মানুষ চলে গেলে পালক ফেলে যায়….
কাল রাত থেকেই লন্ডনে অসম্ভব কুয়াশা পড়ছিলো। আমি বাতি নিভিয়ে জানালার পর্দা না টেনে কুয়াশা দেখে দেখে ঘুমিয়ে পড়েছি। রাত তিনটার দিকে বালিশের পাশে মোবাইল মৃদু সংকেত-শব্দ করলো।
বার্তা এসেছে।
স্নেহের কবি তারেক সুজাত মাত্র ক’টা শব্দ লিখেছে, আপা মাত্র কিছুক্ষণ আগে ছোটলু ভাই (আলী যাকের) চলে গেলেন!
শুনে নিরবে কাঁদতে কাঁদতে বসার ঘরে এসে বাইরের প্রবল কুয়াশায় তাকিয়ে থাকলাম। হায় আমাদের পাহাড়ের ও পতন হল!
গত ক’দিন ধরেই সে আশংকায় আমি মনের দাঁত চেপে হাত মুঠ করেছিলাম। যেন মুঠো ছেড়ে দিলে তাকে আর তো পাবো না। বিলেত থেকে ঢাকায় আমি ভয়ে ভয়ে ফোন করতাম। কে জানে কে কখন আমাকে এই আজকের মত অবিশ্বাস্য এ সংবাদটা দিয়ে দেয়! অপরাধি মন বলছিল, আমার মুঠো ছাড়ার সময় হয়েছে। আর বুঝি নিজেকেও বুঝ দেবার থাকলো না।
প্রিয় ও পরম এ মানুষটি যে শেষ লড়াইটা শুরু করেছিলেন জানতাম। মাত্র ন’দিন আগে আমি চূড়ান্ত ভয়ের জায়গায় গিয়ে শক্ত হয়ে মুষ্ঠি পাঁকিয়ে হোয়াটস এ্যাপে লিখেছিলাম..
-বড়ই বিচলিত আছি বন্ধু!(বয়সে জ্যেষ্ঠ হলেও দীর্ঘদিন, সেই বিচিত্রার কাল থেকে একই আড্ডাসঙ্গী ও শিল্পসাথী বলে আসাদুজ্জামান নূর আমার বন্ধু)।
-হ্যাঁ। গতকাল প্রথমবারের মত ডায়ালাইসিস করা হোল। আমার টেক্সট এর উত্তরে তিনি লিখেছিলেন।
-নূর, আমার বড় ইচ্ছা ছিলো তাঁকে ও তাঁর কাজ নিয়ে তাঁর তোলা ছবি, অভিনয়, পরিচালনা, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক এ্যাকটিভিজম, পারিবারিক বলয় সব নিয়ে একটি বৈশ্বিক অন লাইন অনুষ্ঠান করার।
আমি যখন নূরকে নোট লিখছিলাম, মনে ভেসে আসছিলো তাঁর সেই প্রবল উচ্চতার চনমনে চেহারাটা। আমি তাঁকে প্রথম যেমন দেখেছি সেটাই। বহুব্রীহি,দেওয়ান গাজীর কিসসা থেকে। অভিনয়ের সময় স্টেজে দরদর করে ঘামার সেই সময় থেকে। ইরেশের বিয়ের সময়ও লাঠি ঠেকা দিয়ে দাঁড়ানো তাঁর কী রাজকীয় স্টাইল দেখেছি। দ্রুত মনে আসছে সেই আঁখি, ললাট চিবুক।আমরা তাঁকে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে চিনি। তাঁর কন্ঠ চিনি মুক্তিযুদ্ধের আবদ্ধকালিন সময় থেকে। স্বাধীনতার রক্তবীজ অংকুরিত হবার কাল থেকে।
নূরকে টেক্টএ আরো লিখলাম, তুমি দেশ থেকে সারা, ইরেশ এবং আর দু’জন নিয়ে বসলে। আর আমি বিলেত থেকেই আমেরিকা, ক্যানাডা ও জার্মানী থেকে তিনজন নিয়ে বসলাম। আমাদের প্যানেলের মানুষগুলো সাংবাদিক, শিল্পী, শিল্প নির্দেশক,টিভি ব্যাক্তিত্ব হতে পারে। আমরা ছোটলু ভাইকে নিয়ে, তাঁর কাজ ও পাহাড়ের মত ব্যক্তিত্ব নিয়ে কথা বল্লাম। আমার বড় ইচ্ছা তাঁকে ও তাঁর কাজ নিয়ে, তাঁর তোলা ছবি, অভিনয়, পরিচালনা, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক এ্যাকটিভিজম, পারিবারিক বলয় এসব নিয়েই একটি বিশ্বজোড়া অন লাইন অনুষ্ঠান করার।
আর আমাদের প্যানেলের মানুষগুলো হবেন সাংবাদিক, শিল্পী, শিল্প নির্দেশক,
টিভি ব্যাক্তিত্ব। আমরা তাঁর আপোষহীন পাহাড়ের মত ব্যক্তিত্ব নিয়ে কথা বলতাম। তিনি হাসপাতাল থেকে বা বাড়ি এসে দেখলেন। কি বল?
নূর কিছু বল্লেন না। একেবারে নিঝুম নিশ্চুপ! এমনকি আমার একটা সুসংবাদেরও উত্তর তিনি দেন নি। তখনি আমি অশনি সংকেত পেয়েছিলাম। জানি ওঁরা দু’জন সবচেয়ে কাছের বন্ধু।একবার ছোটলু ভাই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন জেনে লন্ডনে এসেই পরিকল্পনা ছেঁটে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। আগের রাতে ব্রাডি সেন্টারে অনুষ্ঠানের ফাঁকে শুধু মৃদুস্বরে বলেছিলেন, শামীম, ছোটলু ভাইর শরীরটা খারাপ করেছে।
আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের সোনার পাহাড় তুল্য একজনই ছিলেন।তিনি আলী যাকের। আমি ডাকতাম সিবি মানে ছোটলু ভাইয়ের নামের সংক্ষেপ করে।সে ডাক ও ছিলো ফেইসবুকের মেসেজ বক্সে আমাদের ছোট ছোট আলাপন জুড়ে।কিন্তু সিবি’র সংগে টুকটাক কথা গত এক বছরের উপর আর নাই। আর তখন থেকে হাত মুঠ করে মনের মধ্যে বিড়বিড় করতাম, তুমি প্লিজ চলে যেওনা। একে একে আমাদের সব চলে যাচ্ছে। দেশের মানসিক অবক্ষয়ে শেষ হয়ে গেল সব। আকাশ থেকে আমাদের মানচিত্র যাদের অবস্থানে চিহ্নিত করা যেতো , বলা যেতো ঐ আমাদের নদী, ঐ আমাদের পাহাড় আর ঐ যে সুন্দর বন - একে একে তার সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মানুষরা চলে গেলে কী হবে আমাদের!
তবে কি যে হবে সে আমরা সবাই তার আলামত দেখে আন্দাজ করতে পারি। এবং সত্যি তাইতো হচ্ছে। দেশে প্রচন্ড কুয়াশা নেমেছে। যে চার নীতির ভিত্তিতে দেশ হয়েছিল- কে আর ভাবে এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর আকাশ থেকে আমাদের মানচিত্রটা সনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে জানি আর সেই কঠিন সময়েও ‘আমরা তোমাকে স্মরণ করবো আর তোমাকে ভুলবো না।
শামীম আজাদ
২৭ নভেম্বর ২০২০
লন্ডন
কেউ চলে গেলে তাঁর যৌবনের বা শ্রেষ্ঠ সময়ের ছবি দিতে হয়। আমি দিলাম।
সুত্র : অন্তর্জাল
আজ মনটা ভারাক্রান্ত। আমাদের সংস্কৃতির আকাশ থেকে আরও একটি নক্ষত্র ঝরে পড়লো।আজ বহু গুনে গুণান্বিত অভিনেতা আলী যাকের।সুপরিচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের শুক্রবার ভোরে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন।ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে ভোর ছয়টা দিকে আলী যাকেরের মৃত্যু হয়। বরেণ্য কবি ও লেখক শামীম আজাদের লেখাটা অনন্য ,প্রাণ ছুঁয়ে যায়। খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteআজ মনটা খুব খারাপ। আমরা ধী রে ধীরে অভিবাভকহীন হয়ে পড়ছি। লেখাটা পরে খুব ভালো লাগলো। কাছের মানুষের কাছ থেকে বরেণ্য মানুষটার সম্পর্কে জানাটা অন্য রকমের অনুভূতি। আলোকরেখায় আবার লেখা শুরু হয়েছে ,আশাকরবো নিয়মিত লেখা পাবো।
ReplyDeleteমনটা খুব খারাপ হয়ে গেল খবরটা জেনে। এতদিন আলোকরেখায় কোন লেখা না পেয়ে বিষণ্ণ ছিলাম। বিনীত নিবেদন যেন নিয়মিত লেখা পাই ,অনেক অনেক শুভ কামনা।
ReplyDeleteআলোকরেখায় আবার লেখা শুরু হয়েছে দেখে মনটা খুব ভালো লাগছে। আমরা আলোকরেখা পড়তে ভালো বেশি ,গান শুনি এবং নতুন লেখা না পেলে পুরোনো লেখাগুলো পড়ি।
ReplyDelete