কী আছে শেষে
মাহ্ফুজা শীলু
কোনটা আমার নিজের শহর? ঢাকা না নিউইয়র্ক ? নিজের কাছে প্রশ্ন রেখে নিজেই উত্তর খুঁজি। হয়তো দুটোই। এই দুই শহরের সঙ্গেই আমার একাধিকবার বিচ্ছেদ ঘটেছে। আবারও পুরোনো বন্ধুর মতো ফিরে ফিরে গেছি এই দুই শহরেই। শেষে থিতু হলাম ঢাকায়। এখন পর্যন্ত।
মানুষ কখন এতটা স্বার্থপর হয়? যখন পিঠ দেয়ালে ঠেকে ?
কথাটি মনে এল ঢাকাকে নিয়ে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ঢাকা তো দিব্যি চলছে। প্রেমিক-প্রেমিকার মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একেকটি বাড়ি। লোকচক্ষুর আড়ালে নয়, সর্বসমক্ষেই | কোনো কোনো বাড়ি অবাধ্য, একরোখা প্রেমিকের মতো যেন একটু বেশিই ঝুঁকে রয়েছে অন্যটির উপর। তাতে যা হবার তা-ই হয়। দমবন্ধ ভালোবাসায় সম্পর্কচ্ছেদ। আলোহাওয়াহীন এই ঢাকার জীবনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সুতো ছিঁড়েছিল তের বছর আগে।
সেই যে বললাম, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ঢাকা চলছে। কোথাও কিচ্ছুটি থেমে নেই। অথচ ঢাকা ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে গাড়ির নিচে, ছেঁড়াকাপড় ভিক্ষুকের পায়ের চাপে, নোংরা ময়লার স্তূপে।
নিজের সুখ এবং স্বার্থে বিভোর আমরা নাক চেপে, চোখ আধবোজা করে রাস্তার সময়টুকু পার করে পড়ে থাকি নিজেরই নির্মিত কারাগারে। ঘরে তালা, গেটে তালা এবং মনে একটি বিরাট তালা ঝুলিয়ে মানুষের মুখোশ পরে অন্য কোনো প্রাণী হয়ে ঘরে বসে রিমোট কন্ট্রোলে দেখি আর একটি জীবনকে। যে জীবনের সঙ্গে সারাদিন ধরে দেখা জীবনের কোনো মিল নেই।
আপাতমস্তক এক স্বার্থপর মানুষ হয়ে আমাদের এই আত্মমগ্ন জীবনযাপন।
মেয়েকে দূরের স্কুলে দেবার সুবাদে প্রতিদিন আমাকে ঘণ্টা চার-পাঁচ রাস্তায় কাটাতে হয়। ঘুম ভেঙে যখন রাস্তায় নামি তখন ঢাকাও জেগে ওঠে একটু একটু করে। প্রতিদিন দেখি একদল নারী শাড়ির উপর খাটো হলুদ অ্যাপ্রন পরে, লম্বা ঝাড়ু– হাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এয়ারপোর্ট রোড ঝাড়ু– দিচ্ছে। উদাসীন ভঙ্গিতে ঝাড়ু– দিতে দিতে চলেছে ওরা। পাতা-আবর্জনা উড়ে, ঘুরে, কোথায় চলে যাচ্ছে, ছুঁতে পারে না। খুব একটা চেষ্টাও করে না।
এটা একটা চাকরি, প্রতিদিন ঝাড়ু– হাতে পথে নামা। তবে এই পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষে, ওরা যেমন জানে না, আমিও না। কেবল শেষতক প্রতিদিনের ব্যর্থ চেষ্টায় ঢাকা সেই আগের মতোই নোংরা রয়ে যায়। পূতিগন্ধময় এই শহরে প্রতিদিন বাইরে থেকে ঘরে ফিরি ভিন্ন মানুষ হয়ে। বিষণ্ণ, ক্লান্ত, অপমানিত, বিরক্ত। বিষণ্ণতা এবং ক্লান্তির ব্যাপারটি বুঝি, কিছুটা অভ্যেসে মেনেও নিই। তবে অপমানটা নিতে পারি না। অপমান হয় নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার কারণে। আর বিরক্ত হই কিছুই বদলায় না দেখে।
কিংবা উল্টো করেও বলা যায়, সবকিছু বদলে গেছে বলে। ঢাকার আকাশ বদলে গেছে, বাতাস বদলে গেছে, ভালোবাসা বদলে গেছে। বদলে গেছে মানুষ। তের বছর পরে দেশে ফিরে আমি এক ভিন্ন ঢাকাকে আবিষ্কার করি। আবিষ্কার করি, এই মৃত শহরের প্রতি আমার আর কোনো প্রণয় নেই!
রক্তাক্ত হৃদয়ে লেখাটি এখানেই শেষ করেছিলাম বেশ আগে।
আজ হঠাৎ অলোকরঞ্জনের কবিতার লাইন মনে এল। ‘তুমি বলেছিলে বিচ্ছেদই শেষ কথা, শেষ কথা কেউ কি জানে ! মনে হল, যাকে একদা ভালোবেসেছি তার সম্পর্কে শেষ কথা এত সহজে বলি কী করে ?
তাই এই দ্বিতীয় অধ্যায়ের জন্ম। প্রিয় কিছু হারানোর বেদনায় আমার হৃদয় রক্তাক্ত হয়েছে শুধু। এর বেশি কিছু নয়। যখন দেখি স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের কাছে আপামর জনতা বন্দি, তখন এক অদ্ভুত ক্রোধ হয়। যে ক্রোধ নিজেকে ছাড়া আর কিছুই পোড়াতে পারে না। বোধকরি আমার মতো মানুষের সংখ্যাই বেশি এই শহরে । তাই আজ দেশের এই পরিণতি ! যেখানে সবটা দেশ ভেঙে পড়ছে, ঢাকা একা দাঁড়িয়ে থাকে কী করে? সম্পর্কের সততার মতো সামাজিক সততাও এই দেশ থেকে নিরুদ্দেশ আজ। যন্ত্রের মতো অনুভূতিশূন্য হয়ে মানুষ কেবল নিজেকে ভালো রাখায় ব্যস্ত।
একদিকে এই নতুন ঢাকাকে আবিষ্কার করি আর আমার কেবল আশির দশকের ঢাকার কথা মনে পড়ে। যখন আমি বড় হয়ে উঠছিলাম।
সে সময় আমরা থাকতাম আজিমপুর কলোনিতে। এখনকার কলোনিবাসের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার মিল পাওয়া কঠিনই বটে। আশেপাশের বেশ অনেকগুলো বিল্ডিংয়ের লোকজনকে আমরা একে অপরকে নাম ধরে চিনতাম। তাঁরা অধিকাংশ আমার বাবার পরিচিত কিংবা আমাদের ভাইবোনদের। কারেন্ট চলে গেলে, সন্ধ্যের পর বাবা-মা, পাড়ার চাচা-চাচিরা মাঠে মাদুর বিছিয়ে আড্ডায় বসতেন। (এখন মাঠগুলোর অনেকটা দখল করে আছে ময়লার স্তূপ)। আমরা চাঁদের আলোয় এ মাঠ ও মাঠ ঘুরে বেড়িয়েছি বাবার বন্ধুর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। যাদের আমরা নিজের ভাইবোন বলেই গণ্য করেছি।
ছুটির বিকেলে রিকশার হুড ফেলে হাওয়া খেতে খেতে চলে গেছি আজিমপুর থেকে বাংলামোটর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। পথে বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখার অপার্থিব আনন্দ। বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যাওয়া তখনও শুরু হয়নি।
আরও পরে যখন বাবা মারা গেলেন, আজিমপুর থেকে কাঁঠালবাগান চলে এলামÑসেসবও এখন স্মৃতি। তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়েছে আরও অনেক বেশি। নাটক দেখছি, রাত জেগে কেন্দ্রে গান শুনছি, আবৃত্তি করছি স্বরিত আবৃত্তিচক্রে। কণ্ঠশীলনে ওয়াহিদুল হক, বিপ্লব বালা, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শুদ্ধ উচ্চারণ শিখছি। ওয়াহিদুল হক কিংবা দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে বন্ধুদের নিয়ে গাছ চেনার নেশায় ঘুরে বেড়িয়েছি। তখনই ওয়াহিদভাইয়ের কাছে প্রথম জানলাম, আস্ত একটি গাছের নামই ‘কুসুম’। রমনা পার্কের যে দিকটা এসে মিশেছে হোটেল শেরাটনের পাশে, সেখানে রয়েছে গাছটি। আমি জানি না গাছটি এখনও আছে কি না।
টিএসসির ভেতরে ছিল নাগেশ্বরী চম্পা। আর ফুলার রোডের পাশে ফুটত বেগুনি রঙের অজস্র জারুল।
রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন শেষে, প্রায় মধ্যরাতে শিল্পকলা একাডেমী থেকে সাগর সেনের গান শুনে ফিরছি দল বেঁধে। পথে ফুলার রোডের ফুটপাতে বসে আরও খানিক আড্ডা। আমি দর্শক সারি থেকে সাগর সেনকে গাইতে অনুরোধ করেছিলাম ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো’। (তখনও সুবিনয়ের কণ্ঠে এ গান আমার শোনা হয়নি) । অনুষ্ঠান শেষে গ্রিনরুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, গানটি কেন গাইলেন না? উনি হেসে বলেছিলেন , ‘আমার প্রাণের পরে কেউ যায়নি যে!’ আ-হা স্মৃতি!
আড্ডা দিয়েছি পথেপ্রান্তরে। রাতবিরেতে। অথচ এ ধরনের প্রত্যেকটি আনন্দ থেকে আমি আমার আত্মজাকে বঞ্চিত করছি। কেন ? নিরাপত্তার অভাব। সমাজ যেখানে অ-নিরাপদ, আমি একা, ভালোবাসায় অন্ধ এক সামান্য মা, কতটা নিরাপত্তা ওকে দিতে পারব?
ক্লাস থেকে ফিরে বসুধা যখন ঘরে ঢোকে আমি ওর ক্লান্ত চেহারার দিকে তাকাতে পারি না। আমাদের বাসা থেকে ওর স্কুলের দূরত্ব মাইল দশ/বারো। তিরিশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। উন্নত বিশ্ব হলে দশ মিনিটই বলতাম। অথচ প্রতিদিন ওর চার-পাঁচ ঘন্টা সময় চলে যাচ্ছে শুধু পথে। এরপর ফিরে এসে ছুটছে টিউটরদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। ছায়ানটে যাবে সময় নেই, আঁলিয়স ফ্রঁসেসে যাবে, সময় নেই, জার্মান কালচারাল সেন্টারে যাবে, সময় নেই, কেনেডি সেন্টারে যাবে, সময় নেই। অথচ এর কোনোটিই আমাদের বাসা থেকে দূরে নয়। হাঁটাপথ। এই সময়গুলো সব চলে যাচ্ছে ট্রাফিক জ্যামের পেটের ভেতর।
তখন আমরা নিউইয়র্কে। কুইন্সের এলমহার্স্ট নামের চাইনিজ এলাকায় থাকি। আমার মেয়ে বসুধার স্কুলজীবন শুরু হয়নি তখনও । সে কারণে ইংরেজিও তাকে গ্রাস করেনি । নিয়মিত শুনত অনুপ ঘোষালের গাওয়া সুকুমার রায়ের ছড়ার গান। আর সুমন চট্টোপাধ্যায়ের (তখনও কবীর সুমন নন) বাচ্চাদের একটি গানের ক্যাসেট ‘ছোটবড় মিলে’। এর একটি গান আধো উচ্চারণে প্রায় নির্ভুল কথায় গাইত বসুধা।
একটি বাচ্চার কন্ঠে গাওয়া গানের শুরুটা এরকম--
‘স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারি
আমরা কি আর বইতে পারি
এও কি একটা শাস্তি নয়?
কষ্ট হয়! কষ্ট হয় !
কে করল রে এই নিয়ম ? (ও উচ্চারণ করত ‘লিয়ম’)
লোকটা বুঝি খেলার যম!
তখন গম্ভীরকণ্ঠে সুমন বলছেন :
‘খেলবে কেন? অঙ্ক করো
যোগ্য হওয়ার রাস্তা ধরো.............।’
শিশুশিল্পীটি প্রায় কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে গাইছে :
‘কোথায় রাস্তা, কোথায় যাবো
কোথায় গেলে শুনতে পাবো
একটু পড়া, অনেক খেলা
গল্পশোনা সন্ধ্যেবেলা.......।’
আমি আমার মেয়ের জীবনটাকে এরকমই দিতে চেয়েছিলাম‘একটু পড়া, অনেক খেলা। গল্পশোনা সন্ধ্যেবেলা ।
পারিনি।
আশেপাশের মানুষ, আমাদের বন্ধু বা আত্মীয় ওকে কেউ গাছ চেনায় না, নদী চেনায় না, রোদের রং দেখে সময় বুঝতে শেখায় না, হাওয়ায় ভেসে আসা ফুলের গন্ধ শুঁকে কেউ নাম বলে দেয় না। কোনটা স্বাতী, কোনটা বিশাখা, কোনটাইবা অরুন্ধতী, আকাশের তারাদের সঙ্গেও কেউ পরিচয় করিয়ে দেয় না ওকে । কেবল জানতে চায় ওর রেজাল্ট কী ?
সব বিষয়ে ‘এ’ না পেলে জীবন কতটা অর্থহীন হবে জানাতে চায় সেটাও।
আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। বসুধারা কোনোদিন রবীন্দ্রনাথ, বিভূতি, মানিক, বুদ্ধদেব পড়বে না? পড়লেও বুঝবে না?
প্রকৃতির কাছ থেকে ওদের আর কিছুই শেখার নেই ! সব শিক্ষা এখন কেবল নিতে হবে যন্ত্র এবং কিছু যন্ত্রের মতো মানুষের কাছ থেকে?
হায়, আমরা নিজেরই বিরুদ্ধে প্রকৃত কুসুম হয়ে জেগে উঠব কবে ?
http://www.alokrekha.com
কী আছে শেষে ........ মাহ্ফুজা শীলু'র লেখাটা দারুন অনবদ্য। ঢাকা ও উত্তর আমেরিকার যে রূপ তিনি তুলে ধরেছেন তা সত্যি প্রশংসার যোগ্য। খুব ভালো লাগলো। ভালো থাকবেন।
ReplyDeleteমাহ্ফুজা শীলু'র "কী আছে শেষে "........ লেখাটা দারুন চমৎকার। ভালো থাকবেন কবি। অনবদ্য।
ReplyDeleteমাহ্ফুজা শীলু'র "কী আছে শেষে " দারুন চমৎকার লেখা । কি দারুন গভীরতা ,ভাব মনের ভেতর অতল তলে অনুরণ সৃষ্টি করে। কত বার যে পড়ালাম। লেখক মাহ্ফুজা শীলু যেন আমার মনের কথাই বলছেন। অনেক ভালোবাসা । আলোকরেখা অনেক ধন্যবাদ এমন একজন লেখকের সাথে পরিচিত করিয়ে দেবার জন্য।
ReplyDeleteমাহ্ফুজা শীলু'র "কী আছে শেষে " দারুন চমৎকার লেখা ।লেখাটা পড়ে মনটা ভোরে গেল -এখানেই কবির সার্থকতা। কি ভাষায় প্রকাশ- শব্দ ও ভাবের সাথে মনকাড়া এক লেখা . অনেক অনেক শুভ কামনা আপনার জন্য।
ReplyDeleteমাহ্ফুজা শীলু'র "কী আছে শেষে " দারুন চমৎকার লেখা ।লেখাটা পড়ে মনটা ভোরে গেল -এখানেই লেখকের সার্থকতা। কি ভাষায় প্রকাশ- শব্দ ও ভাবের সাথে মনকাড়া এক লেখা . অনেক অনেক শুভ কামনা আপনার জন্য। দারুন গভীরতা ,ভাব মনের ভেতর অতল তলে অনুরণ সৃষ্টি করে। কত বার যে পড়ালাম। লেখক মাহ্ফুজা শীলু যেন আমার মনের কথাই বলছেন। অনেক ভালোবাসা । আলোকরেখা অনেক ধন্যবাদ এমন একজন লেখকের সাথে পরিচিত করিয়ে দেবার জন্য।
ReplyDeleteমাহ্ফুজা শীলু'র "কী আছে শেষে " চমৎকার লেখা ।লেখাটা পড়ে মনটা ভোরে গেল। আমিও এর মধ্যে ঢাকায় গেছিলাম। আমার অভিজ্ঞতা হুবহু একই রকম। পার্থক্য শুধু লেখক মাহফুজা শীলু খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছেন যা আমরা পারি না। অনেক ধন্যবাদ লেখককে। ভাষায় প্রকাশ- শব্দ ও ভাবের সাথে মনকাড়া এক লেখা . অনেক অনেক শুভ কামনা আপনার জন্য।
ReplyDelete