মুনা চৌধুরী
আজকে বিশ্ব নারী দিবসে, ‘আলোকরেখা’য়
দিনটা নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে,
মনে পড়ে গেলো অন্যরকম রাজকন্যাদের গল্প। তবে যার কথা আজকের এই দিবসে সবচাইতে
বেশি মনে পড়লো তার নাম Mary
Wollstonecraft যিনি ১৭৯২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে 'Vindication of the Rights of
Women' নাম একটা ভয়ানক বিপদজনক বই লিখেছিলেন, যেটাকে
নারীবাদের প্রথম বৈপ্লবিক ঘোষণা হিসেবে ধরা হয়েছিল। মার্ক্স্ যেমন সমাজতন্ত্রের
ত্রাতা, মেরি
তেমনি নারীবাদের। 'নারীবাদ' শব্দটা আমার
কাছে ব্যক্তিগতভাবে একেবারেই অপছন্দের কারণ আমি মনুষত্বে বিশ্বাসী একজন খুব সাধারণ
মানুষ। নিজেকে 'Feminist'
হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার চাইতে ‘Humanist''
হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। যাই হোক, সে অন্য এক
প্রসঙ্গ- যে 'ism' ই
বলি না কেন Mary আমাদের
নারীকুলের ত্রাতা। আমাদের বদ্ধ দুয়ার দু'শো
বছর আগে এই রাজকন্যাইতো খুলে দিয়েছিলো প্রথম বারের মতো: the door that she opened which
led us to the world of dreams unlimited!
রবিঠাকুর 'দুই বোন' উপন্যাসে বলেছেন কিছু মেয়ে জন্মায় মায়ের জাত হয়ে, আর কিছু প্রেমিকার। কবিগুরুর ভাষায় ঋতুর সাথে তুলনা করলে মা বর্ষা ঋতু, 'জলদান করেন, ফলদান করেন, নিবারণ করেন তাপ, দূর করেন শুষ্কতা, ভরিয়ে দেন অভাব'। আর প্রিয়া হলো বসন্ত ঋতু; ‘গভীর তার রহস্য, মধুর মায়ামন্ত্র, রক্তে আনে চাঞ্চল্য, যে সোনার বিনা নীরবে অপেক্ষায় রায় ঝংকারের- প্রিয়া সেই বীণায় সুর তোলে'। কিন্তু আমার মনে হয় এ ফর্মুলা শুধু গুরুদেবের উপন্যাসের নায়িকা উর্মিলা আর শর্মির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য কেননা সত্যিকারের পৃথিবীতে একজন নারীর মধ্যে বাস করেন একাধারে একজন জননী, প্রেমিকা, আর এক ভীষণ বিপ্লবী- যার ভূষণের ভাষা যেমনি প্রসাধনের, তেমনি শুভসাধনেরও। শ্রদ্ধেয় গুণী লেখক হুমায়ুন আজাদ বলতেন নারীরা হৃদয়ে রোমান্টিক, মস্তিষ্কে মেধাবী; তারা অগ্নি ও অশ্রুর সমন্বয়। আমিও লেখকের সাথে শতভাগ একমত।
অবাক হয়ে দেখি আমার আজকের গল্পের রাজকন্যা Mary প্রথম জীবনে
জীবনবোধের উপর দর্শন লিখেছেন,
প্রেমের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন,
ফরাসী বিপ্লবে সরাসরি ব্রি সো,
ট্যালিরাড এবং আরো অনেক বিপ্লবীদের সাথে কাজ করেছেন, নারী মুক্তি
আর নারী দর্শন নিয়ে কথা লিখেছেন। এই মানুষটিই হঠাৎ প্রেমে পড়েছেন অর্থ আর নারীর পেছনে
ছোটা এক ব্যাবসায়ী-লেখক গিলবার্ট এমেলএর সাথে। বিয়েতে বিশ্বাসহীন Mary বহুগামী
গিলবার্টএর সাথে কয়েকবছর বাস করেন এবং তাদের একটি মেয়েও হয়। কয়েক বছরের মধ্যে ওদের
সম্পর্ক ছিন্ন হলে,
Mary স্কান্ডেনেভিয়াএ গিলবার্ট এর ব্যবসা দেখাশোনার এক অদ্ভুত
দায়িত্ব পালন করতেন। ওখানে তিনি একটা পত্রিকায় নিয়মিত, 'Letters during a short
residence in Sweden, Norway, and Denmark’ নামে জার্নাল
লিখতেন। জার্নালগুলো একজন অনুপস্থিত ভালোবাসার মানুষকে লেখা আবেগী, কাব্যিক আর
সমাজ সচেতনতা মূলক লেখা ছিল। নারীবাদের এই সাহসী যোদ্ধা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন
জীবনের সেই সময়ে। কিন্তু অবিনশ্বর যে তার জন্য লিখে রেখেছিলেন আরো কিছু সময়, তাই তাকে
মিলিয়ে দিয়েছিলেন দার্শনিক William
Godwin এর সাথে।
তারা দুজন দুজনকে ভালোবেসেছিলেন এতটাই যে বিয়েতে অবিশ্বাসী Mary তার সাথে
বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। জীবনের এই সবচাইতে সুখের দিনে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মাত্র
৩৮ বছর বয়সে ১৭৯৭ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। Maryর মৃত্যুর পর Godwin
লিখেছিলেন Maryর
জীবনী আর সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন Maryর সব
রচনাবলী।
রক্ত মাংসে গড়া,
হয়তো আবেগী কিন্তু ভীষণ সাহসী,
বিপ্লবী আর সুমনা একজন মানুষ ছিলেন তিনি। সত্যিকার অর্থেই Mary ছিলেন অগ্নি
আর অশ্রু র সমন্নয়। ওর মধ্যেই যেন 'রক্ত
করবী'র
নন্দিনীর প্রতিচ্ছবি দেখি যে যক্ষপুরীর লোহা,
পাথর আর কবন্ধ গুহায় শ্বেত শুভ্র ফুল ফোটায়, যন্ত্রের ঘরে প্রাণের খবর পাঠায় আর বসে থাকে রঞ্জনের
অপেক্ষায়। হিংসা, বিদ্বেষ, কপটতা, রেষারেষি, সমাজের
দুর্বোধ্য সমস্যার জটিল অঙ্কগুলিই তো আমাদের যক্ষপুরী পৃথিবী আর এখানে Maryরাই পারে প্রাণের
ছোয়া রেখে যেতে। And
they lived happily ever after হয়তো Maryর
বাস্তব জীবনে প্রযোজ্য হয়নি সত্যি কিন্তু ওর ভাবনা গুলি খোরাক হয়ে আমাদের হৃদয়ে ever after হয়ে বেঁচে
থাকবে আজীবন।
আমাদের আজকের এই পৃথিবীকে সুন্দর করবার জন্য অনেক অন্যরকম
রাজকন্যারা অন্যরকম কাজ করে আমাদের ঋণী করে গিয়েছেন। গদবাধা ধারার মানুষ ছিলেন না
বলেই Josephine
Butler প্রথমবারের মতো পতিতাদের অধিকারের পক্ষে সরব হন, Anne Besalt জন্মনিয়ন্ত্রণ
নিয়ে প্রথমবারের মতো বৈপ্লবিক কথা বলেন,
প্রথম বাঙালি নারী ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী লেখেন তার প্রথম উপন্যাস 'দীপনির্বাণ' (১৮৭৬) যেখানে
প্রথাগত লজ্জাবতীর ছক ভেঙে তিনি অবলীলায় বলেছেন সে যুগের নারীদের মনের সব ভয়ংকর না
বলা কথা।
আমি সর্বান্তকরণে,
বিশ্ব নারী দিবসের এই বিশেষ দিনে ‘আলোকরেখা’র পাঠকদের
অন্যরকম রাজকন্যাদের গল্প বলতে চেয়েছি- যে গল্পে হৃদয়বান ও মেধাবী মানুষেরা জয়ী হয়, যাদের বাস
থাকে এমন এক পৃথিবীতে যেখানে নদীর গাঢ় নীল,
ঘাসফড়িঙেরা আরো সবুজ,
যেখানে মানুষেরা স্বপ্ন দেখে,
কবিতা লেখে আর অবিনশ্বর এর ছায়া খুঁজে পায় সাধারণ মানুষের অবয়বে।
http://www.alokrekha.com
মুনা চৌধুরীর অন্যরকম রাজকন্যা পরে মনটা ভরে গেল। কিদারুন লেখা। নারী দিবসকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। রাজ্ কন্যাদের বর্ণনা অনবদ্য। সত্যি খুব ভালো। শুভ নারী দিবস।
ReplyDeleteমুনা চৌধুরী একজন বিজ্ঞ লেখক। তার লেখা পড়লে মনোন ও প্রজ্ঞার উন্নতি ঘটে। আজকের মুনা চৌধুরীর অন্যরকম রাজকন্যা দের সম্পর্কে জেনে খুব ভালো লাগছে। শুভ কামনা।
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর অন্যরকম রাজকন্যা দারুন অনবদ্য লেখা। এখানে তিনি অন্য রকম রাজকন্যাদের সাহসিকতা তুলে ধরেছেন। একজন নারী হয়ে গর্ব বোধ করি। মন্তব্য লিখতে গিয়ে দেখি এ লেখার উপর মন্তব্য লেখা অসম্ভব। শুধু বলতে পারি। খুব ভালো লেগেছে পড়তে। দু 'চারবার পড়লাম। দারুন লেখনী।নারী দিবসে অনেক শুভেচ্ছা।
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর অন্যরকম রাজকন্যা দারুন অনবদ্য লেখা বরাবরের মতই! অপূর্ব ভাব ! অনন্য উপমা! শব্দের মুক্তা মালা!! অনেক সুন্দর লেখা ! শুভেচ্ছা রইল!
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর অন্যরকম রাজকন্যা বিশেষ লেখনী। তার লেখা থেকে অনেক রকম কিছু জানতে পারলাম। অন্যরকম রাজকন্যাদের গল্প তাদের অবদান তার লেখায় উঠে এসেছে। খুব ভালো লাগলো। অনেক অনেক শুভ কামনা।
ReplyDeleteমুনা চৌধুরী অন্যরকম রাজকন্যা লেখায় এক মোহ আছে। আমি কয়েকবার পড়লাম। তিনি যেভাবে নারীদের রাজকন্যা উপাধিতে ভূষিত করেছেন তা প্রশংসার দাবিদার।উনি নারীদের প্রশংসাই শুধু করেন নি। তাঁদের অবদান সাহসিকতা ও বীর গাঁথা অপরূপভাবে অংকিত করেছেন। অনেক ভালোবাসা। প্রার্থনা করি আরো ভালো লিখুন।
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর অন্যরকম রাজকন্যা খুব সুন্দর লেখা।
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর অন্যরকম রাজকন্যা খুব চমৎকার লেখা। Mary Wollstonecraft , রক্তকরবীর নন্দিনী আরো অন্য মহান নারীদের কথা তুলে ধরেছেন।আমাদের অনেক অজানা বিষয় জানতে পারলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ এই জন্যে। ভালো থাকবেন।
ReplyDeleteমুনা চৌধুরীর অন্যরকম রাজকন্যা একটা সমৃদ্ধ লেখা। তাঁর লেখায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নারীদের তুলনামূলক বিশ্লেষণ অনবদ্য।
ReplyDeleteএকটা লেখা, বা গান, বা কবিতা যখন শুদ্ধ সুরে মার্গীয় পরিবেশনে আমাদের বুদ্ধিমত্তার কাছে পৌঁছে যায় তখন সাধারণত দুটো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করি - আমাদের প্রথম WOW টা সৃষ্ট কর্মটির জন্যে, আর পরের WOW টা অবশ্যম্ভাবী ভাবেই লেখক, শিল্পী বা কবির জন্যে। কিন্তু আজ মুনা চৌধুরীর "অন্যরকম রাজকন্যা" পড়তে গিয়ে আর একটি মাত্রার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে হয়েছে - আর সেটি নিঃস্বাস-প্রশ্বাসের মতই সাধারণ কিন্তু গুরুত্বের মাপ-কাঠিতে আকাশ-চুম্বী। নারী - নারী দিবস - বিশ্ব নারী দিবস!
ReplyDeleteবর্ণনায় মুনা চোধুরী precise and picturesque! যৌক্তিক প্রাসঙ্গিগতা টেনে অন্য বিষয় ও তথ্যকে প্রধান আলোচিত বিষয়ের সাথে perfect harmony তে মিলিয়ে দেবার দক্ষতা তার মেধার গভীরতার পরিচয় বহন করে। এই গেলো আলোকরেখায় তার এবারের পরিবেশনার প্রথম ও দ্বিতীয় WOWs! ২০২০ সালের বিশ্ব নারী দিবসকে সামনে রেখে মুনা চৌধুরী তার "অন্যরকম রাজকন্যা"য় যে আশাবাণী লিপিবদ্ধ করেছেন তা যেন আমাদেরকে শোনানোর ছলে তিনি নিজেকেই শুনিয়েছেন! আর এটা এই সৃষ্টকর্মের আস্বাদ আহরণের পর ভোক্তার তৃতীয় WOW!
বরাবরের মতো আমার পাঠকদের মন্তব্যে আমি উচ্ছসিত ! আপনাদের অনুপ্রেণায় যেন আমি আরো ভালো লিখতে পারি সেই চেষ্টা আমি সবসময়ে চালিয়ে যাবো. অনেক অনেক রাজকন্যারা ইতিহাসের পাতায় আছেন যাদের আমরা আসলেই চিনি না. আজকের 2020 এ বসে আমরা নারীরা অনেক কিছুই taken for granted হিসেবে ধরে নেই. কিভাবে পেলাম, কেন পেলাম, কার অবদানএ পেলাম, কে কতখানি স্বার্থত্যাগ করেছেন, উৎসর্গ করেছেন তাদের জীবন এসব নিয়ে আমরা ভাবি না. এসব মুকুটকিন, রাজত্বহীন, নিজেকে বিলিয়ে দেয়া রাজকন্যাদের গল্প আমি আরো বলতে চাই. আমাদের মেয়েদের জন্য, বোনেদের জন্য আসলে সবার জন্যই এসব গল্প গল্পচ্ছলে হলেও জানা দরকার. আপনারা সবাই ভালো থাকবেন. 'নারী দিবস হোক' আমাদের জন্য বছরের প্রতিটা দিন !!
ReplyDelete