। তবে যদি হাসিমুখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কন – বদন তুই চলি যা। নেশ্চয় যাব, কত্তা।’ আটকৃষ্ণপক্ষের রাত। সুনসান রাস্তা। মাঝেমধ্যে শেয়ালের ডাক। দক্ষিণের দরজায় একটা ছায়া। চারদিকটা বেশ ভালো করে দেখে নিচ্ছে। জব্বর শীত। মানুষ তো দূরের কথা,
একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। হারামজাদাটা ঘুমের ঘোরেও কেমন গুনগুন করছে! শালা শুয়োরের বাচ্চা, নেমক হারাম! মার লাথি!এই বয়সেও পায়ে
এত জোর আছে, বুঝতেই পারেননি। মাত্র তিনবার। বারান্দা থেকে সিধে রাস্তায়। কম্বল মুড়ি দেওয়া শরীর। তেমন কোনো শব্দই হলো না। শুধু দরজা বন্ধ করার সময় অস্ফুট একটা গোঙানি ‘… কত্তা …’মিউনিসিপ্যালিটির ম্যাটাডোরটা যখন এলো, জানালাটা তখনো খোলা। একে পাগল। তার ওপর বেওয়ারিশ। রাস্তায় পড়ে থাকা এমন একটি অকুলীন মৃতদেহ স্থানীয় গণ্যমান্যদের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠলে আখেরে পুলিশেরই ক্ষতি। অতএব, লোক-দেখানো জিজ্ঞাসাবাদ পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়নি। ছবি অবশ্য একটা তোলা হয়েছিল। শীতের প্রকোপে আর পাঁচজন ফুটপাতবাসীর
যেভাবে মৃত্যু হয়, তাকেই কারণ ধরে নিয়ে বিধিবদ্ধ কর্মকা-ের পর বদন
বসাকের লাশটি পুড়তে শুরু করল। প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি অনুসারে সময় বেশ ভালোই লেগেছিল। চর্বির ঘাটতি থাকলে যা হয়। নয়কত
বছর কাটল কে জানে। কেউ
বলে পাঁচ, কেউ বলে দশ। সময়ের মতো আপেক্ষিক আর কিছু আছে?
তবে জানালাটা আর বন্ধ হয়নি।
বারান্দাটাও খালি আছে বলা যাবে না। প্রতিদিনই কারা যেন এক বৃদ্ধকে বসিয়ে
রেখে যায়। ইতিউতি ছড়ানো ছোলা এবং বাদামভাজায় চড়–ই-ফিঙের কিচিরমিচির।
আরামকেদারার পাশে পড়ে থাকা খবরের কাগজটি কেউ পড়ে বলে মনে হয় না। বৃদ্ধটি মাঝেমধ্যেই
কথা বলে ওঠেন। কার সঙ্গে কে জানে!‘কী
রে বদনা, এখনো ঘুমোচ্ছিস! এই দ্যাখ পায়েস!
ঠিক যেমনটি চেয়েছিলি। গিন্নিমা নিজের হাতে বানিয়েছে। আরে এই বদনা।
http://www.alokrekha.com
গল্পটা পড়ে খুব ভালো লাগলো। মিত্তির বাড়ির অনাদি আর বারান্দার কোণে পড়ে থাকা বদনের মাঝে কথোপথন আমাদের নিয়ে যায় সেই পুরোনো দিনে। লেখার মান খুব সুন্দর শব্দ ও ভাব যেভাবে অনুব্যক্ত হয়েছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। অনেক শুভেচ্ছা লেখক কে। অলোকরাখাকে ধন্যবাদ লেখক: দেবাশিস লাহা'র গল্পটি প্রকাশ করার জন্য।
ReplyDeleteআরও পড়তে flow করুন
Deletehttps://www.facebook.com/debasis.laha.1
গল্পটা পড়ে খুব ভালো লাগলো। মিত্তির বাড়ির সামান্য একটা বারান্দা নিয়ে যে এত সুন্দর একটা গল্প তা প্রশংসার দাবিদার। বারান্দায় পড়ে থাকা নিতান্ত এক মানুষ বদন ,সে গল্প করে আর মিত্তির বাড়ির এখনকার কর্তা অনাদির সাথে। সেই গল্পের ছলে আমাদের নিয়ে যায় সেই অনাদিকাল। যখন মিত্তির বাড়ির রমরমা অবস্থা ছিল। সেই সাথে উচ্চ ও নিচু তলার এক সেতু বন্ধন অবলোকন করতে পারি। তবে গল্পের শেষ আমার ঠিক মনপুত হওনি। গল্পের শেষটায় মানুষ তো দূরের কথা, একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। হারামজাদাটা ঘুমের ঘোরেও কেমন গুনগুন করছে! শালা শুয়োরের বাচ্চা, নেমক হারাম! মার লাথি!এই বয়সেও পায়ে এত জোর আছে, বুঝতেই পারেননি। মাত্র তিনবার। বারান্দা থেকে সিধে রাস্তায়।" সেখানে তার মৃত্যটা কেমন জানি খাপছাড়া মনে হয়েছে।
ReplyDeleteগল্পটা পড়ে খুব ভালো লাগলো। প্রতিটি শব্দ অতি সচেতনতার সাথে ব্যবহৃত হয়েছে। বিষয়বস্তু চয়ন অনবদ্য। নামকরণ গল্পের সাথে সামঞ্জ্যষপূর্ন। পুরো গল্পটাই বারান্দা কেন্দ্রিক। একসময় জমজমাট মিত্তির বাড়ির বারান্দা।সেখানে কৃশকায় চালচুলোহীন এক অনাহুত বদন কোনোকালে তার পূর্ব পুরুষেরা এই মিত্তির বাড়ির আশ্রিত ছিল। মিত্তির বাড়ির বারান্দায় এখন তার ঠাঁই। এই বারান্দাই গল্পের মূল বিষয় বস্তু। এখানেই আলাপচারিতা পরেও গল্পে। শেষে এই বারান্দা থেকেই তাকে ছিটকে ফেলা হয় মৃত্যুর মুখে। অথচ সুদীর্ঘ নয় দশ বাদেও বৃদ্ধ অনাদি মিত্তিরের চোখ খুঁজে ফেরে বদনকে। অনন্য অনুপম লেখা গল্প। লেখককে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
ReplyDeleteচমৎকার লেখা,
ReplyDeleteখুব উপভোগ করলাম।
লেখককে অনেক অভিনন্দন।
আলোকরেখাকে ধন্নবাদ
এমন গুণী লেখকের সাথে
পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য
Wonderful story. Takes my mind to my past golden days.
ReplyDeleteMany thanks to writer.
My best wishes.
অসাধারণ লেখা ও অভিব্যক্তি। উত্কৃষ্ট চমৎকার উচ্চ মার্গের প্রকাশ।অপূর্ব বিষয় বস্তু,ভাষাভাব ও শব্দচয়ন ও রচনা শৈলী মিলিয়ে অনবদ্য ও অনিন্দ্য এক গল্প আলোকরেখাকে ও লেখককে অনেক ধন্যবাদ ও শুভেছা।”
ReplyDelete