রবীন্দ্রনাথের গল্পে নারীর ক্রমবিকাশ
রবীন্দ্রসৃষ্টির কল্যাণে বাংলা সাহিত্য পেয়েছে অবিস্মরণীয় সব নারী চরিত্র। উপন্যাস ও বড়গল্পে ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য, ‘ল্যাবরেটরি’র সোহিনী, ‘যোগাযোগে’র কুমু, ‘দৃষ্টিদানে’র কুমু, ‘মালঞ্চ’র সরলা ও নীরজা, ‘দুইবোনে’র শর্মিলা ও ঊর্মিলা, ‘গোরা’র সুচরিতা, ‘নৌকাডুবি’র হেমনলিনী, ‘নষ্টনীড়ে’র চারুলতা, ‘ঘরে-বাইরে’র বিমলা, ‘চোখের বালি’র বিনোদিনীর, তুলনা পুরো বাংলাসাহিত্যেই বিরল। সেই সঙ্গে অবিস্মরণীয় ছোটগল্পের নারীচরিত্ররাও। ‘স্ত্রীর পত্রে’র মৃণাল, ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী, ‘দেনাপাওনা’র নিরুপমা, ‘হৈমন্তী’র হৈমন্তী, ‘রাসমণির ছেলে’র রাসমণি, ‘মণিহারা’র মণি, ‘পোস্টমাস্টারে’র রতন, ‘ঘাটের কথা’র কুসুম, ‘সুভা’র সুভাষিণী, ‘খাতা’র ঊমা, ‘শাস্তি’র চন্দরা তাদের চরিত্রের দৃঢ়তায় বাংলা সাহিত্যের পাঠকের স্মৃতিতে নিজস্ব জ্যোতিতে ভাস্বর। বিচিত্র সব নারী চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে রবীন্দ্রনাটকেও। ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী, ‘রাজা ও রাণী’র রাণী , নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’র সুন্দরীপ্রধানা শ্যামা, ‘মায়ার খেলা’র প্রমদা সকলেই অনন্যা।
রবীন্দ্রমানসে নারী শুধুই কোমলতা, স্নেহ বা প্রেমের প্রতিভু নয় বরং অনেক সময়ই নারী নীতির প্রশ্নে আপোষহীন, সভ্যতার সংকটে বিবেক এবং সমাজ কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে চিত্রিত। রবীন্দ্রবিশ্বের নারীরা পুরুষের ছায়ামাত্র নয় যা সেযুগের প্রেক্ষাপটে খুবই স্বাভাবিক বলে গণ্য হতে পারতো। বরং যুগের তুলনায় আশ্চর্যরকম অগ্রসর তার নারী চরিত্ররা। হয়তো ঠাকুরবাড়ির নারীদের মধ্যে এমন অনেকের দেখা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন বলেই সাহিত্যে এমন স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নারী চরিত্রের সৃষ্টি তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন কাদম্বরী, জ্ঞানদানন্দিনী, স্বর্ণকুমারী, সরলা ঘোষাল, ইন্দিরা দেবীর মতো বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী নারীদের। সেইসঙ্গে নিজের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, কন্যা মাধুরীলতা, রেণুকা, মীরাদেবীর মতো নারীর ছায়াও প্রতিফলিত হয়েছে তার সৃষ্ট চরিত্রে। নিঃসন্তান কাদম্বরী দেবীর বিপুল নিঃসঙ্গতা এবং নিঃসন্তান ও অকালমৃত বড়কন্যা মাধুরীলতাও নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার লেখায়। তার তিনকন্যার একজনও দাম্পত্যজীবনে সুখী ছিলেন না। সেই অসুখী দাম্পত্যের প্রতিফলন ও আত্মহত্যাকারী কাদম্বরীর আদিগন্ত অভিমানের ছোঁয়াও পাওয়া যায় তার সৃষ্টির ভুবনে আকাশচারী নারীদের মানসে। বৈচিত্রের দিক থেকেও রবীন্দ্রসাহিত্যের নারীরা বিচিত্রগামী। গ্রাম্য বালিকা, কৃষক পরিবারের গৃহবধূ, বিধবা মুসলমান বৃদ্ধা, মোগল রাজকুমারী, ব্রাহ্ম পরিবারের তরুণী, হিন্দু কূলবধূ, স্বদেশী বিপ্লবী, অবাঙালি ও সংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক নারী, স্বাধীন চাকরিজীবী নারীর ছবি তিনি এঁকেছেন। এই বিচিত্র সৃষ্টি সম্ভারের মধ্যেও গল্পগুচ্ছের এমন পাঁচটি নারী চরিত্র চোখে পড়ে যারা একে অন্যের প্রায় প্রতিরূপ। তবে পাঁচটি বিভিন্ন গল্পের মধ্য দিয়ে এরা এমনভাবে বিকশিত হয়েছে যে এ কথা ধারণা করা যায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই পাঁচটি গল্পের ভিতর দিয়ে নারীর মুক্তির পথ অন্বেষণ করেছেন। তার চিন্তায় নারীর মুক্তির পথ যত বিকশিত হয়েছে গল্পগুলোর মধ্য দিয়েও নারীর স্বাধীনতার পথ তত উন্মোচিত হয়েছে।
রবীন্দ্রমানসে নারী শুধুই কোমলতা, স্নেহ বা প্রেমের প্রতিভু নয় বরং অনেক সময়ই নারী নীতির প্রশ্নে আপোষহীন, সভ্যতার সংকটে বিবেক এবং সমাজ কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে চিত্রিত। রবীন্দ্রবিশ্বের নারীরা পুরুষের ছায়ামাত্র নয় যা সেযুগের প্রেক্ষাপটে খুবই স্বাভাবিক বলে গণ্য হতে পারতো। বরং যুগের তুলনায় আশ্চর্যরকম অগ্রসর তার নারী চরিত্ররা। হয়তো ঠাকুরবাড়ির নারীদের মধ্যে এমন অনেকের দেখা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন বলেই সাহিত্যে এমন স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নারী চরিত্রের সৃষ্টি তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন কাদম্বরী, জ্ঞানদানন্দিনী, স্বর্ণকুমারী, সরলা ঘোষাল, ইন্দিরা দেবীর মতো বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী নারীদের। সেইসঙ্গে নিজের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, কন্যা মাধুরীলতা, রেণুকা, মীরাদেবীর মতো নারীর ছায়াও প্রতিফলিত হয়েছে তার সৃষ্ট চরিত্রে। নিঃসন্তান কাদম্বরী দেবীর বিপুল নিঃসঙ্গতা এবং নিঃসন্তান ও অকালমৃত বড়কন্যা মাধুরীলতাও নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার লেখায়। তার তিনকন্যার একজনও দাম্পত্যজীবনে সুখী ছিলেন না। সেই অসুখী দাম্পত্যের প্রতিফলন ও আত্মহত্যাকারী কাদম্বরীর আদিগন্ত অভিমানের ছোঁয়াও পাওয়া যায় তার সৃষ্টির ভুবনে আকাশচারী নারীদের মানসে। বৈচিত্রের দিক থেকেও রবীন্দ্রসাহিত্যের নারীরা বিচিত্রগামী। গ্রাম্য বালিকা, কৃষক পরিবারের গৃহবধূ, বিধবা মুসলমান বৃদ্ধা, মোগল রাজকুমারী, ব্রাহ্ম পরিবারের তরুণী, হিন্দু কূলবধূ, স্বদেশী বিপ্লবী, অবাঙালি ও সংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক নারী, স্বাধীন চাকরিজীবী নারীর ছবি তিনি এঁকেছেন। এই বিচিত্র সৃষ্টি সম্ভারের মধ্যেও গল্পগুচ্ছের এমন পাঁচটি নারী চরিত্র চোখে পড়ে যারা একে অন্যের প্রায় প্রতিরূপ। তবে পাঁচটি বিভিন্ন গল্পের মধ্য দিয়ে এরা এমনভাবে বিকশিত হয়েছে যে এ কথা ধারণা করা যায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই পাঁচটি গল্পের ভিতর দিয়ে নারীর মুক্তির পথ অন্বেষণ করেছেন। তার চিন্তায় নারীর মুক্তির পথ যত বিকশিত হয়েছে গল্পগুলোর মধ্য দিয়েও নারীর স্বাধীনতার পথ তত উন্মোচিত হয়েছে।
নিরুপমা, হৈমন্তী, মৃণাল, কল্যাণী, অনিলা এই পাঁচজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঁচটি বিখ্যাত ছোটগল্প ‘দেনাপাওনা’, ‘হৈমন্তী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘অপরিচিতা’ ও ‘পয়লা নম্বর’ এর নায়িকা।
‘দেনাপাওনা’ গল্পে দেখা যায় মধ্যবিত্ত বাবা রামসুন্দরের আদরের মেয়ে নিরুপমা। জমিদার রায়বাহাদুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পুত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে অনেক টাকা পণ স্বীকার করেন বাবা। নিরুপমা সুন্দরী। কিন্তু সেই রূপের কোন কদর বা আদর তার শাশুড়ির কাছে নেই। চাকুরিরত স্বামী থাকে শহরে। প্রসঙ্গত বলা যায় রবীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে মাধুরীলতার স্বামী শরৎ ছিলো ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বেশ মোটা অংকের যৌতুক দিয়েই মাধুরীলতার বিয়ে দিয়েছিলেন কবি। স্বামীর ভালোবাসা পেলেও নিঃসন্তান মাধুরীলতা শ্বশুরবাড়িতে নিগৃহীত ছিলেন। মাধুরীলতা যখন ক্ষয়রোগে ভুগছেন তখন শ্বশুরবাড়িতে তার অযতœ অবহেলায় দুঃখ পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে তার সঙ্গেও যথেষ্ট শীতল ব্যবহার করা হয়। তাকে বাইরের ঘরে কাঠের চেয়ারে অবহেলায় বসিয়ে রাখা হতো। দীর্ঘ অপেক্ষা করে মেয়ের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেতেন তিনি। গল্পেও আমরা দেখি, পণের পুরো টাকা দিতে পারেনি বাবা। তাই শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ির প্রবল নির্যাতনের শিকার। মেয়েকে সুখি করতে শেষ সম্বল বাড়ি বিক্রি করে দেন বাবা। কিন্তু নিরুপমা টাকা দিতে বাধা দেয়। ‘টাকা যদি দাও তবেই অপমান। তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম। না বাবা,এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না’- এইএকটিমাত্র সংলাপে নিরুপমার ব্যক্তিত্ব ঝলসে উঠতে দেখি। শেষ পর্যন্ত অবহেলায় নির্যাতনে মৃত্যু হয় নিরুপমার। শেষ দেখাও হয় না পরম প্রিয় বাবার সঙ্গে।
নিরুপমার চেয়ে বিকশিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হৈমন্তী। সে শৈশবে মাতৃহীন এবং বাবার আদরের মেয়ে। হৈমন্তীর মধ্যেও অনেকটা মাধুরীলতার ছায়া দেখতে পাই । হৈমন্তীও সুন্দরী। সে তার বাবার সঙ্গে পাহাড়ি অঞ্চলে মুক্ত পরিবেশে বড় হয়েছে। তার বাবা গৌরসুন্দর যেন রবীন্দ্রনাথেরই প্রতিরূপ। বাবা-কন্যার মধ্যে স্নেহ ও বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যেও কবি ও কবিকন্যার প্রতিফলন দেখা যায়।
হৈমন্তীর স্বামী অপু তাকে ভালোবাসলেও শ্বশুরবাড়িতে অবহেলার শিকার এই তরুণী। যদিও গৌরসুন্দর পণের টাকা পুেেরাই পরিশোধ করেন। কিন্তু গৌরসুন্দর সম্পর্কে প্রথমে অপুর বাবা-মায়ের ধারণা ছিল তিনি অনেক বড়চাকুরে ও ধনী। কিন্তু দেখা গেল তিনি তাদেও আশানুরূপ ধনী নন। একই বিষয় রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল তার বেহাই বাড়িতে। ঠাকুর পরিবারের সন্তান ও জমিদারির প্রধান পরিচালক রবীন্দ্রনাথের প্রবল ধনী হিসেবে সমাজে পরিচিতি থাকলেও, তিনি তার সব সম্পত্তি দিয়ে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার পর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য স্বল্প টাকারই অধিকারী ছিলেন। হৈমন্তরীর মতো মাধুরীলতাও বেড়ে উঠেছিলেন শিলাইদহের প্রকৃতির মধ্যে স্বাধীন পরিবেশে।
নিরুপমার চেয়ে হৈমন্তী মানসিকভাবে আরও অনেক দৃঢ় চরিত্রের। হৈমন্তী সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিলেও অপমানের কণ্টক শয়নে থাকায় ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। একসময় মৃত্যু হয় এই প্রবল আত্মবিশ্বাসী নারীর। হৈমন্তী বেঁচে থাকতে তার প্রাত্যহিক নিপীড়নের গণ্ডি থেকে বের হতে পারেনি। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়েছিল মৃণালের দ্বারা।
স্ত্রীর পত্রের মৃনাল বাংলা সাহিত্যের অনন্য সম্পদ। মৃণাল অজ পাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা একটি মেয়ে। তার বাবার বাড়ি পূর্ববঙ্গের গ্রামে। ‘বাঙাল দেশের রান্না’ নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে অনেক অপমান সহ্য করতে হয় তাকে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে কবিপত্নী মৃণালিনীর কথা। তিনিও খুলনার গ্রামের মেয়ে। তাকেও অভিজাত ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে অনেক বাঁকা কথা শুনতে হয়েছিল ‘বাঙাল দেশের মেয়ে’ হিসেবে।
জমিদার পরিবারের মেজবউ মৃণাল ছিল অসাধারণ সুন্দরী। কিন্তু সে যে সুন্দরী সেকথা শ্বশুরবাড়ির লোকরা দ্রুত ভুলে গেলেও সে যে বুদ্ধিমতী সেটা তারা ভুলতে পারেনি।
মৃণাল সহজ স্বাভাবিক বুদ্ধির অধিকারিনী। তাই অন্যায় দেখলে এর প্রতিবাদে সত্য কথাটি সে সহজে উচ্চারণ করতে পারে। আর তাই শ্বশুরবাড়িতে তাকে প্রতি পদে হেয় করার চেষ্টা চলে। তবে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মৃণাল সেসব তুচ্ছ করে তার প্রতিবাদী ভূমিকা ধরে রাখে। অসহায় নিরাশ্রয় মেয়ে বিন্দুকে সে আশ্রয় দেয়। শ্বশুরবাড়ির লোকরা বিন্দুকে এক পাগলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়ায়। বিন্দু পালিয়ে এলে এরপরও মৃণাল তাকে আশ্রয় দেয় সকলের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করেই।
শেষপর্যন্ত অপমানিত ও লাঞ্ছিত বিন্দু আত্মহত্যা করে। সংসারে নারীর অবস্থান যে কত দুঃসহ তা নতুন ভাবে উপলব্ধি করে মৃণাল। একসময় সাংসারিক বন্দীদশা থেকে নিজের মুক্তির পথ খুঁজে নেয় মৃণাল। সে পুরীর তীর্থক্ষেত্রে চলে যায়। বাঙালি ঘরের একজন কুলবধূর এই সাহসী ভূমিকা ছিল চমকপ্রদ। মৃণাল নিজেই বলে সে আত্মহত্যা করবে না বরং স্বাধীনভাবে বাঁচবে। ‘মীরাবাইকে তো বাঁচার জন্য মরতে হয়নি’।
প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ নিজেও অন্বেষণ করছিলেন নারীর মুক্তির পথ। সেকি সংসারে যাঁতাকলে পিষ্ট হতেই থাকবে? ‘রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা’র চক্র থেকে নারীকে মুক্ত হতে হবে। কিন্তু সেই মুক্তি কি কেবল ধর্মের পথে? না তা নয়। নারীর মুক্তি তার স্বাধীন জীবনে। সেই স্বাধীনতা কিভাবে পাওয়া যায়?
সেই পথই খোঁজে ‘অপরিচিতা’র কল্যাণী। ‘অপরিচিতা’ গল্পটিতে আবারও আমরা দেখতে পাই এক বাবা ও তার আদরের মেয়েকে। কল্যাণী সুন্দরী ও শিক্ষিতা। তার বাবা ডাক্তার শম্ভুনাথ অনেকটাই হৈমন্তীর বাবা গৌরসুন্দরের মতো। তিনিও বাংলার বাইওে ভারতের অন্য প্রদেশে মাতৃহীন কন্যাকে নিয়ে থাকেন। তবে বাবা ও মেয়ে দুজনেই তুলনায় অনেক বেশি দৃঢ় মনোভাবের।
কল্যাণীর বিয়েতে তার বাবা পাত্রপক্ষের দাবিমতো যৌতুকের টাকা ও অলংকার দিতে রাজি হন। বিয়ের আসরে পাত্রের মামা বরকর্তা হিসেবে মেয়ের গা থেকে সকল অলংকার খুলে তা মেপে নিতে চায়। দেখা যায় প্রতিশ্রুত পরিমাণের চেয়ে তিনি বেশিই দিয়েছেন। পাত্রপক্ষ সন্তুষ্ট হলেও শম্ভুনাথ বলেন ‘ আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব এ কথা যারা মনে তাদেও হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না’। মেয়ের বিয়ে না দিয়ে তিনি পাত্রপক্ষকে বিয়ের আসর থেকে বিদায় করে দেন।
এদিকে পাত্র অনুপম ছিল সুবোধ ভালো মানুষ। মামার অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ সে বিয়ের আসরে করতে পারেনি বটে কিন্তু হবু স্ত্রী কল্যাণীকে ভুলতে পারে না। মা এবং মামার আদেশ অগ্রাহ্য করে সে কল্যাণীর সন্ধান করে। খুঁজে সে পায়। কিন্তু কল্যাণী নারীর শিক্ষার ব্রত গ্রহণ করেছে। সে বিয়েতে রাজি হয় না। কল্যাণীর সমাজসেবার কাজে অনুপম সহযোগী হয়। বিয়ের আসরে এই গণ্ডোগোলের কিছুটা আভাস আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের ছোটমেয়ের বিয়ের আসরের ঘটনায়। মীরা দেবীর স্বামী ছিলেন উদ্ধত প্রকৃতির। বিয়ের আসরে তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই অভদ্র ব্যবহার করেন। পরবর্তিতে মীরা দেবীর সঙ্গেও দুর্ব্যবহারের কারণে তাদের বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। মীরাদেবীর অসুখি দাম্পত্যজীবন রবীন্দ্রনাথকে সবসময়ই পীড়া দিত। এবং তিনি প্রায়ই ভাবতেন যে যদি আসরেই বিয়েটি বন্ধ করা যেত তাহলে হয়তো পরবর্তিতে এত কষ্টভোগ করতে হতো না। এই ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে ‘অপরিচিতা’য়।
কল্যাণী নিজের এবং অন্য অনেক নারীর মুক্তির পথ খুঁজছে। নারীর মুক্তি কোথায়? ঘরে, সংসারে, প্রেমে, ধর্মে না সমাজসেবায়? কোন অবলম্বন ছাড়া কি স্বাধীনভাবে নারী বাঁচতে পারে না? অবশ্যই পারে। ‘পয়লা নম্বর’ গল্পের অনিলা তাই ত্যাগ করে স্বামীর ঘর।
অনিলাও ছিল বাবার আদরের মেয়ে। তার স্বামী অদ্বৈত ছিল স্ত্রীর প্রতি উদাসীন। নিজের পড়াশোনা ও বন্ধুদের নিয়েই ব্যস্ত। সংসারের আয়ব্যয় অভাব অভিযোগ কোন কিছুতেই তার মন নেই। তার কয়েকজন শিষ্য গোছের বন্ধু রয়েছে। তাদের কাছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখা, বই পড়ে ব্যাখ্যা করাই তার একমাত্র নেশা। তার পাশের বাড়ি অর্থাৎ গলির মোড়ের পয়লা নম্বর বাড়িতে বাস করতো সুদর্শন ধনী জমিদার সীতাংশুমৌলী। সে অনিলার প্রেমে পড়ে, তাকে একের পর এক চিঠি পাঠায়। কিন্তু অনিলা কোন সাড়া দেয় না। অনিলার একমাত্র ভাই আত্মহত্যা করে। কিন্তু উদাসীন স্বামী সে খবরটুকুও রাখে না। এরপর একদিন গৃহত্যাগ করে অনিলা। স্বামী মনে করে সে সীতাংশুর সঙেই চলে গেছে। কিন্তু অনেক বছর পর সে জানতে পারে তার ধারণা সঠিক ছিল না। অনিলা কোন পুরুষের হাত ধরে ঘর ছাড়েনি। সে নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় সংসার ত্যাগ করেছে। অনিলা যেমন তার স্বামীকে চিঠি লিখে গেছে ‘আমার খোঁজ করো না’ তেমনি সেদিন সীতাংশুকেও জীবনে একটিমাত্র চিঠিতে একই কথা লিখে গেছে।
খসড়া আকারে লেখা ‘মুসলমানীর গল্প’-এ রবীন্দ্রনাথ এমন এক নারীর ছবি আঁকেন যে নারী তার বিয়ের আসর থেকে ডাকাত দ্বারা অপহৃত হয়। ডাকাতের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করে মুসলমান এক গোত্র সর্দার। মেয়েটি ফিরে আসলেও সমাজ ও পরিবার তাকে গ্রহণ করে না। সে ফিরে যায় সেই মুসলিম সর্দারের আশ্রয়ে। তার ছেলেকে বিয়ে করে। কয়েক বছর পর তার মামাতো বোনের বিয়ের আসরে একইভাবে ডাকাত পড়ে। তখন লাঠি হাতে ডাকাতদের প্রতিরোধ করে সেই মুসলমান দিদি।
রবীন্দ্রনাথ বুঝতে চেয়েছেন এবং পাঠককেও বুঝাতে চেয়েছেন যে স্বাধীন ও ক্ষমতায়িত জীবনের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত মুক্তি। এক নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে অন্য নারীকে। মানুষ হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে এর গত্যান্তর নেই।
তথ্য সুত্র ঃhttps://arts.bdnews24.com‘দেনাপাওনা’ গল্পে দেখা যায় মধ্যবিত্ত বাবা রামসুন্দরের আদরের মেয়ে নিরুপমা। জমিদার রায়বাহাদুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পুত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে অনেক টাকা পণ স্বীকার করেন বাবা। নিরুপমা সুন্দরী। কিন্তু সেই রূপের কোন কদর বা আদর তার শাশুড়ির কাছে নেই। চাকুরিরত স্বামী থাকে শহরে। প্রসঙ্গত বলা যায় রবীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে মাধুরীলতার স্বামী শরৎ ছিলো ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বেশ মোটা অংকের যৌতুক দিয়েই মাধুরীলতার বিয়ে দিয়েছিলেন কবি। স্বামীর ভালোবাসা পেলেও নিঃসন্তান মাধুরীলতা শ্বশুরবাড়িতে নিগৃহীত ছিলেন। মাধুরীলতা যখন ক্ষয়রোগে ভুগছেন তখন শ্বশুরবাড়িতে তার অযতœ অবহেলায় দুঃখ পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে তার সঙ্গেও যথেষ্ট শীতল ব্যবহার করা হয়। তাকে বাইরের ঘরে কাঠের চেয়ারে অবহেলায় বসিয়ে রাখা হতো। দীর্ঘ অপেক্ষা করে মেয়ের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেতেন তিনি। গল্পেও আমরা দেখি, পণের পুরো টাকা দিতে পারেনি বাবা। তাই শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ির প্রবল নির্যাতনের শিকার। মেয়েকে সুখি করতে শেষ সম্বল বাড়ি বিক্রি করে দেন বাবা। কিন্তু নিরুপমা টাকা দিতে বাধা দেয়। ‘টাকা যদি দাও তবেই অপমান। তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম। না বাবা,এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না’- এইএকটিমাত্র সংলাপে নিরুপমার ব্যক্তিত্ব ঝলসে উঠতে দেখি। শেষ পর্যন্ত অবহেলায় নির্যাতনে মৃত্যু হয় নিরুপমার। শেষ দেখাও হয় না পরম প্রিয় বাবার সঙ্গে।
নিরুপমার চেয়ে বিকশিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হৈমন্তী। সে শৈশবে মাতৃহীন এবং বাবার আদরের মেয়ে। হৈমন্তীর মধ্যেও অনেকটা মাধুরীলতার ছায়া দেখতে পাই । হৈমন্তীও সুন্দরী। সে তার বাবার সঙ্গে পাহাড়ি অঞ্চলে মুক্ত পরিবেশে বড় হয়েছে। তার বাবা গৌরসুন্দর যেন রবীন্দ্রনাথেরই প্রতিরূপ। বাবা-কন্যার মধ্যে স্নেহ ও বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যেও কবি ও কবিকন্যার প্রতিফলন দেখা যায়।
হৈমন্তীর স্বামী অপু তাকে ভালোবাসলেও শ্বশুরবাড়িতে অবহেলার শিকার এই তরুণী। যদিও গৌরসুন্দর পণের টাকা পুেেরাই পরিশোধ করেন। কিন্তু গৌরসুন্দর সম্পর্কে প্রথমে অপুর বাবা-মায়ের ধারণা ছিল তিনি অনেক বড়চাকুরে ও ধনী। কিন্তু দেখা গেল তিনি তাদেও আশানুরূপ ধনী নন। একই বিষয় রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল তার বেহাই বাড়িতে। ঠাকুর পরিবারের সন্তান ও জমিদারির প্রধান পরিচালক রবীন্দ্রনাথের প্রবল ধনী হিসেবে সমাজে পরিচিতি থাকলেও, তিনি তার সব সম্পত্তি দিয়ে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার পর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য স্বল্প টাকারই অধিকারী ছিলেন। হৈমন্তরীর মতো মাধুরীলতাও বেড়ে উঠেছিলেন শিলাইদহের প্রকৃতির মধ্যে স্বাধীন পরিবেশে।
নিরুপমার চেয়ে হৈমন্তী মানসিকভাবে আরও অনেক দৃঢ় চরিত্রের। হৈমন্তী সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিলেও অপমানের কণ্টক শয়নে থাকায় ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। একসময় মৃত্যু হয় এই প্রবল আত্মবিশ্বাসী নারীর। হৈমন্তী বেঁচে থাকতে তার প্রাত্যহিক নিপীড়নের গণ্ডি থেকে বের হতে পারেনি। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়েছিল মৃণালের দ্বারা।
স্ত্রীর পত্রের মৃনাল বাংলা সাহিত্যের অনন্য সম্পদ। মৃণাল অজ পাড়া গাঁ থেকে উঠে আসা একটি মেয়ে। তার বাবার বাড়ি পূর্ববঙ্গের গ্রামে। ‘বাঙাল দেশের রান্না’ নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে অনেক অপমান সহ্য করতে হয় তাকে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে কবিপত্নী মৃণালিনীর কথা। তিনিও খুলনার গ্রামের মেয়ে। তাকেও অভিজাত ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে অনেক বাঁকা কথা শুনতে হয়েছিল ‘বাঙাল দেশের মেয়ে’ হিসেবে।
জমিদার পরিবারের মেজবউ মৃণাল ছিল অসাধারণ সুন্দরী। কিন্তু সে যে সুন্দরী সেকথা শ্বশুরবাড়ির লোকরা দ্রুত ভুলে গেলেও সে যে বুদ্ধিমতী সেটা তারা ভুলতে পারেনি।
মৃণাল সহজ স্বাভাবিক বুদ্ধির অধিকারিনী। তাই অন্যায় দেখলে এর প্রতিবাদে সত্য কথাটি সে সহজে উচ্চারণ করতে পারে। আর তাই শ্বশুরবাড়িতে তাকে প্রতি পদে হেয় করার চেষ্টা চলে। তবে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মৃণাল সেসব তুচ্ছ করে তার প্রতিবাদী ভূমিকা ধরে রাখে। অসহায় নিরাশ্রয় মেয়ে বিন্দুকে সে আশ্রয় দেয়। শ্বশুরবাড়ির লোকরা বিন্দুকে এক পাগলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়ায়। বিন্দু পালিয়ে এলে এরপরও মৃণাল তাকে আশ্রয় দেয় সকলের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করেই।
শেষপর্যন্ত অপমানিত ও লাঞ্ছিত বিন্দু আত্মহত্যা করে। সংসারে নারীর অবস্থান যে কত দুঃসহ তা নতুন ভাবে উপলব্ধি করে মৃণাল। একসময় সাংসারিক বন্দীদশা থেকে নিজের মুক্তির পথ খুঁজে নেয় মৃণাল। সে পুরীর তীর্থক্ষেত্রে চলে যায়। বাঙালি ঘরের একজন কুলবধূর এই সাহসী ভূমিকা ছিল চমকপ্রদ। মৃণাল নিজেই বলে সে আত্মহত্যা করবে না বরং স্বাধীনভাবে বাঁচবে। ‘মীরাবাইকে তো বাঁচার জন্য মরতে হয়নি’।
প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ নিজেও অন্বেষণ করছিলেন নারীর মুক্তির পথ। সেকি সংসারে যাঁতাকলে পিষ্ট হতেই থাকবে? ‘রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা’র চক্র থেকে নারীকে মুক্ত হতে হবে। কিন্তু সেই মুক্তি কি কেবল ধর্মের পথে? না তা নয়। নারীর মুক্তি তার স্বাধীন জীবনে। সেই স্বাধীনতা কিভাবে পাওয়া যায়?
সেই পথই খোঁজে ‘অপরিচিতা’র কল্যাণী। ‘অপরিচিতা’ গল্পটিতে আবারও আমরা দেখতে পাই এক বাবা ও তার আদরের মেয়েকে। কল্যাণী সুন্দরী ও শিক্ষিতা। তার বাবা ডাক্তার শম্ভুনাথ অনেকটাই হৈমন্তীর বাবা গৌরসুন্দরের মতো। তিনিও বাংলার বাইওে ভারতের অন্য প্রদেশে মাতৃহীন কন্যাকে নিয়ে থাকেন। তবে বাবা ও মেয়ে দুজনেই তুলনায় অনেক বেশি দৃঢ় মনোভাবের।
কল্যাণীর বিয়েতে তার বাবা পাত্রপক্ষের দাবিমতো যৌতুকের টাকা ও অলংকার দিতে রাজি হন। বিয়ের আসরে পাত্রের মামা বরকর্তা হিসেবে মেয়ের গা থেকে সকল অলংকার খুলে তা মেপে নিতে চায়। দেখা যায় প্রতিশ্রুত পরিমাণের চেয়ে তিনি বেশিই দিয়েছেন। পাত্রপক্ষ সন্তুষ্ট হলেও শম্ভুনাথ বলেন ‘ আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব এ কথা যারা মনে তাদেও হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না’। মেয়ের বিয়ে না দিয়ে তিনি পাত্রপক্ষকে বিয়ের আসর থেকে বিদায় করে দেন।
এদিকে পাত্র অনুপম ছিল সুবোধ ভালো মানুষ। মামার অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ সে বিয়ের আসরে করতে পারেনি বটে কিন্তু হবু স্ত্রী কল্যাণীকে ভুলতে পারে না। মা এবং মামার আদেশ অগ্রাহ্য করে সে কল্যাণীর সন্ধান করে। খুঁজে সে পায়। কিন্তু কল্যাণী নারীর শিক্ষার ব্রত গ্রহণ করেছে। সে বিয়েতে রাজি হয় না। কল্যাণীর সমাজসেবার কাজে অনুপম সহযোগী হয়। বিয়ের আসরে এই গণ্ডোগোলের কিছুটা আভাস আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের ছোটমেয়ের বিয়ের আসরের ঘটনায়। মীরা দেবীর স্বামী ছিলেন উদ্ধত প্রকৃতির। বিয়ের আসরে তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই অভদ্র ব্যবহার করেন। পরবর্তিতে মীরা দেবীর সঙ্গেও দুর্ব্যবহারের কারণে তাদের বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। মীরাদেবীর অসুখি দাম্পত্যজীবন রবীন্দ্রনাথকে সবসময়ই পীড়া দিত। এবং তিনি প্রায়ই ভাবতেন যে যদি আসরেই বিয়েটি বন্ধ করা যেত তাহলে হয়তো পরবর্তিতে এত কষ্টভোগ করতে হতো না। এই ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে ‘অপরিচিতা’য়।
কল্যাণী নিজের এবং অন্য অনেক নারীর মুক্তির পথ খুঁজছে। নারীর মুক্তি কোথায়? ঘরে, সংসারে, প্রেমে, ধর্মে না সমাজসেবায়? কোন অবলম্বন ছাড়া কি স্বাধীনভাবে নারী বাঁচতে পারে না? অবশ্যই পারে। ‘পয়লা নম্বর’ গল্পের অনিলা তাই ত্যাগ করে স্বামীর ঘর।
অনিলাও ছিল বাবার আদরের মেয়ে। তার স্বামী অদ্বৈত ছিল স্ত্রীর প্রতি উদাসীন। নিজের পড়াশোনা ও বন্ধুদের নিয়েই ব্যস্ত। সংসারের আয়ব্যয় অভাব অভিযোগ কোন কিছুতেই তার মন নেই। তার কয়েকজন শিষ্য গোছের বন্ধু রয়েছে। তাদের কাছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখা, বই পড়ে ব্যাখ্যা করাই তার একমাত্র নেশা। তার পাশের বাড়ি অর্থাৎ গলির মোড়ের পয়লা নম্বর বাড়িতে বাস করতো সুদর্শন ধনী জমিদার সীতাংশুমৌলী। সে অনিলার প্রেমে পড়ে, তাকে একের পর এক চিঠি পাঠায়। কিন্তু অনিলা কোন সাড়া দেয় না। অনিলার একমাত্র ভাই আত্মহত্যা করে। কিন্তু উদাসীন স্বামী সে খবরটুকুও রাখে না। এরপর একদিন গৃহত্যাগ করে অনিলা। স্বামী মনে করে সে সীতাংশুর সঙেই চলে গেছে। কিন্তু অনেক বছর পর সে জানতে পারে তার ধারণা সঠিক ছিল না। অনিলা কোন পুরুষের হাত ধরে ঘর ছাড়েনি। সে নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় সংসার ত্যাগ করেছে। অনিলা যেমন তার স্বামীকে চিঠি লিখে গেছে ‘আমার খোঁজ করো না’ তেমনি সেদিন সীতাংশুকেও জীবনে একটিমাত্র চিঠিতে একই কথা লিখে গেছে।
খসড়া আকারে লেখা ‘মুসলমানীর গল্প’-এ রবীন্দ্রনাথ এমন এক নারীর ছবি আঁকেন যে নারী তার বিয়ের আসর থেকে ডাকাত দ্বারা অপহৃত হয়। ডাকাতের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করে মুসলমান এক গোত্র সর্দার। মেয়েটি ফিরে আসলেও সমাজ ও পরিবার তাকে গ্রহণ করে না। সে ফিরে যায় সেই মুসলিম সর্দারের আশ্রয়ে। তার ছেলেকে বিয়ে করে। কয়েক বছর পর তার মামাতো বোনের বিয়ের আসরে একইভাবে ডাকাত পড়ে। তখন লাঠি হাতে ডাকাতদের প্রতিরোধ করে সেই মুসলমান দিদি।
রবীন্দ্রনাথ বুঝতে চেয়েছেন এবং পাঠককেও বুঝাতে চেয়েছেন যে স্বাধীন ও ক্ষমতায়িত জীবনের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত মুক্তি। এক নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে অন্য নারীকে। মানুষ হিসেবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে এর গত্যান্তর নেই।
সানজিদা রুমি কর্তৃক গ্রথিত http://www.alokrekha.com
খুব তাৎপর্যময় ও তথ্যবহুল লেখা। রবীন্দ্রনাথের গল্পে নারী চরিত্রগুলো বিশেষ আবেদন বহন করে.এই লেখাটা রবীন্দ্র গল্পে নারীদের বিশেষ ভূমিকার লেখা। যা আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সহায়ক। আলোকরেখাকে বিশেষ ধন্যবাদ।
ReplyDeleteরবীন্দ্রনাথের গল্পে নারী চরিত্রগুলো রবীন্দ্রমানসে নারী শুধুই কোমলতা, স্নেহ বা প্রেমের প্রতিভু নয় বরং অনেক সময়ই নারী নীতির প্রশ্নে আপোষহীন, সভ্যতার সংকটে বিবেক এবং সমাজ কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে চিত্রিত। রবীন্দ্রবিশ্বের নারীরা পুরুষের ছায়ামাত্র নয় যা সেযুগের প্রেক্ষাপটে খুবই স্বাভাবিক বলে গণ্য হতে পারতো। বরং যুগের তুলনায় আশ্চর্যরকম অগ্রসর তার নারী চরিত্ররা। বিশেষ আবেদন বহন করে.এই লেখাটা রবীন্দ্র গল্পে নারীদের বিশেষ ভূমিকার লেখা। যা আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সহায়ক। আলোকরেখাকে বিশেষ ধন্যবাদ।খুব তাৎপর্যময় ও তথ্যবহুল লেখা।
ReplyDeleteরবীন্দ্রনাথের গল্পে নারী পড়ে খুব ভালো লাগলো তথ্যবহুল লেখা।যুগের তুলনায় আশ্চর্যরকম অগ্রসর তার নারী চরিত্ররা। হয়তো ঠাকুরবাড়ির নারীদের মধ্যে এমন অনেকের দেখা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন বলেই সাহিত্যে এমন স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নারী চরিত্রের সৃষ্টি তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন কাদম্বরী, জ্ঞানদানন্দিনী, স্বর্ণকুমারী, সরলা ঘোষাল, ইন্দিরা দেবীর মতো বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী নারীদের। সেইসঙ্গে নিজের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, কন্যা মাধুরীলতা, রেণুকা, মীরাদেবীর মতো নারীর ছায়াও প্রতিফলিত হয়েছে তার সৃষ্ট চরিত্রে। নিঃসন্তান কাদম্বরী দেবীর বিপুল নিঃসঙ্গতা এবং নিঃসন্তান ও অকালমৃত বড়কন্যা মাধুরীলতাও নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার লেখায়।
ReplyDelete