তাসরীনা শিখা
মানুষের জীবন একটা ।কিন্তু এই এক জীবনে একেক বয়েসের ভাবনা একেক রকমের। আরে এই ভাবনার অধ্যায় গুলো সবাইকেই পেড়িয়ে আসতে হয়। আমাকেও হয়েছে। তরুন বয়সে একটা ভাবনা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতো সেটা ছিলো , যারা ভালোবেসে বিয়ে করে তাদের দাম্পত্য জীবনটা না জানি কেমন হয়। নিশ্চয়ই ভীষণ সুখের এবং আনন্দের। যাকে ভালবেসেছে তাকেই বিয়ে করতে পেরেছে। আমার সব সময় ইচ্ছে ছিলো যাকে বিয়ে করবো ভালোবেসে করবো । অচেনা একটা মানুষকে কোন অবস্থাতেই করবো না। কিন্তু দুর্ভাগ্য বলি আর সুভাগ্য বলি আমার ভালোবেসে বিয়ে করা হয়নি। আমার অধিকাংশ বন্ধুরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো কিন্তু তাদের বিয়ের পরের জীবনটা কেমন হয়েছিলো সেটা জানার সুযোগ আমার হয়নি ।কারন তাদের বিয়ের আগে আমার বিয়ে হয়ে গেছিল , তারপর বিদেশ যাত্রা ।
সবার জীবনেই প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি আছে। অনেকের জীবনে প্রথম দিকে প্রাপ্তি আসলেও পরে অপ্রাপ্তিতে ভরে গেছে।আবার কারো জীবনে অপ্রাপ্তি ভরে আছে মনে হলেও পরবর্তীতে দেখা গেছে তাদের জীবন প্রাপ্তিতে ভরে গেছে। আবার দু’একজন বন্ধুর কথা শুনেছি স্কুল জীবন থেকে প্রেম থাকা সত্বেও বিয়ের পরের জীবনটা ছিলো অশান্তিতে ভরা এমনকি ওরা একসাথে থাকেও না। আসলে প্রেম আর বিয়ে দুটো দুরকম ব্যাপার । স্বামী কখনো প্রেমিকের ভূমিকা পালন করতে পারে না, তেমনি স্ত্রী কখনো প্রেমিকার মতো হতে পারে না। বাস্তব জীবনে পা ফেলার পর চিন্তা ভাবনাগুলো হয়ে যায় বাস্তববাদী । তখন প্রেমিক প্রেমিকার অনুভূতি গুলো হারিয়ে যায় ।
জীবনে অনেকগুলো অধ্যায় অনেকগুলো বেলা পেড়িয়ে এসেছি। একেক বেলার রঙ ছিলো একেক রকম। বাস্তব জীবনের ব্যস্ততা বহুবিধ। সংসার, স্বামী , সন্তান সব মিলিয়ে ব্যস্ততার মাঝে অতীতের অনেক ভাবনা অনেক মধুর স্মৃতি ধুসর হয়ে যায় । মাঝে মাঝে ফিরে আসলেও সেটা আবার সাদা মেঘের ভেলার মতো ভেসে ভেসে চলে যায় । জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। এখন ব্যস্ততা অনেক কম, ভাবনার সময় অনেকটা বেশী । তাই সাদা মেঘের ভেলা ভেসে এসে আমার স্মৃতিতে নাড়া জাগায়। কতো কথা মনে পরে।স্মৃতি এমন একটা জিনিষ যা চিরদিন হৃদয়ের ভেতর রয়ে যায় , যা কখনো মানুষকে কাঁদায় আবার কখনো হাসায় । যতই তাকে উপরে ফেলার চেষ্টা করি না কেন তার একটা ক্ষুদ্র শেকড় আমাদের ভেতরে রয়েই যায় ।
বিয়ের বছর তিনেক পরের কথা। দেশে গেছি বেড়াতে । সে সময়টা মানুষ চলাচলের জন্য ট্রেন জার্নিটা আরামদায়ক মনে করতো । গাড়ী নিয়ে গেলে ঢাকা থেকে কুমিল্লার পথে তিনটি ফেরী পার হতে হতো । তাছাড়া ফেরি ঘাটে অকল্পনিও জ্যাম । আমিও রেল ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলাম কুমিল্লা থেকে ঢাকা যাবো বলে। আমার সাথে ছিলো পরিবারের কিছু লোক । ঢাকা থেকে ট্রেন টা থামলো । আমরাও তাড়াহুড়ো করে ট্রেন এর পাশে এসে দাঁড়ালাম । পেসেঞ্জার নামার পর তিন মিনিট থামবে ট্রেন। এই তিন মিনিটের মাঝে আমাদের ট্রেন এ উঠে বসতে হবে। প্রথম শ্রেণীর কামরায় উঠবো আমরা। হঠাৎ করে একটা দৃশ্য আমাকে চমকে দিলো । তুমিও কাঁধে একটা ব্যাগ ও হাতে সিগারেট নিয়ে নামছো প্রথম শ্রেণীর কামরা থেকে। আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তোমার দিকে। কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে পাওনি। তোমাকে ডেকে কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব ছিলো না। কারন সাথে ছিলো আমার পরিবারের লোকজন । আমি এক মিনিটে তোমার আপাদমস্তক দেখে নিয়েছিলাম। তিন বছরে মনে হয় তুমি অনেকটাই বদলে গেছো । চেহারাতে সে ছাত্র বয়েসের ছাপটা নেই। বেশ ভারিক্কী একটা ভাব। তুমি ট্রেন থেকে নেমে হেঁটে চলে গেলে। আর আমি আমার বুকের ভেতর একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে তাড়াহুড়ো করে ট্রেন এ উঠে গেলাম। ট্রেন এ বসে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে তোমাকে দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু তোমাকে আর দেখতে পেলাম না।
তুমি বাজী ধরেছিলে তোমার বন্ধুদের সাথে আমার সাথে প্রেম করে দেখাবে। তখন আমি কলেজের ছাত্রী আর তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তোমার নাম শুনেছি অনেক কিন্তু চোখে দেখিনি কখনো । তুমি থাকো ঢাকায় আর আমি কুমিল্লায়। কাজেই দেখা হবার ব্যাপরটা কখনো ঘটেনি । আমি তোমাকে না দেখলেও তুমি বন্ধুদের সহযোগিতায় কোন না কোন ভাবে আমাকে দেখেছিলে। আমার সাথে দেখা হওয়ার জন্য কথা বলার জন্য কুমিল্লা সিনেমা হলে একটা মুভি দেখাবার ব্যবস্তা করলে। তখন তোমরা সিনে ক্লাব নামে কি যেনো একটা করতে। এতো আগের কথা সব কিছু সে ভাবে মনে নেই। আমরা কলেজ থেকে অনেক বন্ধুরাই মুভি দেখতে গিয়েছিলাম। তখনো আমি তোমাকে চিনি না দেখিও নি কখনো । তোমার বাজী ধরার কথাতো আমার একেবারেই অজানা। আরিফ আমাকে ডেকে নিয়ে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো । ব্যাস এতোটুকুই । সে পরিচয় আমার মনে কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে নি। তারপর কয়েকদিন হয়তো তুমি কুমিল্লা ছিলে। রোজই ফোন করতে আমাকে অহেতুক অপ্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য। আরিফ ফোনটা ধরে আমাকে চাইতো তারপর তুমি কথা বলতে। আমি ভয়ে ঘামতে থাকতাম। তারপর থেকে তুমি একটু ঘন ঘন কুমিল্লা আসতে শুরু করলে, । শুধুই ফোনে কথাবার্তা তারপরও বাড়ীর লোকদের আড়াল করে। কখনো তুমি আমার সাথে দেখা করার জন্য কলেজের সামনে এসে দাড়াও নি। কি করে কি করে যেনো তুমি বাজীতে জিতে গেলে।
আমারও কলেজ জীবন শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনই ক্লাস থেকে বেড়িয়ে দেখি তুমি ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছো । আমার সাথে দেখা করার জন্য। তোমাকে দেখে আমার ভয়ে হাত পা কাঁপছিলো । সে সময় আমরা তিন ভাই বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র।তার সাথে ডজন খানেক কাজিন। ওমাগো কেউ যদি আমাকে দেখে বিশেষ করে আমার বোন তখনি আমার খবর হয়ে যাবে। আমি খুব বিরক্ত হয়ে কপাল কুচকে বলেছিলাম, আপনি এখানে এসেছেন কেনো ? তুমি হেসে জবাব দিয়েছিলে আসবো না কেনো ? আমিওতো এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র।
তুমি এভাবেই ক্লাসের সামনে আসতে শুরু করলে মাঝে মাঝে। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে হেঁটে হেঁটে ছাড়া ছাড়া কথা বার্তা । কেউ দেখে যেনো কিছু না ভাবে। এভাবেই আমরা দুজন দুজনের অনেকটা কাছে চলে আসলাম । নিজের অজান্তেই তুমি আপনি থেকে তুমিতে পরিণত হয়ে গেলে। যাই হোক এভাবেই কেটে গেলো দুই বছর । তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন প্রায় শেষ । আমি শেষ করেছি দ্বিতীয় বর্ষ অনার্স । কখনো টী,এস ,সি তে কখনো সহরাউয়ারদী উদ্যানে হেটে হেটে গল্প । কখনো হলের সামনে দাড়িয়ে চটপটি খেতে খেতে গল্প । এভাবে দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গিয়েছিলো । কতো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বসে কিংবা কোন খালি ক্লাস রুমে বসে তোমার কাছে STATISTICS পড়েছি । তুমি খুব মন দিয়ে আমার পড়া বুঝিয়ে দিতে ।
কতো না ভাবনা কতো না পরিকল্পনা ছিলো আমাদের জীবনে । আমরা দুজন যেহেতু বাস্তববাদী মানুষ ছিলাম সেহেতু অবাস্তব ভাবনা কখনো ভাবি নি। ভেবেছি আমাদের পড়াশুনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু আমাদের কোন কিছুই বাস্তবায়িত হয় নি।
কথা ছিলো একসাথে বড় হবো।
কথা ছিলো দু’জন এক সাথে ঘর বাধবো , কথা ছিলো দু’জন মিলে সে ঘর সাজাবো ।
ভেবেছিলাম দু’জন মিলে চাকুরী করব, ভেবেছিলাম দু’জন মিলে অনেক অনেক ঘুরে বেড়াবো ।
ভেবেছিলাম দুজন এক সাথে বুড়ো হবো , আর আমরা বুড়ো বুড়ী হাতে হাত রেখে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো । কিন্তু কোন কথাই রাখা হোল না।
অবশেষে ভালোবাসার মানুষের সাথে আমার বিয়ে হোল না। সে কতো কাল আগের কথা। আমি তখন বিদেশে। আমার জন্মদিন। আমার নামে একটা কার্ড আসলো আমার স্বামীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় । আমার স্বামী তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক । কাজ থেকে ফিরে সে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো দেখো তোমার চিঠি বলে সে ব্যাড রুমে চলে গেলো চেঞ্জ করতে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে খামটা খুললাম। খামটা খুলে আমার আরেক ধাক্কা। তুমি আমার জন্মদিনের কার্ড পাঠিয়েছ । তুমি পেন্সিল দিয়ে লিখে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলে। কেনো পেন্সিল দিয়ে লিখেছিলে? আমি যদি চাই লেখাটা মুছে ফেলতে পারি সে ভেবে? কার্ডের ভেতরের লেখা ছিলো ইংরেজিতে। যার অর্থ করলে দাঁড়ায়” তোমার জন্মের সময়ই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো তুমি কার হবে, তাই হয়তো আমি তোমাকে হারিয়েছি। একেই বলে নিয়তি।“ আমি কার্ডটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। সাধারনত দেশ থেকে কোন চিঠি আসলে আমি আমার স্বামীকে জানাতাম কে চিঠি লিখেছে। সে চিঠির কয়েক লাইন পড়েও শুনাতাম। কিন্তু এবার আমি কি বলবো ? আমার স্বামী নিজে এসেই জিজ্ঞেস করলেন, কে কার্ড পাঠিয়েছে? আমি জবাব দিলাম আমার এক বন্ধু জন্মদিনের কার্ড । আমার শিক্ষক স্বামী কি বুঝলো জানি না। সে দ্বিতীয় বার আর কোন প্রশ্ন করলো না। আমি কার্ডটা নিয়ে আমার আলমারিতে কাপড়ের ভাজে রেখে দিলাম। তারপর নানা দেশের ছুটাছুটিতে অনেক জিনিষের সাথে তোমার কার্ডটা যেনো কোথায় হারিয়ে গেলো ।
ভাবতে অবাক লাগে কতোটা সময় চলে গেছে। জীবন তো বহমান নদী সে তো চলতেই থাকবে। যদি না কোথাও চর পরে। প্রত্যেকটা মানুষের কিছু না কিছু অতীত থাকে। আর সে অতীতএর মাঝেই আমরা খুঁজে আমাদের তরুণ জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে ।
তাসরীনা শিখার লেখা আলোকরেখার নতুন সংযোজন। ভালবাসার ইতিকথা পড়ে ভালো লাগলো। ভালোবাসার কথা অত্যন্ত সাবলীল ভাবে বর্ণনা করেছেন। অনেক শুভ কামনা।
ReplyDeleteতাসরীনা শিখার ভালবাসার ইতিকথা পড়ে ভালো লাগলো।মানুষের জীবন একটা ।কিন্তু এই এক জীবনে একেক বয়েসের ভাবনা একেক রকমের। ভালোবাসার কথা অনন্যভাবে বর্ণনা করেছেন। অনেক অনেক শুভ কামনা।
ReplyDeleteতাসরীনা শিখার ভালবাসার ইতিকথা পড়ে ভালো লাগলো। লেখাটা দারুন বৈশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ।অনবদ্য বর্ণনা ভালোবাসার। খুব ভালো। অনেক অনেক শুভেচ্ছা লেখককে।
ReplyDeleteonek din por Alokrekhay ashlam. bhalo laglo Shikha r golpo pore. Sanjida Rumi ke bolbo jeno Alokrekha niyomito chaliye jan. God bless you all.
ReplyDelete