শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) কবি, সাংবাদিক।
সানজিদা রুমি
শামসুর রাহমান ঢাকার পোগোজ স্কুল
থেকে ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ পাস করে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায়
অংশগ্রহণ করেননি। তবে তিনি ১৯৫৩ সালে বি.এ (পাস কোর্স) পাস করেন। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, সাবের রেজা করিম, তরীকুল আলম, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, বদরুদ্দীন উমর, আবুল মাল আবদুল মুহিত, মোস্তফা কামাল, সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, সৈয়দ আলী কবির, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রমুখ
ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল।
আঠারো বছর বয়সে শামসুর রাহমান
প্রথম কবিতা লেখা আরম্ভ করেন। ১৯৪৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘উনিশ শ’উনপঞ্চাশ’ প্রকাশিত হয় নলিনীকিশোরগুহ
সম্পাদিত সোনার বাংলা পত্রিকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে ১৩জন তরুণ কবির
কবিতার সঙ্কলন,
নতুন কবিতা-য় তাঁর পাঁচটি কবিতাতাঁর কবি পরিচয়কে সুধী
মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নতুন কবিতা আশরাফ সিদ্দিকী ও আব্দুর রশীদ খানের
সম্পদনায় ১৯৫০ সালে প্রকাশিত পূর্ববাংলার প্রথম আধুনিক সাহিত্য সংকলন। ১৯৬০ সালে
তাঁর প্রথম কাব্য,
প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে-র প্রকাশ কবিতায় তাঁর
অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। কলকাতা থেকে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় তাঁর ‘রূপালি স্নান’ প্রকাশ করে কবিতার বৃহত্তর বাংলায়
তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ‘রূপালি স্নান’
কে বলা যায় শামসুর রাহমানের আগমনী কবিতা। এর সর্বাংশেই
জড়িয়ে আছে তাঁর স্বকীয়তা ও সৃষ্টিশীলতার চিহ্ন। তবে এ কবিতাসহ তাঁর প্রথম কাব্য
প্রকাশের পূর্বেই তাঁর কবিতা স্বল্প সময়ের মধ্যে তিরিশের দশকের কবিদের মোহজাল
থেকে মুক্ত হয়ে প্রথম কাব্যের রুদ্ধবদ্ধ-বিষণ্ণতার জগৎ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয় যার
প্রতিফলন ঘটে পরবর্তী কাব্য রৌদ্র করোটিতে।
তিরিশের কবিদের মধ্যে বিশেষ করে
বিষ্ণু দে ও বুদ্ধদেব বসু শামসুর রাহমানের প্রতি প্রীতিপরায়ণ ছিলেন। জীবনানন্দের
সঙ্গভীরুতার প্রাচীর টপকিয়ে তাঁর কলকাতার বাসভবনে হানা দিয়েছিলেন নরেশ গুহকে
সঙ্গী করে। কলকাতাবাসী আরো একজন গুণী ব্যক্তি আবু সয়ীদ আইয়ুব দূর থেকে তাঁর
কবিতার গতিপ্রকৃতির ওপর নজর রেখেছিলেন। অত্যন্ত খুঁতখুঁতে এ সমালোচকের দৃষ্টিতে
শামসুর রাহমান ছিলেন সমকালের একজন প্রধান কবির পরিচয়ে। আবুল হোসেন ও সৈয়দ
সাজ্জাদ হোসায়নের যুগ্ম সম্পাদনায় সংলাপ নামে একটি উচ্চমানের ত্রৈমাসিক
পত্রিকায় শামসুর রাহমানের কবিতা সমাদরে প্রকাশিত হয়। ‘পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ’, ‘খেলনার দোকানের সামনে ভিখিরি’, ত্রৈমাসিক সংলাপেই প্রথম প্রকাশিত
হয়। অবশ্য ইতোমধ্যে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা-য়, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পূবর্বাসা-য়, হুমায়ুন কবীরের চতুরঙ্গে বেশ কিছু
কবিতা প্রকাশের পর,
ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংলাপ পত্রিকায় তিনি কবি পরিচয়ে
সমাদৃত হন।
১৯৫৩ সালে রবীন্দ্রনাথের
শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত সাহিত্যমেলায় পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিত্বকারী পাঁচ সদস্যের
দলের তিনিও অন্যতম সদস্য ছিলেন। সাহিত্যমেলায় যোগদান ছিল তরুণ কবির জন্য এক
অপূর্ব অভিজ্ঞতা। সাহিত্যমেলার মূল প্রেরণা ছিলেন অন্নদাশংকর রায়। এছাড়া অশোক
বিজয় রাহা, সুরজিৎ দাশগুপ্ত,
গৌরী দত্ত (পরবর্তীকালের গৌরী আইয়ুব) ছাড়াও মেলা উপলক্ষে
যারা এসেছিলেন- বুদ্ধদেব বসু, প্রতিভা বসু, অজিত দত্ত, অম্লান দত্ত, নরেশ গুহ সকলের বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গের জ্ঞানী ও গুণী সমাজের সঙ্গে এ পরিচয় কবির জীবনে স্থায়ী প্রভাব
ফেলেছিল। শান্তিনিকেতনের সাহিত্যমেলার দু’বৎসর পরে ১৯৫৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত
হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন’। সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যোগদান করেছেন কবি নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। এ
সম্মেলনেও শামসুর রাহমান এক অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের কাব্যসাহিত্য নিয়ে একটি
দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠ করেন। সম্মেলনে কবি জসীমউদ্দীনের বক্তৃতায় আধুনিক কবিতা ও তার
প্রতিনিধিত্বকারী শামসুর রাহমানের কবিতা সম্পর্কে কিছু বিরূপ মন্তব্য ছিল। এতে
উপস্থিত তরুণ কবিরা খানিকটা তাঁকে ও তাঁর কবিতার সমালোচনা করে তাঁর বক্তব্যের জবাব
দিলে সামান্য উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু কিছুদিন পর শামসুর রাহমান ও সৈয়দ
শামসুল হক কবির সঙ্গে তাঁর কমলাপুরের বাড়িতে দেখা করেন। ফলে জ্যেষ্ঠ কবির আন্তরিক
আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে। ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে দিল্লীতে
অনুষ্ঠিত পাকভারত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যোগদানকারী লেখক দলে
ছিলেন শামসুর রাহমান।
শামসুর রাহমান ১৯৫৭ সালে
সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন ইংরেজী দৈনিক মর্নিং নিউজ-এর সহসম্পাদক হিসেবে। কিছুদিন
এ পত্রিকায় কাজ করার পর তিনি পেশা পরিবর্তন করে যোগ দেন রেডিও পাকিস্তানে। কিন্তু
রেডিও-তে অনুষ্ঠান প্রযোজকের কাজেও তিনি স্বস্তি বোধ করেননি। ফলে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪
সাল পর্যন্ত তিনি রেডিও-তে কাজ করার পর ১৯৬৪ সালে মর্নিং নিউজে উচ্চতর পদে যোগ
দেন। ‘তিনশো টাকায় আমি’
প্রথম কাব্যের এ সনেটে, চাকুরি জীবনের ঠুনকো নিশ্চয়তা ও
বাস্তবিক পরনির্ভরতা বিষয়ে রসিকতা করেছেন কবি নিজেকে নিয়ে। কবিতায় রয়েছে তিনশো
টাকার কথা, কিন্তু বাস্তবে মর্নিং নিউজে তাঁর বেতন ছিল একশো পঁচিশ, আর রেডিও-তে দুইশো বিয়াল্লিশ, সবসমেত বেতন বিষয়ক তথ্যটি তিনি
নিজেই সরবরাহ করেন,
তাঁর আত্মজীবনীতে। তবে চাকুরি হিসেবে কোনোটাই তাঁর মনোপূত
ছিল না।
মর্নিং নিউজে প্রত্যাবর্তনের পর
কবির সৃষ্টিশীলতায় নবগতির সঞ্চার হয়। এসময়কার কবিতাগুলি নিয়ে প্রকাশিত হয়
তাঁর দ্বিতীয় কাজ রৌদ্র করোটিতে। কবি তাঁর দ্বিতীয় কাব্যের জন্য আদমজী পুরস্কারে
ভূষিত হন। পুরস্কারটি প্রদান করেছিলেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। ‘হাতির শূঁড়’ কবিতায় যাঁর ক্ষমতাগ্রহণকে তিনি
ব্যঙ্গ করেছিলেন। মর্নিং নিউজের বছরগুলি ছিল কবির কবিতাচর্চার দিক দিয়ে সুফলা।
১৯৬৪ সালের শেষ দিকে প্রেস ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় ও প্রবীণ সাংবাদিক আবুল কালাম
শামসুদ্দীনের সম্পাদনায় দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক পদে তিনি
যোগদান করেন। পুরো এক দশক (১৯৭৭-১৯৮৭)
শামসুর রাহমান দৈনিক বাংলা (স্বাধীন বাংলাদেশ দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক বাংলায় পরিণত হয়) ও
সাপ্তাহিক বিচিত্রা-র সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
ইতোমধ্যেই প্রেসিডেন্ট হুসাইন
মোহাম্মদ এরশাদের সঙ্গে শামসুর রাহমানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। দৈনিক বাংলায়
তাঁর কবিতা যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে প্রকাশিত হতে থাকে। স্বৈরাচারী শাসনের
বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে দেশের সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে কবিগণ যুক্ত হয়ে গঠিত
করলেন জাতীয় কবিতা পরিষদ। উক্ত পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হলেন কবি শামসুর রাহমান।
শেক্সপীয়রের হ্যামলেট নাটকটির ভূমিকা ও টীকাটিম্পনীসহ অনুবাদের কাজে কবিকে
প্রাথমিকভাবে তাঁর সম্পাদকীয় দায়িত্ব থেকে ছয় মাসের ছুটি নিতে হয়েছে (হ্যামলেট
অনুবাদের মূল কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন হলেও, ভূমিকা ও টীকাটিপ্পনীসহ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল বেশ বিলম্বে, ১৯৯৫ সালে)। ইতোমধ্যে জাতীয় কবিতা
পরিষদের সভাপতি শামসুর রাহমান তাঁর স্বৈরাচারবিরোধী ভূমিকার জন্য রাষ্ট্রপতি
এরশাদের রোষ দৃষ্টিতে পড়েন। তারই প্রকাশ ঘটে দৈনিক বাংলা সম্পাদক পদ থেকে সরিয়ে
প্রধান সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম মুদ্রিত হলে। আপাতদৃষ্টিতে সম্মানের পিছনে এ অপমান
কবি মেনে নিতে পারেননি। ফলে ১৯৮৭ সালে তিনি পদত্যাগ করেন এবং তাঁর সাংবাদিক জীবনের
সমাপ্তি ঘটে। সাংবাদিক পরিচয়ে কবি বিদেশ ভ্রমণ করেন এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের
অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে মাসাধিক কাল নিউইয়র্কে কাটান।
শামসুর রাহমান সারাজীবন প্রত্যক্ষ
রাজনীতি থেকে দূরত্ব রক্ষার চেষ্টা করলেও তিনি তা করতে পারেননি। ১৯৬৭ সালে
পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দীনের নির্দেশে রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্র
সঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে এর প্রতিবাদে মুনীর চৌধুরী রচিত একটি বিবৃতিতে কবি
স্বাক্ষর করেন। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে
পড়লে, ১৭ দিনের যুদ্ধের উম্মাদনায় অনেকের মতো শামসুর রাহমানও কয়েকটি কবিতা ও একটি
মিনি কাব্যনাটক রচনা করেন। এর কোনোটিই তার কোনো কাব্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তবে তাঁর মতে সেসব কবিতায়
উত্তেজনা সৃষ্টির কোনো প্রয়াস ছিল না বরং শান্তির পক্ষেই ছিল উচ্চারণ। এ যুদ্ধের
পর পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয় তা
রাজনীতিবিমুখ কবিকেও উজ্জ্বীবিত করে। ১৯৬৯ সালের ২০জানুয়ারি তিনি রচনা করেন ‘আসাদের শাট’র্ কবিতাটি। তাঁর লেখা ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটির পিছনে রয়েছে পুলিশের
গুলিতে নিহত আসাদের শার্ট উঁচুতে তুলে ধরে প্রতিবাদী এক বিশাল মিছিলের মুখোমুখি
হওয়া কবির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। পরে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পাকিস্তানে একটি সাধারণ
ভাষা প্রচলনের প্রস্তাব দিলে এর তীব্র বিরোধিতা করে ৪০জন বাঙালি সাহিত্যিক শিল্পী ও
সাংবাদিক যে বিবৃতি প্রকাশ করেন (৩১ আগস্ট, ১৯৬৮), কবির ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ নামে বিখ্যাত কবিতাটি রচনার
অনুপ্রেরণা ছিল সেই প্রতিবাদ। বহির্বিশ্ব কবির কবিতায় ছায়া ফেলতে শরু করে তাঁর
দ্বিতীয় কাব্য রৌদ্র করোটিতে-র সময় থেকে। বিধ্বস্ত নিলীমা কবিতাগুচ্ছে আরও এক
ধাপ এগিয়ে যান কবি তাঁর বহির্বিশ্ব- চেতনার বিকাশের পথে। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত তাঁর
নিজ বাসভূমে কাব্য তিনি উৎসর্গ করেন আবহমান বাঙলার শহীদদের উদ্দেশ্যে। ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’, ‘পুলিশ রিপোর্ট’, ‘হরতাল’, ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’, এ কবিতাগুলির ছত্রেছত্রে লেগে আছে
এক বিক্ষুব্ধ সময়ের ছাপ।
একাত্তরের ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ
বিবরণ তিনি লিখে গিয়েছেন আত্মজীবনী কালের ধুলোয় লেখা গ্রন্থে ও সব পরোক্ষ বিবরণ
ধৃত আছে এ সময়ের অভিজ্ঞতার ওপর রচিত তাঁর উপন্যাস অদ্ভুত অাঁধার এক-এ। কালের
ধুলোয় লেখা শামসুর রাহমানের আত্মজীবনী প্রথমে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল
দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। কিছুটা আয়েশী রং-এর
লেখা এ স্মৃতিকথায় তিনি বারবার তাঁর স্মৃতি দুর্বলতার কথা বললেও এবং বারবার
কাহিনীর পারমার্থ লঙ্ঘিত হলেও, তাঁর জীবনের ও তাঁর কালের অনেক কথাই তিনি বলেছেন সবিস্তারে
এবং অকপটে। সাড়াতলীতে থাকার সময় তিনি রচনা করেন তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’। যুদ্ধকালীন লেখা কবিতাগুচ্ছ
মুক্তিযুদ্ধ শেষে ‘বন্দী শিবির থেকে’
নামে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফসল
অজস্র গল্প, উপন্যাস কবিতার মধ্যে ‘বন্দী শিবির থেকে’র কবিতাগুচ্ছ এক অনন্য মর্যাদার অধিকারী। একই সঙ্গে অন্তরের
রক্তক্ষরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও একাত্মতা, নিজের বন্দীত্বের বেদনা ও অসহায়তা
ও মুক্তির স্বপ্ন এ কবিতাগুচ্ছকে দিয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য
কাব্যের গৌরব। একাত্তরেই তিনি রচনা করেন তাঁর ‘স্যামসন’ নামের কবিতা। গাজার বন্দী শিবিরে
ইজরাইলী বীর অন্ধ অসহায় স্যামসন, যিনি তাঁর দুরন্ত কেশরাজি বেড়ে ওঠার সঙ্গে ফিরে পান তাঁর
হূতশক্তি ও সভাস্থলের স্তম্ভ ভূপাতিত করে সর্বনাশ টেনে আনেন শত্রুনগরীর মাথায়, বাইবেলের যে-কাহিনী অবলম্বনে ইংরেজ
কবি মিলটন রচনা করেছিলেন তাঁর অমর নাটক স্যামসন এ্যাগোনিস্ট, তাকেই আমাদের কবি প্রতিস্থাপন
করেছেন পাকিস্তানের বন্দী শিবিরে বাংলার বীর শেখ মুজিবের জায়গায়।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরিবারসহ শেখ
মুজিবের নিহত হওয়ার ঘটনায় তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং রচনা করেন তাঁর অন্যতম
শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’। পরে সেই একই শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটে তাঁর ‘ধন্য সেই পুরুষ’ নামের কবিতায়। মুজিবের প্রতি এ
অটুট শ্রদ্ধা,
তাঁর নেতৃত্বের প্রতি অবিচলিত আস্থার পরও কবি সেই
ব্যতিক্রমী ব্যক্তিদের অন্যতম যিনি বঙ্গবন্ধুর ‘বাকশালে’ যোগ দেননি। স্বৈরশাসন (১৯৮২-’৯০)-এর অবসান দাবী করে ও
গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় আস্থা জ্ঞাপন করে ৩১জন বিশিষ্ট নাগরিকের যে বিবৃতি
আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইল ফলক হয়ে আছে (৩০ মার্চ, ১৯৮৭), তার অন্যতম স্বাক্ষরদাতা ছিলেন তিনি।
তাঁর উদ্যোগে ১৯৮৮,
৮৯,
৯০-পর পর তিন বৎসর তাঁর নেতৃত্বে ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র সংলগ্ন রাস্তায় বিশাল প্যান্ডেলের নীচে সারাদেশের কবিদের অংশগ্রহণে
এবং অজস্র দর্শক শ্রোতার উপস্থিতিতে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় পালিত হয়েছে কবিতা উৎসব।
কবিতার শাণিত তীর নিক্ষিপ্ত হয়েছে জনধিকৃত স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে।
তাঁর দীর্ঘ (পঞ্চাশোবর্ধ) কবিজীবনে
শামসুর রাহমান কবিতার বিষয় ও ভাষায় নিরন্তর পরীক্ষাপ্রবণ ছিলেন। ব্যক্তি জীবনের
উত্থান-পতনের মধ্যে কবিতা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী-এ সত্যটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে
তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে। তাঁর কবিতার মধ্যে উর্ধগামীতা ও নিম্নগামীতার খোঁজ নিলে
একটা সাধারণ সিদ্ধান্তের দেখা মেলে। জাতীয় জীবনের জলবিভাজিকার বৎসর ১৯৭১-এর পূর্বে
রচিত পাঁচটি কাব্যে তিনি কবি হিসেবে তাঁর সার্থকতার শীর্ষ পৌঁছেছেন। পরবর্তী তিন দশকের
অধিক কালপর্বে কবিতায় তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা এক হিসেবে ষাট। শুধু সংখ্যার
হিসেবে তাঁর অবস্থান রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য না হলেও সন্নিকটে। তবে কবিতায় নিয়মিত
পালাবদলের বিচারে তিনি পিছিয়ে আছেন। ৭১-পরবর্তী ৬০টি কাব্যের প্রতিটিতেই তিনি
কয়েকটি কবিতা উপহার দিয়েছেন যা রসোত্তীর্ণ। ১৯৭৬ সাল থেকে সাহিত্যপ্রকাশ নিয়মিত
প্রকাশিত করে চলেছে ‘শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ এবং প্রতিটি সংস্করণেই গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে কারণ
দুই সংস্করণের অন্তর্বর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন কাব্যগ্রন্থ।
সাংবাদিকতা পেশার সুবাদে তাঁর
কবিতায় রয়েছে বিস্তর সাংবাদিকতার উপাদান, কিন্তু সবই তাঁর কবিত্বের রসে
জারিত। তাঁর প্রথম পর্বের কবিতায় যে সকল পুনরাবৃত্ত প্রতীক আমরা ব্যবহূত হতে
দেখেছি- ঘোড়া,
হরিণ, খঞ্জ, খাদ, ভিখিরি- সেগুলো বিদায় নিয়েছে ও তাদের জায়গায় এসেছে নতুন
প্রতীক। এর মধ্যে কোনটি যথার্থ প্রতীক, কোনটি শুধুই চিত্রকল্প- এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে। তাঁর
কবিতায় শুরু থেকেই চিত্রজয়তার লক্ষণ স্পষ্ট ছিল। ক্রমশই তা স্পষ্টতর হয়েছে।
অনেক সময় মনে হয়েছে অতিরিক্ত চিত্রকল্পের ভিড়ে তাঁর কবিতা প্রায়শই ভারাক্রান্ত, তাঁর বক্তব্যকে ছাপিয়ে উঠেছে ছবির
পর ছবি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর রচিত ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ চিত্রকল্পের ঔজ্জ্বল্যে, প্রচুরতায় ও জটিলতায় একটি
প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা। সমকাল ও সমকালীন ঘটনা কী রহস্যময় পথে কবিতার পরোক্ষতায়
ও প্রতীকতায় উতচে যায়,
কবিতা কীভাবে দৃশ্যকে আড়াল করে, অব্যক্তকে ব্যক্ত করে, প্রতীকের ঘন অরণ্যে কবির পথ রেখা
অনুসরণ কীভাবে একই সঙ্গে উচ্চকিত ও বিমূঢ় করে পাঠককে এবং আরও অনেক প্রাসঙ্গিক
প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে এ কবিতায়। এ কবিতায় অসুস্থ নৃপতি ও তৃতীয় রাজকুমার
এসেছে দেশীয় রূপকথার জগৎ থেকে। কিন্তু দেশীয় রূপকথা বা পুরাণ কাহিনীর মধ্যে আবদ্ধ
থাকেননি কবি। ইউরোপীয় সাহিত্যের ইলেকট্রা, হ্যামলেট, অ্যাগামেমনন, টেলিমেকাস, ইউরোপীয় পুরাণের ইকারুস ডিডেলাস
প্রতীকে রূপান্তরিত হয় তাঁর কবিতার উপজীব্য। বর্তমানের মধ্যে অতীতের প্রতিস্থাপনা, এলিয়ট বিষ্ণুদের এ প্রতীক সন্ধানী
তৎপরতায় খুব আগ্রহের সঙ্গেই যোগ দিয়েছেন তিনি। যে ঐতিহ্য তাঁর বিশ্বাস যে ঐহিত্য
তাঁকে স্পষ্ট করেছে তা সম্মিলিত ত্রিশের কবিদের ঐতিহ্য। আর এ পথেই তিনি আন্তর্জাতিক
কবিতার জগতে ছাড়পত্র পেয়েছেন, বোদিলিয়ার, আরাগ নেরুদার জগতে এবং একই সঙ্গে এখানেও বিষ্ণুদেই পথিকৃত
মাবিস, পিকাসো, কাত্তিনস্কির তুলি ও রঙের জগতে। অজস্র ধারায় কবিতা রচনার পাশাপাশি শামসুর
রাহমান যে অনুবাদ করেছেন,
সেগুলিও তাঁর সামগ্রিক কবিকর্মের অংশ। অনুবাদগুলির মধ্যে
ইউজিন ও’ নীলের মার্কোমিলিয়ানস (১৯৬৭), রবার্ট ফ্রস্টের নির্বাচিত কবিতা (১৯৬৮), খাজা ফরিদের কবিতা (১৯৬৯), টেনেসি উইলিয়মের হূদয়ের ঋতু
(১৯৭১), জীবনের এক পর্যায়ে বিভিন্ন জনের প্রণোদনায় তিনি করেছিলেন।
ছড়াকার হিসেবে শামসুর রহমান
নিঃসন্দেহে প্রথম সারির একজন। তাঁর আটটি ছড়ার বই, এর প্রথমটির প্রকাশকাল ১৯৭৪, শেষটির ২০০৫। এক পর্যায়ে বেশ কিছু
গান রচনা করেছিলেন তিনি এবং সেগুলিতে কণ্ঠ দিয়েছেন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পীরা। সাহিত্য
রসযোদ্ধা ও সমালোচক শামসুর রাহমানের পরিচয় বিধৃত আছে তাঁর আমৃত্যু তার জীবনানন্দ
(১৯৮৬) ও কবিতা এক ধরনের আশ্রয় (২০০২) গ্রন্থ দুটিতে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে
লিখিত কলামগুলির মধ্যে ষাটের দশকে দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত কলাম ওই সময়ে
পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তবে তাঁর গদ্য রচনার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করতে পারে
তাঁর কিশোরপাঠ্য স্মৃতির শহর। মাহুতটুলী ও আশোকলেনের জীবনে তিনি যে পুরান ঢাকার রূপ-রস-গন্ধ সত্তায়
মেখে নিয়েছিলেন সে অভিজ্ঞতার অপূর্ব বিবরণ ধরা পড়েছে এ স্মৃতি রোমন্থনে। পুরান
ঢাকার স্মৃতি যে দুটি অতুলনীয় গ্রন্থের জন্ম দিয়েছে তার একটি হলো পরিতোষ সেনের
জিন্দাবাজার আর একটি হলো শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর।
শামসুর রাহমান কবিতায় তাঁর
মৌলিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন, বাংলা কবিতার আধুনিকতার ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন, সমকালকে ধারণ করেছেন এক সদাজাগ্রত
সংবেদনশীলতায় এবং তাঁর আমৃত্যু অপরাহত কাব্যচর্চায় সহাবস্থান ঘটিয়েছেন
অন্তর্জীবনের পাশাপাশি দৃশ্যমান বহির্জীবনের, বাংলাদেশের কবিতার প্রাদেশিকতা
ঘুচিয়ে তাকে যুক্ত করেছেন বাংলা কবিতার মূল স্রোতের সঙ্গে। জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে তাঁর
গভীর অনুভূতিজাত মূল্যবোধ,
সকল সঙ্কীর্ণতামুক্ত উদার মানবিক মূল্যবোধ, তাঁর কবিতার চারিত্রের সঙ্গে সন্ধি
করেছে।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য
শামসুর রাহমান আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), জীবনানন্দ পুরস্কার (১৯৭৩), একুশে পদক (১৯৭৭), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার
(১৯৮১), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণ পদক (১৯৮১), ভাসানী পুরস্কার (১৯৮২), পদাবলী পুরস্কার (১৯৮৪), স্বাধীনতা পুরস্কারে (১৯৯২) ভূষিত
হন। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ১৯৮২ সালে তিনি জাপানের মিতসুবিশি পুরস্কার পান।
১৯৯৪ সালে কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকা তাঁকে আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত করে। ওই বছর
তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধীতে ভূষিত করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯৬ সালে
সাম্মানিক ডিলিট উপাধী দান করে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী। তাঁর মৃত্যু ঢাকায়, ১৮ আগস্ট ২০০৬। [জিল্লুর রহমান সিদ্দীকী]
গ্রন্থপঞ্জি শামসুর রাহমান, শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা; শামসুর রাহমান, কালের ধুলেয় লেখা, ২০০৪, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা; শামসুর রাহমান, কবিতাসংগ্রহ, ৪ খন্ড। ১ম খন্ড ২০০৫, ২য় খন্ড ২০০৬, ৩য় ও ৪র্থ খন্ড ২০০৭ অনন্যা, ঢাকা; সালেহ চৌধুরী সম্পাদিত, সেরা শামসুর রাহমান, ২০০৪, সময় ঢাকা; ভূঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত, নির্জনতা থেকে জনারণ্যে, শামসুর রাহমান, ২০০৬, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা; মীজানুর রহমান সম্পাদিত, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, শামসুর রাহমান, সংখ্যা ১৯৯১, ঢাকা; আবুল হাসনাত সম্পাদিত, কালি ও কলম, শামসুর রাহমান স্মরণ সংখ্যা, ২০০৩, ঢাকা।
তথ্যসুত্রঃ বাংলাপিডিয়া ও উইকিপিডিয়া
http://www.alokrekha.com
কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখাটা খুবই তথ্য বহুল। আলোকরেখাকে অনেক ধন্যবাদ দেরিতে হোক আমাদের দেশের বরেণ্য কবিকে নিয়ে লেখার জন্য।
ReplyDeleteকবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো। আমরা কবিদের কবিতা পড়ি। ভালো লাগে। তাঁদের জীবন নিয়ে লেখা সাধারণত পড়া হয় না। যেহেতু আলোকরেখা পড়া হয়ে থাকে তাই এখানে সব কিছুই পড়া হয় যা প্রকাশিত হয়। দেশ বরেণ্য কবি শামসুর রহমানকে তিটি এই তথ্যবহুল ও বিস্তারিত লেখার জন্য সাধুবাদ জানাই।
ReplyDelete