আজ_সুনীল_গঙ্গোপাধ্যায়ের_জন্মদিন
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
আজ এই কীর্তিমান মানুষটির জন্মদিন। ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর আলো দেখেন জনপ্রিয় বাঙালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
বাংলাদেশের তৎকালীন ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমা শহরের অনতিদূরে আমগ্রামে জনৈক বাঙ্গালী হিন্দু পরিবারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর পিতা কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। মায়ের নাম মীরা দেবী। এই বাড়িটি তাঁদের নিজ বাড়ি ছিল না। কাছেই মাইজপাড়া ছিল পৈতৃক বাড়ি।সুনীলের দাদু ছিলেন বিরাজমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতামহী ছিলেন মনোরমা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুনীলের দুই ভাই যথাক্রমে অনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অশোক গঙ্গোপাধ্যায় এবং একমাত্র বোনের নাম কনিকা।
মহাযুদ্ধের সময় সুনীলের পরিবার ফরিদপুর ছেড়ে কোলকাতায় চলে আসেন। কোলকাতায় এসে মীরা দেবীর মামা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে কোলকাতা টাউন স্কুলে পয়তাল্লিশ টাকা মাসিক বেতনে সুনীলে বাবা কালীপদ বাবু গনিত ও সংস্কৃতির শিক্ষিকের চাকুরী পান। কোলকাতার মসজিদ বাড়ি স্ট্রীট, তেলিপাড়া লেনে সুনীলের কৈশোর কেটেছে। প্রাথমিকপর্বে কলকাতার টাউন স্কুলেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁর বাবা কার্যত বেকার হয়ে পড়েন এবং তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। ঐ সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মাইজপাড়া গ্রামের বীরমোহন বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি পড়াশোনা করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, দমদম মতিঝিল কলেজ এবং সিটি কলেজে।
১৯৫৪ সনে তিন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যাল থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ইতিমধ্যে বন্ধু দীপক মজুমদারের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে সুনীলের সঙ্গে পরিচয় হয় আনন্দ বাগচী, দীপেন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান পল এঙ্গেল কলকাতায় এলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। সেই সূত্রে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে ভর্তি হন।
বাবার দেওয়া টেনিসনের ইংরেজি কবিতা অনুবাদের কাজ করতে করতেই নিজে কবিতা লিখতে শুরু করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৫০ সালে 'দেশ' পত্রিকার পাতায় 'একটি চিঠি' নামে সুনীলের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সাল থেকে সুনীল 'কৃত্তিবাস' নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ' প্রকাশিত হয় 'দেশ' পত্রিকায়। পরবর্তীকালে এই 'দেশ' পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে তিনি বহু বছর কাজ করেন।
তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস 'সেই সময়' ১৯৮৫ সালে 'সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার' লাভ করে। তাঁর রচিত অন্যতম বিখ্যাত দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস 'সেই সময়' এবং 'প্রথম আলো'-র ইংরেজি অনুবাদ করেন অরুণা চক্রবর্তী। তবে উপন্যাস ছাড়াও ভ্রমণকাহিনী, শিশুসাহিত্য, ছোটগল্প, বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনা ইত্যাদি সাহিত্যের প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই তিনি নিজের স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন।
গোয়েন্দা কাকাবাবু ও তাঁর সহকারী ভাইপো সন্তুকে নিয়ে যে কিশোর গোয়েন্দা কাহিনী তিনি রচনা করেছিলেন, তা ১৯৭৪ সাল থেকে নিয়মিতভাবে 'আনন্দমেলা' পত্রিকায় প্রকাশিত হত। লেখক হিসাবে অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিলেন সুনীল। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে লিখতে বসতেন। শিশু ও কিশোর সাহিত্যে তাঁর সৃষ্ট কাকাবাবু অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী হিসেবে কিশোর সাহিত্যে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। লেখক হিসেবে তিনি দু'শোর বেশি বই লিখেছেন।
তাঁর লেখনীতে উঠে এসেছে ইতিহাস, সমকালীন প্রেক্ষাপট, প্রেম, নাগরিক জীবনের জটিলতা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়। কলকাতার নাগরিক জীবনকে তিনি অসাধারণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন সাহিত্যে। পরিণত বয়সে এসে তিনি রচনা করেছেন 'সেই সময়', 'প্রথম আলো,পূর্ব পশ্চিম'-এর যতো আধুনিক ক্লাসিক উপন্যাস। বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাস কেন্দ্রিক গবেষণা এই বইগুলিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। তবে কবিতা ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম প্রেম।
'নীরা' নামের এক রহস্যময়ী চরিত্রকে নিয়ে তিনি রচনা করেছেন একের পর এক কালজয়ী কবিতা। কবিতাগুলি পাঠকসমাজে যথেষ্ট সমাদৃত। ‘নীললোহিত’ সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সর্বাপেক্ষা পরিচিত ছদ্মনাম।
নীললোহিতের মাধ্যমে তিনি করতে সক্ষম হয়েছেন। নীললোহিতের সব কাহিনীতে নীললোহিতই কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে নিজেই কাহিনীটি বলে চলে আত্মকথার ভঙ্গিতে। সব কাহিনীতেই নিজের একটি পৃথক সত্তা তৈরী নীললোহিতের বয়স সাতাশ।
নীললোহিত চির-বেকার। চাকরিতে ঢুকলেও তা স্থায়ী হয় না। তার বাড়িতে যা, দাদা, বৌদি রয়েছেন। নীললোহিতের বহু কাহিনীতেই দিকশূন্যপুর বলে একটি জায়গার কথা শোনা যায় যেখানে বহু শিক্ষিত
সফল কিন্তু জীবন সম্পর্কে নিস্পৃহ মানুষ একাকী জীবনযাপন করেন।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি ভারতের 'সাহিত্য অকাদেমি' ও 'পশ্চিমবঙ্গ শিশু-কিশোর অ্যাকাডেমি'-র সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন কে গিয়েছেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল 'পূর্ব- পশ্চিম', 'সেই সময়', 'প্রথম আলো', 'একা এবং কয়েকজন' ইত্যাদি। তাঁর রচিত 'অর্ধেক জীবন' একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। এছাড়াও অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে 'ছবির দেশে কবিতার দেশে, ‘আত্মপ্রকাশ', 'অরণ্যের দিনরাত্রি, 'সরল সত্য', 'অর্জুন', 'আমিই সে', 'কবি ও নর্তকী' ইত্যাদি। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল- 'প্রাণের প্রহরী', 'রাজসভায় মাধবী, ‘মালঞ্চমালা', 'স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী' প্রভৃতি।
তাঁর রচিত অন্যান বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'বরণীয় মানুষ : স্মরণীয় বিচার, আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার ও অন্যান্য' (প্রবন্ধ), 'ইতিহাসে স্বপ্নভঙ্গ (প্রবন্ধ), 'রাশিয়া ভ্রমণ, ‘কবিতার জন্ম ও অন্যান্য' ইত্যাদি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হল 'আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, ‘যুগলবন্দী' (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা), ‘হঠাৎ নীরার জন্য', 'রাত্রির রঁদেভূ, 'শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা' ইত্যাদি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কিছু গল্প- উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত 'অরণ্যের দিনরাত্রি' এবং 'প্রতিদ্বন্দ্বী' উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাকাবাবু সিরিজের চারটি কাহিনী ‘সবুজ দ্বীপের রাজা, 'কাকাবাবু হেরে গেলেন', 'মিশর রহস্য' এবং 'ইয়েতি অভিযান' ইত্যাদিও চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে।
১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে 'আনন্দ পুরস্কার' এবং ১৯৮৫ সালে 'সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৮২ সালে তিনি 'বঙ্কিম পুরস্কার' লাভ করেন।
পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী স্বাতী ব্যানার্জির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের একমাত্র সন্তানের নাম শৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়।
২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর
হৃদ্যন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে ৭৮ বছর বয়সে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।
0 comments:
Post a Comment
অনেক অনেক ধন্যবাদ