ভাষাপরব
ইটা হল ভাষাপরব
আমি শুদালম,সেটা আবার কী বঠে ?
মাষ্টর বললেক, ইটা হল মাটির ভাষা মাটির গান
'মোদের গরব মোদের আশা আমরি বাংলা ভাষা
গান গেয়ে ধান কাটে চাষা
গেয়ে দাঁড় টানে মাঝি'
এই পদ্যটা তুই পড়িস নাই ইসকুলে ?
ই বাবা !আমি আবার কবকে ইসকুলে গেলম হে।
মাস্টর বললেক,লে লে উসকল কথা আখন ছাড়ে দে
যেটা বলতে আইছি
সেটা হিয়াজ করে শুন,
ভাষা বাঁচাতে হবেক
ভাষা না বাঁচলে
সব লস্ট অ হইয়ে যাবেক
সব জলাঞ্জলি চলে যাবেক
তুই একুশে ফেব্রুয়ারির নাম শুনেছিস
তুই উনিশে মে র নাম শুনেছিস
জানিস আমাদের বাংলা ভাষার লাগে কী হইছিল
বাহান্ন সালে
রফিক সালাম শফিক জব্বর আর বরকতের পারা
জুয়ান ছেলার রক্তে ভাসে গেছল ঢাকার রাজপথ
জানিস আমাদের বাংলা ভাষার লাগে কী হইছিল
একষটটী সালে
কুমুদ কানাই শচীন সুনীল চন্ডী বীরেন আর কমলার পারা এগারজনা তাজা জুয়ানের রক্তে
লালে লাল হয়ে গেছিল শিলচরের মাটি
মায়ের ভাষা বুকের ভাষা মুখের ভাষা
বাংলা ভাষার লাগে
বাহান্ন আর একষটটীতে
ঢাকাতে আর শিলচরে
শহীদ হইয়ে গেছে অতগুলান মানুষ ,
সেই লাগেই ত ভাষাপরব।
অ তুমরা তাহালে পরব করবে ?
পরবই তো করব,
আমাদের মহানগরীর ময়দানে করব ভাষা পরব
মাটির ভাষা মাটির গান বাঁচানোর পরব
সেই লাগেই তো পদযাত্রা
বাংলা ভাষা বাঁচানোর পদযাত্রা।
কিষ্টযাত্রা মনসা যাত্রা গাজনের যাত্রা
আলকাপের যাত্রা বনবিবির যাত্রা
ই সকলই ত জানি
তুমি আবার বলছ পদযাত্রা
সেই জিনিসটা কি বঠে মাস্টর ?
সেটা মস্ত বড় জিনিস
পদযাত্রা হলো মস্ত বড় যাত্রা
কত সব বড় বড় বাবু দেখতে পাবি
ফেলাট বাড়ির ঠাণ্ডা ঘরে থাকা
টেসকী চড়া বাবু
তারা সেদিন পায়ে পা মিলাই হাঁটবে রাস্তায় ।
বুঝেছি মাষ্টর বুঝেছি
ইটা হল বাবু যাত্রা
তা বাবুরা পায়ে হাটে কী করবেক মাস্টর ?
কি আবার করবেক
বাংলা ভাষা বাঁচাবেক।
পদযাত্রা করে বাংলা ভাষা বাঁচাবেক !
তা লয় ত কী
বাংলা ভাষার পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে
তুই তার কোনো খবর রাখিস
এখন দুনিয়াজুড়ে হাট বসেছে
ভুবন গ্রামের হাট বসেছে
সেই হাটে বিকাই যাচ্ছে
নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সব
তোদের যত মাটির ভাষা মাটির গান
কিছু কি আর থাকবেক মনে করিস ?
আমি দু কুড়ি পাঁচ বছরের তাগড়া জূয়ান
মিছা নাই বলব
টুকুন ঘাবড়ে গেছলম
তা বাদে রাতের বেলা জোসটা রাতে
কুলতলাতে তালাইপাতে
ভাবতে ভাবতে আচকাই গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ালম উঠে
তখন মনে হল
আমাদে যত মাটির ভাষা
আমাদে যত মাটির গায়েন
সব লষ্ট অ হইয়ে যাবেক
ই কী রং চালাকী নকি।
দেখঅ মাস্টর,
যুগের পর যুগ ধরে
কত রাজা আইছে আর গেছে
তাদের কত ফরমান কত শাসন
তবু আমাদে ইপারে শুশুনিয়া
আর উপারে লালমাই
কারু কাছে মাথা নুয়াই নাই
যতই ঝড় আসুক আর ঝাপটা আসুক
তারা মাথা খাড়া করে
যেমন দাঁড়াই আছে
তেমনি থাকবেই।
ইপারে কাঁকরা ধুলার লালমাটি
খরার চোটে বুক ফাটে পাথর হইয়ে গেলেও
সেই মাটিতে শাল মোহল আর পলাশের ফুল ফুটবেই
উপারে শামলা কালো লরম ধুলা মাটি
বানের তোড়ে জলে ডুবে জল হইয়ে গেলেও
সে মাটিতে শাপলা শালুক যেমন ফুটে তেমনি ফুটবেই ।
তুমরা যতই গাঁয়ে গাঁয়ে হিন্দি ইংরেজি লাচ দেখাও
মাইক লাগাই বাকসো লাগাই
কান ফাটানো ডিজে বাজাও
আমাদে বাঁশের বাঁশি
আমাদে মাটির মাদল
সে যেমন বাজে তেমনি বাজবেই ।
ভুবন গাঁয়ের হাটে সাহেবরা যতই ডলার ছড়াই
সওদা করে
সিল্কের গেরুয়া কাপড়ে মুড়ে
উড়াকলে চাপাই শখের বাউল কিনে নিয়ে যাক
আমাদে কুষ্টিয়া আর কেন্দুলির মেলায়
আমাদে লালন আর জয়দেবের ভিটায়
কানা বাউলের একতারা যেমন বাজে
তেমনি বাজবেই ।
ভাষাপরবের সভাতে আর পদযাত্রা তে
তুমরা যতই আমাদে ভাষা আমাদে গায়েন
সব লষ্টঅ হইয়ে গেল বলে হা হুতাশ করে দয়া বিলাও
তাথে কিছু লষ্ট ও হবেক নাই
কিছু সৃষ্টি ও হবেক নাই
আমাদে সুবর্ণরেখা বরাক আর শীতলক্ষ্যা
যেমন বইছে তেমনি বইবেই।
সে বহুতকাল আগের কথা হে
তুমরা তখন গাঁয়ে গাঁয়ে টোল খুলে টিকি রাখে
মনতর আওড়াই পুঁথি পড়ে
মাতেছিলে দেব ভাষা লিয়ে
তখন তুমাদে ঠাকুরদালান আর নাটমন্দিরের
চাথাল থাকে বহুত দূরে
মাটির কুঁড়াঘরে
হাটে মাঠে ডাঙ্গা ডহরে
পাহাড়ে জঙ্গলে লদীতে সাগরে
হাজার বছর ধরে
আমরা যত দিনমজুর আর ক্ষেতমজুর
আমরা যত চাষাভূষা আর মাঝি মাল্লা
আমরা যত আউল-বাউল আর পীর ফকির
আমরা যত হাঘরা আর হাভাতা মানুষ
আমরা যত ধূলা মাখা আর মাটি মাখা মানুষ
বুক জুড়ে বাঁচাই রাখেছিলম
মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা
আর আজ আতকাল পরে
গাঁয়ে গাঁয়ে বাঁশ বাগানে ডোবার পাড়ে
ইংরেজি টোল খুলে সাহেবী লেখাপড়া শেখাই
সাহেব করার লাগে
বিলাতি বুলি কপচাও তুমরা
ব্যাঙের ছাতার পারা ইংরেজি টোলে
ছেলামেইয়াদে বাংলা শিখা হল নাই বলে
মনে কোন দুখ নাই
'বাংলাটা ভালো জানে না '
ই কথাটা ফুটানী করে বলতে কত বুক ফুলে তুমাদে
সারাদিনে হাতে গুনা কতগুলান বাংলা কথা বল
কটা ত মাততক বাবু কথা
তার বাইরে আর কত লাখো লাখো বাংলা কথা আছে
সেগুলান কি জানঅ তুমরা ?
তার কোন খোঁজ খবর রাখঅ?
তুমাদে পণ্ডিতদে বইপত্তরে জায়গা পায় নাই সেসব
আমরা হাজার বছর ধরে তাদের বাঁচাই রাখেছি
মুখে মুখে ।
বড় আশচয্যী হে আখন বলছ ভাষাপরব করবে
জীবন দিয়ে লড়াই করে লয়
হুচুক করে পরব করে
পদযাত্রা করে সভা করে
বাংলা ভাষা বাঁচাবে
আ মরি বাংলা ভাষা ।
শুনঅ মাস্টর
চুপি চুপি কটা কথা শুদাব বলতে পারবে ?
বুকে হাত দিয়ে বল দেখি আজ বাংলা মাসের ক দিন ?
আঁকড় গাছে ফুল ফুটলে
দখণা হাওয়া বইলে
বুক ভরে দম লিয়ে চোখ বুজে বলতে পারবে
কবে আইছে ফাগুন ?
ফুল বানধের নাময় ধানক্ষেতের মাঠে
পাকা ধানের বাস উঠলে
তুলসী বকুলের গন্ধ শুকে
বলতে পারবে কবে লবান্ন ?
ধলেশ্বরীর চরে
কার্তিকের ভরা পূর্ণিমায় রাত দুপহরে
ডিঙ্গি নৌকার পাটায় শীতল পাটিতে শুয়ে
সুজনি কাঁথার চাদর গায়ে
হারান মাঝির গায়েন শুনে
বলতে পারবে পাড় ভাঙ্গা নি ঘুম ভাঙানি
ঢেউয়ের তালে কী গাইছে মানুষটা
ভাওয়াইয়া না ভাটিয়ালি ?
হাট গোবিন্দপুর এর হাড় কাঁপুনি হাওয়ায়
হাট ফিরতি সনঝারাতে
জুনপুকীদের সবুজ বাতির কুপি জ্বলা আলোয়
একা একা লদী পারে
রনবুড়ী ডাঙ্গার মাঠ পেরাতে পেরাতে
পাগলা ফকিরের গায়েন শুনে
বলতে পারবে কবে মানিক পীরের মেলা
ফীঙ দেওয়া জোসটায় নিম ফুলের বাস মাখে
ঢাকের বাদ্যি শুনে
বলতে পারবে কবে ঘুরবেক বছর
কবে হবেক গাজন সংক্রান্তি ।
কথাটা তাহলে বুঝ অ মাস্টর
তুমাকে তাহলে সার কথাটাই বলি
সুবর্ণরেখা বরাক আর শীতলক্ষ্যার চরে
হাজার বছর ধরে মাটির কুঁড়াঘরে
লীল লাল সবুজ হলুদ বাংলা ফুল
সে আপনা থাকেই ফুটে
বেওড়া বেড়া ফুলের পারা
হরদম ফুটে
তারা কারো দয়াতে বাঁচে নাই হে
তারা কারো দয়াতে বাঁচে না
তারা যুগ যুগ ধরে নিজেদের বাঁচন নিজেরাই বাঁচে
নিজেদের বাঁচন নিজেরাই বাঁচে ।
আমাদের সবার প্রিয় আঞ্চলিক কবি দেবব্রত।তাঁর কবিতায় মাটির টান আমাদের টেনে নিয়ে যায় মাটির কাছাকাছি। অনেক অনেক প্রণাম কবি।
ReplyDeleteপ্রিয় কবি দেবব্রত"ভাষাপরব" আঞ্চলিক কবিতায় কথোপথনের মাঝে ভাষার কথা তুলে ধরেছেন। এখন বাংলা ভাষা একটি পরবে পরিণত হয়েছে। মূল থেকে সরে এসে হয়ে উঠেছে উৎসবে। খুব ভালো লাগলো কবি। আলোকরেখাকে অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDeleteঅসাধারণ। ভাষাকে নিয়ে ভীষণ সমৃদ্ধ লেখা।
ReplyDelete