শুভাশীষকে চিঠি' (এপিসোড ৬)/মুনা চৌধুরী
নিলিশ্বরী,
তোমার কথার সুরে এখনো সেই আগের মতো অভিমান! যেন ১৯ বছরে একেবারেই বড়ো হওনি তুমি। শুনে ভালো লাগলো কাজের সাথে দিনকয়েক ঘুরে আসবে। বেড়িয়ে এসো কলকাতা, আর আমিও নাহয় দেখবো তিলোত্তমাকে তোমার চোখে।
দু’বাংলার ঘরছাড়া দেশছাড়া মানুষের কথা ভাবলে আমিও দুঃখী হয়ে যাই। কেন জানো, আমিও যে ওদেরই একজন। দাদা বর্ধমান থেকে দাঙ্গার বছর দুই পর এসেছিলেন আর তারপর থেকে বাংলাদেশে উনি স্থায়ী হয়েছিলেন। ১৯৪৬ এর কলকাতা দাঙ্গা/প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস অথবা ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের কথা যখন ভাবি, তখন কেন জানি সব হানাহানি, অন্যায়, অবিচার, জবাই, সম্ভ্রম পেরিয়ে আরেকদল সাধারণ মানুষের কথা মনে পড়ে যারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, মানচিত্র ভুলে গিয়ে সীমান্ত পেরুনো ঘরছাড়া, দেশছাড়া দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ঠিক তোমার বাবার পুরোনো ঢাকার শরণার্থী শিবিরের গল্পটার মতো, আর মুক্তিযুদ্ধ? মা এর কাছে আমরা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছি। আমার জন্ম যদিও মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পর, তুবুও বড়ো ভাইবোনদের নিয়ে দীর্ঘ ৯ মাস কত অচেনা অনাত্মীয়ের বাড়িতে আমাদের পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। সেসব ইতিহাস ভুলে যাবার নয়।
কিন্তু অনেক যুদ্ধ থাকে, যেমন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, যার খুব দরকার ছিল কেননা ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের অন্যায় বিদ্রোহ ছিলোনা, বরং পাকিস্তানের একতরফা অন্যায় আর জুলুমের বিরুদ্ধে আমাদের ভাতের, ভোটের আর ভাষার ন্যায্য অধিকার আদায়ের যুদ্ধ ছিল। বাবার অভিজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধ যেন আরো কাছ থেকে দেখেছি কেননা বাবা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্পে যুদ্ধের সময় বন্দি ছিলেন। অনেক সরকারি কর্মচারী তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের পক্ষে কাজ করেছেন। সেই আতঙ্ক, মৃত্যুভয়, আর বিভীষিকাময় বন্দি সময়ে বাবাকে ফায়ারিং স্কোয়াড এর নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাকে আবার সেনাবাহিনী ক্যাম্পে ফিরিয়েও আনা হয়। ভাগ্যের পরিক্রমায় যুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি সবার মাঝে মুক্ত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। বাবার সাহসী, দৃঢ়-প্রত্যয়ী গলায় মুক্তিযুদ্ধের গল্প কোনো গল্পের খাতিরে গল্প নয়, নিছক কিছু আবেগের স্মৃতিচারণা নয়, মুক্তিযুদ্ধের গল্প আমাদের পরিচয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের পরিচয়ের ইতিহাস।
সেদিন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জহির রায়হানের 'সময়ের প্রয়োজনে' নামে একটা লেখা পড়তে পড়তে বুকের ভেতর কেমন যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো- “জয়া কোনোদিন সমুদ্র দেখেনি। সমুদ্র দেখার বড় ইচ্ছে ছিল তার। একদিন হাসতে হাসতে বলল: জানো, সমুদ্র দেখে এলাম। জনতার সমুদ্র।… বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে। চুয়ান্নতে। বাষট্টি, ছেষট্টি কিংবা ঊনসত্তরে অনেক দেখেছি। কিন্তু এত প্রাণের জোয়ার কখনো দেখিনি। এত মৃত্যুও দেখিনি আগে।… জয়ার কোনো খবর নেই। কোথায় গেল মেয়েটা? জানি না। জানতে গেলে ভয় হয়। শুধু জানি, এ যুদ্ধে আমরা জিতব আজ, নয় কাল, নয়তো পরশু। একদিন আমি আবার ফিরে যাব আমার শহরে, আমার গ্রামে। তখন হয়তো পরিচিত অনেক মুখ সেখানে থাকবে না। তাদের আর দেখতে পাব না আমি। যাদের পাব তাদের প্রাণভরে ভালোবাসব। যারা নেই কিন্তু একদিন ছিল, তাদের গল্প আমি শোনাব ওদের। সেই ছেলেটির গল্প বুকে মাইন বেঁধে যে ট্যাংকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কিংবা সেই বুড়ো কৃষক রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়ে যে মৃদু হেসে বলেছিল, চললাম। আর ফিরে আসেনি। অথবা উদ্বাস্তু শিবিরের পাঁচ লাখ মৃত শিশু, দশ হাজার গ্রামের আনাচ-কানাচে এক কোটি মৃতদেহ। না এক কোটি নয়, হয়তো হিসাবের অঙ্ক তখন তিন কোটিতে গিয়ে পৌঁছেছে। এক হাজার এক রাত কেটে যাবে হয়তো। আমার গল্প তবু ফুরাবে না।’’ জহির রায়হান ফিরে আসেননি তবে তিনি রেখে গেছেন তার না ফুরোনো গল্পগুলো। কিন্তু আমরা যারা রয়ে গেলাম, তারা কি পেরেছিলাম যুদ্ধশেষে বেঁচে থাকা মানুষদের প্রানভরে ভালোবাসতে?
সেই প্রথম দিককার কথা, যখন তোমার সাথে আমার সবে বন্ধুত্বের সূত্রপাত হচ্ছিলো, একদিন দেখলাম তোমার মন খারাপ আর আমায় অবাক করে তুমি বললে আমি নাকি সব শেষ করে, তোমায় ছেড়ে চলে যাবো। তুমি তো এমনিতেই ছিলে চিরকালের অভিমানী, কথায় কথায় তোমার ছলোছলো চোখ। আমিও জানতাম আমি হয়তো চলে যাবো, তাই খুব ভেবে তোমায় বলেছিলাম-
‘Nobody knows what human life is.
Why we come, why we go.
So why then do I know
I will see you,
I will see you in far off places?
The heart knows why I grieve
And yes one day I will close my eyes forever
But I will see you
I will see you in far off places.
Destiny for some is to save lives
But destiny for some is to end lives
But there is no end
And I will see you in far off places .
আমি আসলে তোমায় বলতে চাচ্ছিলাম 'শেষ' বলে কিছু নেই। Morrissey যেমনটা ওর গানে লিখেছিলেন কারো নিয়তি থাকে জীবন রক্ষার, কারো নিয়তি থাকে জীবন শেষ করবার। কিন্তু 'শেষ' বলে তো কিছু নেই। তাই তোমার-আমার ও কোনো শেষ হবে না। পৃথিবী নামের এই রঙ্গমঞ্চে তোমায় বিদায় জানালেও, দূরে কোথাও আবারো আমাদের দেখা হবে নিশ্চই। সেই অনিন্দসুন্দর পৃথিবীতে যুদ্ধ থাকবেনা, অন্যায় থাকবেনা, রক্তপাত-রাজনীতি-অর্থনীতির জটিল লাভ লোকসানের হিসেবগুলো থাকবেনা, বদ্ধভূমির শহর থাকবেনা, ক্ষতবিক্ষত, অভুক্ত, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, মানুষেরা থাকবেনা।
কেন জানিনা আজ অনেক কিছু বলে ফেললাম। I got carried away. Take care and enjoy Kolkata.
শুভ
২১ শে জুলাই ২০১৬,
টাওয়ার হিল, লন্ডন
জার্মান চকলেট,
‘প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ
… ক্ষনে ক্ষনে বসন্তদিন ফেলেছে নিশ্বাস-
মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ’ ।
সত্যিতো, আমার সর্বনাশ প্রথম থেকেই তোমার চোখে দেখতাম। বয়সও ছিল কম, তাই সব খুলে বলে ফেলতাম; পরিষ্কার দেখতাম তুমি সব শেষ করে আমায় ছেড়ে চলে গেছো। তখন অতকিছু আরোই বুঝতাম না তাই তুমি যখন বললে শেষ বলে কিছু নেই, সেদিন সেটা পুরোপুরি বুঝিনি।
শুধু পড়লাম, আবারো পড়লাম, বারবার পড়েই গেলাম তোমার চিঠিটা। মনে হচ্ছে আজকের টানা ৭ ঘন্টার আরবিট্রেশনের পর তোমার চিঠি পড়াটা দিনের সবচাইতে অর্থপূর্ণ কাজ ছিল। হেসো না প্লিজ। সকাল ৮টায় বেরিয়েছি, সবে হোটেলে ফিরলাম। এখন সন্ধ্যে ৭’টা। শরীর নামের যন্ত্রটা আর চলছেনা। তবে তোমার চিঠিখানা আজকের সব পরিশ্রম ধুয়ে মুছে দূর করে দিলো।
জানো, যুদ্ধ নিয়ে আমিও অনেক ভেবেছি আর তাই বুঝেছি সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিরা তাদের সঠিক আচরণগুলো জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণেই সঠিকভাবে করতে পারে। মানুষের জন্য মানুষের যে পরম মমতা মাখা হৃদয় থাকে, সেটা যুগে যুগে ইতিহাসের পাতায় যুদ্ধের ভয়াবহতার পাশাপাশি বেঁচে থাকে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা, আমাদের উত্তর-পুরুষদের জন্য সাহসী মানুষদের গল্প লিখে রেখে গেছেন। সৃষ্টিকর্তা হয়তো যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে থেকে নতুন করে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষদের বেঁচে থাকার প্রেরণা জুগিয়ে যান। মোঙ্গল, মুঘল, পারস্যিও, রোমান, খিলাফত, বাইজেন্টাইন, ব্রিটিশ, গোলন্দাজ অথবা ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ, সবখানেই, শুভ-অশুভের লড়াই একসাথে চলছিল। চৈনিক কসমলজির Yin-Yan দর্শন যেমন বলছে আলো-অন্ধকার, নিশ্চিত-নঞর্থকতা, শুভ-অশুভ পাশাপাশি অবস্থান করে কেননা সেটাই প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে। যে কোনো যুদ্ধে যেমন চূড়ান্ত অন্যায় থাকে, তেমনি চূড়ান্ত মানবতাও থাকে- এটাই হাজার বছরের ইতিহাসে প্রমাণিত। তাই সাধারণ মানুষের উপর আমি হতাশ হইনা আর বিশ্বাসও হারাইনা কখনো।
গত বছর বৈরুত গিয়েছিলাম একটা কনফারেন্সএ। সেখানে ফেরার সময় ‘The Yellow House’ নামে একটা জাদুঘর দেখতে গিয়েছিলাম যেটা লেবাননের মাঝসত্তর দশকের যুদ্ধের উপর কেন্দ্র করে। জাদুঘরটা ছিল একটু ভিন্ন ধাঁচের, অন্য সব war museumগুলো থেকে একটু আলাদা। মানুষের জন্য মানুষের যে চিরন্তন প্রেম সেটাই সেখানে বারবার ফুটে উঠছিলো। জাদুঘরটা একসময়ে কোনো এক উচ্চবিত্তের বিলাসবহুল বাসভবন ছিল, যেখানে যুদ্ধকালীন বোমাবর্ষণ এর সময় শহরের সাধারণ মানুষেরা আশ্রয় নিতো। ‘The Yellow House’এ একটা প্রায়-ধ্বসে যাওয়া দেয়ালে কাতাল নামের এক প্রেমিক লিখেছিল, ‘গিলবার্ট এর জন্য আমার ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়, তবে ইতিহাস সাক্ষী থাকুক আমি একজন ভয়াবহ অপরাধী’– ‘If my love for Gilbert is a crime, let history witness I am a dangerous criminal,’ মৃত্যুর ঠিক আগে সে আরো লিখেছিলো– 'কাতাল এখানে থেমে গেলো আর গিলবার্ট এর সাথে এখানে তার মৃত্যু হলো'। যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি পৃথিবী জুড়ে চলেছে এবং চলবে কেননা রাজনীতি, অর্থনীতি, ক্ষমতা, লজ্জাহীন হয়েই বুড়ো আঙ্গুল দেখায় অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল দেশ অথবা গোষ্ঠীগুলোর। পৃথিবীর সব রাজনৈতিকভাবে অন্যায়/ভুল যুদ্ধ রাজনীতিবিদরা একসময় স্বীকার করে নেন কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে কেননা ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।
যাই হোক তোমায় আরো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু আজ আর কিছু বলবো না। Don’t want to do injustice to the poignant thoughts of your letter that stirred my soul, dear German chocolate.
তোমার কাছে আরো অনেক গল্প শোনার অপেক্ষায় রইলাম- জীবনের গল্প, মানুষের গল্প। সারাদিনের কাজের শেষে যখন তোমার গল্প শুনি, মনে হয় রুমির মতো আমিও বলি -
“The night has ended, our tale has not
don’t blame the night
our love story takes too long” - ভালো থেকো।
নীল
২২’শে জুলাই ২০১৬,
ওবেরয় গ্রান্ড, কলকাতা।
PS. হঠাৎ করে মনে হলো যুদ্ধের পর বাবা ফিরে না আসলে তুমি জন্ম নিতে না। আমিও তোমায় আর পেতাম না। বেশি স্বার্থপরের মতো হয়ে গেলো, তাইনা? আরএকটা কথা, তোমার মা কে বলো বাবার সাথে কখনো যেন উনি রাগ না করেন। এই ফিরে আশা মানুষটার সাথে কখনো যেন তিনি অভিমান না করেন।
নিলিশ্বরী,
তোমার জন্য আমার জমিয়ে রাখা গল্পগুলোতো আসলেই এতো তাড়াতাড়ি শেষ হবার নয়। The night may have ended but our tales certainly have not! তুমি শুনলে আমি অবশ্যই বলে যাবো তোমার জন্য জমিয়ে রাখা আমার অনেক অনেক না বলা গল্প। আর শোনো, মা কে বলেছি তুমি যা বললে, মা হাসলেন অনেক তোমার কথা শুনে।
স্বীকার করছি, আমি ছিলাম তোমার খসেপড়া দেবদূত, your fallen angel, ঔদ্ধত্বের অপার সৌন্দর্য নিয়ে আমি থাকতাম সর্বনাশের জন্য। আর তুমি ছিলে জন্মের বোকা মেয়ে, সব জেনেশুনে, দেখেবুঝে, বিশ্বাসের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে। কতভাবে বুঝিয়ে দিতাম আমি থাকবোনা তোমার পাশে, কিন্তু তুমি তোমার মতো করে তবুও রয়ে যেতে, সয়ে যেতে।
তোমার বিশ্বাসে কোনো জন্মান্ধ মেয়ে যেন পেত আলোর ঠিকানা; তোমার বিশ্বাসে প্রেম যেন বুনো ঘোড়া হয়ে ছুটে আসতো উর্দ্ধশ্বাসে দিগন্তজোড়া মাঠ কাঁপিয়ে! শুধু আমায় নিয়ে নয়, জীবন নিয়ে, মানুষ নিয়ে, তোমার বিশ্বাসে অন্যরকম একটা শুদ্ধতা ছিল। তুমিতো শুধু আমাকে ভালোবাসতে না, তুমি পৃথিবীর মানুষকে ভালোবাসতে, সৃষ্টিকর্তাকে আর তার সৃষ্টিকে ভালোবাসতে। তোমার বিশ্বাসে দিনবদলের গল্প থাকতো, সেই গল্পে নতুন করে জন্ম নিতো অনেক 'নূর হোসেন', অনেক ইয়াসির আরাফাত, আর অনেক ম্যান্ডেলা। তুমি বলতে স্বপ্ন আর ত্যাগেই নাকি সব হয়; সেটা ব্যক্তিগত হোক অথবা সমাজ জীবনে। মুক্তিযুদ্ধই নাকি এর শ্রেষ্ঠ প্রমান। তুমি বোকা ছিলে বলেই হয়তো হিরোশিমার ১০ বছর বয়সী সাদোকো হয়ে বার বার জন্ম নিতে চাইতে হাজার পেপার ক্রেন বানানোর স্বপ্ন নিয়ে। তোমার মতো স্বপ্ন দেখা মানুষেরাই নাকি তিব্বতের লামায় পরমাত্মার সন্ধানে হেটে চলে আর জাতিস্মর হয়ে সুজাতার বেশে নৈরঞ্জনার পাড়ে বসে রয় বুদ্ধের অপেক্ষায়!
তুমি নিকুচি করতে আমার ঔদ্ধত্বের, আমার বেয়াড়া অহংকারের; নিকুচি করতে আমার অদ্ভুত খেয়ালি আচরণের। তুমি বোকা মেয়ে ছিলে বলেই ভাবতে আকাশ যতই হোকনা কালো, মেঘ একদিন কেটে যাবেই। তোমার ভেতর যে একটা বিশ্বাসের অচিন পাখির বাস ছিল তাকে তুমি এভাবে দানা পানি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে।
তুমি থাকতে রক্তকরবীর নন্দিনী হয়ে, রঞ্জনের অপেক্ষায়। তুমি তো জানতে রঞ্জনরা ফিরে আসেনা। বোকা মেয়ে ছিলে বলেই, গাঁট বেঁধে বসে থাকতে তোমার রঞ্জনের অপেক্ষায়!
১৯টা বসন্ত পেরিয়ে তোমার বিশ্বাসের কাছে আমি হার মানলাম। হার মেনেছি বলেই যুদ্ধ শেষ করা সৈনিকের মতো, জিতে গিয়ে আর হেরে গিয়ে, অনেক পেয়ে আর অনেক হারিয়ে তোমায় বলতে আসলাম, ‘বোকা মেয়ে, তুমি আমায় অনেক কাল আগেই হারিয়ে দিয়েছিলে’!
যেমনটা তুমি বলো প্রণয় ফুরোয় কিন্তু বসন্ত ফুরোয় না, তেমনি আমাদের বন্ধুত্বের বসন্ত যেন কখনো না ফুরোয়, কোনোদিন শেষ না হয়। আমাদের দেখা হোক বা না হোক, তোমায় আমি আর লিখি বা না লিখি, এই চিরসবুজ বন্ধুত্বের বসন্ত যেটা জন্ম নিয়েছিল ১৯ বছর আগে, সেটা যেন রয়ে যায় আজীবন। Like the spring of requited love of Dante Alighieri for Beatrice in La Vita Nuova,
“In that book which is my memory …
On the first page
That is the chapter when I first met you
Appears the words ….
‘Incipit vita nova: Here begins a new life”.
চিঠিটা এভাবে ঠিক লিখতে চাইনি কিন্তু কেন যেন এভাবে লিখে ফেললাম।
শুভাশীষ
২৩ শে জুলাই ২০১৬,
টাওয়ার হিল, লন্ডন
শুভ,
হঠাৎ তুমি যেন কেমন হয়ে যাও। খুব সিরিয়াস ভাবে আগের সব কথা বলো। আজ কি হলো শোনো, arbitration শেষ হলো। মনে হচ্ছে এবার award পাবো না, হেরে গেলাম বোধয়। কি আর করা, তোমার মতো করেই বলি এটাইতো জীবন, কিছু হেরে যাবার আর কিছু হঠাৎ জিতে নেবার।
তুমি যেমন করে বললে আগের চিঠিতে, আমি কিন্তু তেমন সাহসী ছিলাম না। এটা তোমার আরেকটা ভুল ধারণা ছিল। আমি একটা সাধারন মেয়ে ছিলাম যে থাকতো তার নিজের মতো করে। আমার ভেতর একই সাথে ছিল শূন্যতা আর পূর্ণতার বোধ। একই শরীরে আমি ছিলাম আর্য আর অনার্য, সম্রাজ্ঞী আর উপদাসী। একই সাথে আমি ছিলাম উর্বর আর ঊষর, গর্বিত আর লজ্জিত। আর সবচাইতে বড় সত্য ছিল আমি একাধারে ছিলাম তোমার প্রেয়সী সেই সাথে তোমার বীরঙ্গনা। আমি ছিলাম আমার মতো একটা অতি সাধারণ মেয়ে, আর সেভাবেই আমি আমার মতো থাকতে চাইতাম। আমি- আমি হবার চেষ্টায় বারবার, বহুবার এমনভাবেই থাকতাম।
ভাবতাম আমাদের অর্থাৎ মেয়েদের ত্যাগী হতে হয় কারণ আমরা বসুধরা। ধরিত্রীর মতো তাই আমিও সব কষ্ট ধারণ করতাম নিজেতে। এতো বছর পর তুমি আমার এ ধারণা ভেঙে দিয়েছো। তোমায় দেখে বুঝেছি শুধু মায়েরা নয় বাবারাও ত্যাগী হন, তারাও নীলকণ্ঠের মতো আকুন্ঠ বিষ ধারণ করেন। তুমি নীলকণ্ঠের গল্পটা শোনোনি? একবার দেবতা আর অসুরদের মধ্যে যুদ্ধ হচ্ছিলো, সেই যুদ্ধে অমৃত পানের জন্যে দেবতারা সমুদ্রমন্থন করেছিলেন। সমুদ্রমন্থন এর একটা সময়ে সমুদ্র থেকে হলাহল নামের বিষ উঠে আসছিলো আর সেই বিষের কারণে দেবতারা সবাই অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলেন। তখন দেবতাদের রক্ষা করার জন্য ভগবান শিব সেই বিষাক্ত বিষ পান করেন। কিন্তু আসলে তিনি ত্রিভুবন রক্ষার্থে নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন। এরপর থেকেই ভগবান শিব নীলকণ্ঠ নামে পরিচিত। ঠিক তেমনি কত বাবাই তো আছেন যারা জগৎ সংসারের শান্তির জন্য নীলকণ্ঠ হয়ে যান, তাদের কথা আগে ভাবিনি কখনো ।
আজকে এখানেই থামতে হচ্ছে। যেতে যেতে শুধু তোমায় দিয়ে যাবো নির্মলেন্দু গুনের এপিটাফ থেকে কিছু পংক্তি,
‘করতল ভরা এই ম্লান রেখাগুলো তোমাদের জন্য রেখে গেলাম।….
আমার যে ছেলেটির জম্ন হয়নি, তাকে দিও এই দুর্বিনিত শীসের কলম।….
যে গান গাইতে পারিনি, তার সুর বেজেছে চৈতন্যে।
যে কবিতা লেখা হল না সেও ছিল সংগঠিত সীসার ভিতরে।
…. সাক্ষ্য দেবে ভালোবেসেছিলাম’ ।
নীল
২৪’শে জুলাই ২০১৬,
ওবেরয় গ্রান্ড, কলকাতা।
http://www.alokrekha.com
মুনা চৌধুরীর শুভাশীষকে চিঠি পড়ে খুব ভালো লাগলো। দুই প্রেমিকের পরিণত প্রেম কাহিনী। "আমি আসলে তোমায় বলতে চাচ্ছিলাম 'শেষ' বলে কিছু নেই। Morrissey যেমনটা ওর গানে লিখেছিলেন কারো নিয়তি থাকে জীবন রক্ষার, কারো নিয়তি থাকে জীবন শেষ করবার। কিন্তু 'শেষ' বলে তো কিছু নেই। তাই তোমার-আমার ও কোনো শেষ হবে না। পৃথিবী নামের এই রঙ্গমঞ্চে তোমায় বিদায় জানালেও, দূরে কোথাও আবারো আমাদের দেখা হবে নিশ্চই।" কথা গুলো আমার প্রাণের কথা। আমিও একজনকে ভালোবাসি। কিন্তু আর এই ভাষা জানা নেই তাই তাকে এই কথা গুলোই উৎসর্গ করলাম
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর শুভাশীষকে চিঠি অন্য মাত্রা যোগ করেছে। এ শুধু প্রেমের চিঠি না। এখানে শিক্ষামূলক অনেক কিছু আছে যা আমাদের প্রজ্ঞাকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশেষ করে ভারত ভাগ স্বাধীনতার যুদ্ধ দেশছাড়া মানুষের কষ্ট উঠে এসেছে। অনেক ভালো লাগলো পড়ে ,অনেক অনেক শুভ কামনা।
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর শুভাশীষকে চিঠি দুজনের নিমগ্ন প্রেম কাহিনী। কিন্তু তাতে উঠে এসেছে নানাবিধ বিষয়।যেমন পাকিস্তানের একতরফা অন্যায় আর জুলুমের বিরুদ্ধে আমাদের ভাতের, ভোটের আর ভাষার ন্যায্য অধিকার আদায়ের যুদ্ধ। শুভাশিসের বাবার কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের পক্ষে কাজ করেছেন। সেই আতঙ্ক, মৃত্যুভয়, আর বিভীষিকাময় বন্দি সময়ে বাবাকে ফায়ারিং স্কোয়াড এর নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাকে আবার সেনাবাহিনী ক্যাম্পে ফিরিয়েও আনা হয়। ভাগ্যের পরিক্রমায় যুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি সবার মাঝে মুক্ত হয়ে ফিরে এসেছিলেন।সত্যি মনের ভিতর বিঁধে। অনেক ভালো বাসা লেখককে। ��
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর "শুভাশীষকে চিঠি" পড়ে খুব ভালো লাগলো। অনেক গবেষণায় লেখা।যা আমাদের মনের গহীনে ছাপ পড়েছে। মোঙ্গল, মুঘল, পারস্যিও, রোমান, খিলাফত, বাইজেন্টাইন, ব্রিটিশ, গোলন্দাজ অথবা ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ, সবখানেই, শুভ-অশুভের লড়াই । চৈনিক কসমলজির Yin-Yan দর্শন সব বিষয় তুলে ধরেছেন ,অনেক অনেক ভালো লাগে শুভাশীষকে চিঠি যতবার পড়ি ভালো লাগে। অনেক ভালোবাসা। ভালো থাকবেন।
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর "শুভাশীষকে চিঠি" অত্যন্ত হৃদয় গ্রাহী লেখনী। এ যেন অমিত লাবণ্যের প্রেম কাহিনী। অভিমানী নীলেশ্বরী ১৯ বছরেও বড় হয়নি শুভাশিসের কাছে। প্রেমের এমন উদাহরণ অনন্য। শুধু যে তাদের মাঝে প্রেমের কথা হয় তা নয় পৃথিবীর সকল বিষয়ে তারা কথা বলে। আর আমাদের জ্ঞানকে করে সমৃদ্ধ। অনেক ভালো লাগলো। শুভ কামনা। লেখক।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো। 'শেষ' বলে কিছু নেই।
ReplyDeleteআমরা মুনা চৌধুরীর "শুভাশীষকে চিঠি"র অপেক্ষায় থাকি। আমাদের কাছে শুভাশীষ ও নীলেশ্বরী মূর্তমান।চরিত্র। পৃথিবীর সকল বিষয়ে তারা কথা বলে। আর আমাদের জ্ঞানকে করে সমৃদ্ধ। অনেক অনেক ভালো বাসা।
ReplyDelete'শুভাশীষকে চিঠি' আমার অনেক যত্ন করে লেখা তাই পাঠকদের ভালো লাগে শুনলে আমার লেখার সার্থকতা খুঁজে পাই.আলোকরেখার পাঠকদেরকেও আমার পক্ষ থেকে অনেক শুভেচ্ছা, অনেক শুভকামনা.
ReplyDelete