রিজিয়া রহমান
রিজিয়া
রহমান (১৯৩৯–২০১৯) হলেন স্বাধীনতা উত্তর কালের বাংলাদেশের একজন নারী ঔপন্যাসিক ছিলেন। ষাটের দশক থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও শিশুসাহিত্যে তার
বিচরণ। তার প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ অগ্নি স্বাক্ষরা। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হল ঘর ভাঙা
ঘর, উত্তর পুরুষ, রক্তের অক্ষর, বং থেকে বাংলা।
লিখেছেন অভিবাসী আমি ও নদী নিরবধি
নামে দুটি আত্মজীবনী। উপন্যাসে অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের
জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।
রিজিয়ার ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভারতের কোলকাতার ভবানীপুরে এক মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক বাড়ি ছিল কোলকাতার কাশিপুর থানার নওবাদ গ্রামে। তার পারিবারিক নাম ছিল জোনাকী। তার বাবা আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক ছিলেন একজন চিকিৎসক ও মা মরিয়াম বেগম একজন গৃহিণী। তাদের পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনা। তার দাদা মুন্সী আব্দুল খালেকের পড়ালেখার অভ্যাস ছিল। তার ঘরে সেলফ ভর্তি ছিল ইংরেজি আর ফার্সি বই। তার বাবা ছিলেন সঙ্গীত অনুরাগী। তিনি এসরাজ ও বাঁশি বাজাতেন এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন। তার মা সায়গল, জগন্ময় মিত্র ও কানন বালার গান শুনতেন। তার বাবার চাকরীর কারনে তাদের ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর তারা বাংলাদেশে চলে আসে। দেশে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ফরিদপুরে। সেই সময় শখের বশে কবিতা লিখতেন। ১৯৫০ সালে তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়েন তখন তার লেখা গল্প টারজান সত্যযুগ পত্রিকায় ছোটদের পাতায় ছাপা হয়েছিল। ১৯৫২ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর তারা ঢাকার শাইনপুকুরে নানাবাড়িতে চলে আসেন। সেই সময় তার এক মামা চাঁদপুরে চাকরী করতেন। তিনি সেখানে চলে যান এবং একটি বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তার মামার পরিবার রক্ষণশীল হওয়ার কারনে তাকে বোরখা পড়তে বাধ্য করা হয়। একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে বোরখায় আটকে রাস্তায় লোকের সামনে পড়ে যাওয়ায় তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পরে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬০ সালে দীর্ঘদিন পর দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় তার লেখা গল্প ছাপা হয় এবং দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় তার লেখা কবিতা ছাপা হয়। ১৯৬৭ সালে ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতার সম্পাদক কামরুন নাহার লাইলির উৎসাহে তিনি লাল টিলার আকাশ নামক গল্প লিখেন। পরে ললনা পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন।
বাবার বদলীর চাকরীর কারনে তার শিক্ষাজীবন নিরবচ্ছিন্ন ছিল না। বাবার কর্মস্থল ফরিদপুরে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাগ্রহন শুরু হয়। বাবার মৃত্যুর পর চাঁদপুরে মামার বাড়িতে চলে যান এবং এক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও সেখান থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারেননি। প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে তাকে ম্যাট্রিক পাস করতে হয়। বিয়ের পর স্বামীর সাথে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে চলে যান এবং সেখানে কোয়েটা গভর্মেন্ট কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে দুই বছর লেখাপড়া করেন। কিন্তু মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট সম্পর্কিত জটিলতার কারনে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি না দিলে দেশে এসে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৫ সালে এই কলেজ থেকেই স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।রিজিয়া রহমান সাহিত্য পত্রিকা
'ত্রিভুজ'-এর সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন জাতীয়
জাদুঘরের পরিচালনা বোর্ডের ট্রাস্টি ও জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের কার্য পরিচালক হিসেবে।
তিন বছর বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শৈশব থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় তার কবিতা ও গল্প ছাপা হলেও তার প্রথম গল্পগ্রন্থ অগ্নিস্বাক্ষরা ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। এই গল্পগ্রন্থে লাল টিলার আকাশ গল্পটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ম্যাগাজিনে অশ্লীলতার অভিযোগে ছাপাতে নারাজ ছিল। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সম্পাদনা বোর্ডকে রাজি করিয়ে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।[২] পরে ললনা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তার ঘর ভাঙ্গা ঘর ছাপা হয়, যা বই আকারে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। বস্তির মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-ক্লেদ নিয়ে রচিত এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত তার উত্তর পুরুষ উপন্যাসে তিনি চট্টগ্রামে হার্মাদ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দখলদারিত্বের চিত্র তুলে ধরেছেন। এতে চিত্রিত হয়েছে আরাকান-রাজ-সন্দ-সুধর্মার অত্যাচার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্ব, পর্তুগিজদের ব্যবসায়ীদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস।[৬] নিষিদ্ধ পল্লীর দেহপসারিণীদের মানবেতর দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলী নিয়ে লিখেছেন রক্তের অক্ষর (১৯৭৮)। সাপ্তাহিক 'বিচিত্রা' পত্রিকায় দেহপসারিণীদের নিয়ে লিখিত প্রতিবেদন পড়ে তিনি এই উপন্যাস লেখার প্রেরণা পান। বং থেকে বাংলা (১৯৭৮) তার একটি অন্যতম উপন্যাস। বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও বাংলা ভাষার বিবর্তন এই উপন্যাসের মূল বিষয়। এই উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন,"বাংলাদেশের জাতিগঠন ও ভাষার বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে 'বং থেকে বাংলা' উপন্যাসের সৃষ্টি।"
নীল বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে খুলনা অঞ্চলের এক বিপ্লবী রহিমউল্লাহর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বীরত্বগাঁথা নিয়ে লিখেছেন অলিখিত উপাখ্যান (১৯৮০)। এটি মূলত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরির পাতা থেকে অনুপ্রাণিত।রিজিয়া তার স্বামীর কর্মস্থল বেলুচিস্তানে কয়েক বছর অবস্থান করেন। ১৯৫৮ সালের বেলুচিস্তান বিদ্রোহের পটভূমিতে তিনি রচনা করেন শিলায় শিলায় আগুন (১৯৮০)। তার স্বামীর আরেক কর্মস্থল বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে কাজ করার সময় তিনি সাঁওতালদের জীবনচিত্র পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের শিকারি থেকে কৃষক ও পরে শ্রমজীবী হয়ে ওঠা, এই বদলে যাওয়া জীবন নিয়ে তিনি রচনা করেন একাল চিরকাল (১৯৮৪)।২০০৪ সালে প্রকাশিত বাঘবন্দি উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন বঞ্চনা থেকে মুক্তি আবশ্যকতা। প্রাচীন নগরীতে যাত্রা উপন্যাসে লিখেছেন ঢাকার অতীত ও বর্তমান জীবনযাপন সম্পর্কে। অভিবাসী আমি তার আত্মজীবনীমূলক প্রথম বই। এতে তিনি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তার শৈশবের বর্ণনা দিয়েছেন। তার দ্বিতীয় আত্মজীবনীমূলক বই নদী নিরবধি ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়। এতে তিনি তার শৈশবের পাশাপাশি লেখক জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন।এছাড়া ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ চার দশকের গল্প। এতে ১৭টি গল্প রয়েছে, যার রচনা কাল ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১২ সাল। গল্পগুলোতে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে।
রিজিয়া রহমান ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর এই প্রয়াণে বাংলাদেশের অপরিসীম ক্ষতি হল। তাঁর বিদেহী
আত্মার শান্তি কামনা করি ও আলকরেখার পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
গ্রন্থতালিকা
গল্পগ্রন্থ
- অগ্নিস্বাক্ষরা (১৯৬৭)
- নির্বাচিত গল্প (১৯৭৮)
- চার দশকের গল্প (২০১১)
- দূরে কোথাও
উপন্যাস
- ঘর ভাঙা ঘর (১৯৭৪)
- উত্তর পুরুষ (১৯৭৭)
- রক্তের অক্ষর (১৯৭৮)
- বং থেকে বাংলা (১৯৭৮)
- অরণ্যের কাছে (১৯৮০)
- অলিখিত উপাখ্যান (১৯৮০)
- শিলায় শিলায় আগুন (১৯৮০)
- ধবল জোত্স্না (১৯৮১)
- সূর্য সবুজ রক্ত (১৯৮১)
- একাল চিরকাল (১৯৮৪)
- ঝড়ের মুখোমুখি (১৯৮৬)
- প্রেম আমার প্রেম (১৯৮৫)
- সবুজ পাহাড় (১৯৮৫)
- একটি ফুলের জন্য (১৯৮৬)
- শুধু তোমাদের জন্য (১৯৮৮)
- হে মানব মানবী (১৯৮৯)
- হারুন ফেরেনি (১৯৯৪)
- বাঘবন্দী (২০০৬)
- আবে-রওয়াঁ (২০০৬)
- সুপ্রভাত সোনালি দিন (২০০৬)
- অতলান্ত নীল (২০০৬)
- অন্ধকারে বেতোফেন (২০০৬)
- উৎসে ফেরা (২০০৯)
- আলবুর্জের বাজ (২০১০)
- পবিত্র নারীরা (২০১০)
- সীতা পাহাড়ে আগুন (২০১০)
- নিঃশব্দ শব্দের খোঁজে
- তৃণভূমির বাইসন
- ডাইম নিকেল
- প্রজাপতি নিবন্ধন
- প্রাচীন নগরীতে যাত্রা
- চন্দ্রাহত
- বান্ধবী প্রিয়দর্শিনী ও অন্যান্য (২০১২)
ক. বান্ধবী প্রিয়দর্শিনী
খ. জ্যোৎস্নার নীল সীমানা
গ. জগৎ জুড়িয়া কান্দে।
কবিতা
অনুবাদ
আত্মজীবনী
- অভিবাসী আমি
- নদী নিরবধি (২০১১)
রম্যরচনা
- খাওয়া-খায়ির বাঙালি
শিশুসাহিত্য
- আজব ঘড়ির দেশে
- ঝিলিমিলি তারা
- মতিশীলের বাড়ি ও অন্যান্য ও গল্প
পুরস্কার ও সম্মাননা
- বাংলা
একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৮)
- যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৪)
- হুমায়ুন কাদির স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪)
- আসফ-উদ-দৌলা রেজা স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪)
- বাংলাদেশ লেখক সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৫)
- কমর মুশতারি সাহিত্য পদক (১৯৯০)
- অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫)
- নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক
- একুশে
পদক (২০১৯)
সুত্র ঃ উইকিপিডিয়া
সানজিদা রুমি কর্তৃক গ্রথিত
http://www.alokrekha.com
আলোকরেখার সব থেকে বড় গুণ এখানে সদ্য পুরাতন সব জানা যায়। বরেণ্য লেখক কবি উপন্যাসিক রিজিয়া রহমান সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। এই লেখাটা খুঁজে পেতে উকিপিডিয়ায় জানতে পারতাম। কিন্তু আলোকরেখায় একটি ওয়েব সাইটে সব পাচ্ছি। এই জন্যি আলোকরেখার সাথে আছি থাকবো।
ReplyDelete